হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ২৭

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৫, ২০২০

ঢাকায় অবিরল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বাবু জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে। গ্রামের কথা মনে হলে ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা লৌহজং থানায় এসে পড়ায় বাবুদের আবার ঢাকা শহরে চলে আসতে হয়েছে। এজন্য ওরা একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। এখানে বাবুর কোনও বন্ধু নেই। মা ওকে গেটের বাইরে যেতে দেয় না। গেটে তালা লাগানো থাকে। বাবা সকালে বাড়ির বাইরে চলে গেলে ওরা আরও একা হয়ে যায়। বাবা যতক্ষণ বাইরে থাকেন মায়ের মনটাও খারাপ থাকে। বাবুর ভালো লাগে না।

বাবা মাঝে মাঝে মাকে চুপি চুপি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলেন, বাবু চুপিচুপি শুনে ফেলে। ছটটু চাচা নাকি ঢাকায়, কেউ একজন বাবাকে বলেছে। ছটটু চাচাকে কতদিন দেখা হয় না! প্রতিরাতে যখন বোমা আর গুলির শব্দ শোনা যায়। তখন বাবা মাকে বলেন, এ নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ। এ সময় বাবু মায়ের মুখে হাসির আভা দেখতে পায়। বাবু তখন ভাবে, এ নিশ্চয়ই ছটটু কাকার কাজ। ইমু-টিমুরা এখনো গ্রামে। ওদের গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা যায়নি, তবে যাবে। বাবা বলেছে ওরাও ঢাকা চলে আসতে পারে। ওদের সাথে দেখা হলে ভীষণ মজা হবে! বলার মতো কত গল্প জমে আছে! গ্রামে গিয়ে বাবু যে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, এটা বলতে হবে।

সেদিনের পর বাবুর আর রথখোলায় যাওয়া হয়নি। পরের দিনই বাবা গ্রামে গিয়ে ওদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। লাবু আর আওলাদের ওপর বাবুর হিংসা হয়। ওরা নিশ্চয়ই এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আছে! একদিন সকালবেলা অফিসে যেয়ে হঠাৎ করে বাবা বিপুল বাজার নিয়ে ফিরে এলেন। ফিসফিস করে মায়ের সাথে কথা বললেন। বিপুল উৎসাহে মা বড় বড় হাঁড়ি নামিয়ে রান্নার আয়োজন করতে লাগল। বাবুও মাকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করতে লাগল। বাবু এক ফাঁকে মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, আজ বাড়িতে কারা আসবে?
তোর বাবার বন্ধুরা।
বাবার কোন বন্ধু?
এলেই দেখতে পাবি।

বাবু মায়ের মুখের দিকে তাকালো, মা নিশ্চয়ই কিছু লুকাতে চাচ্ছেন। বাবু জানে, এখন বাবার কোনও বন্ধু ঢাকায় নেই। বাবুর কৌতূহল বেড়ে গেল।

ঠিক দুপুরের আজানের সময় বাবা এলেন। তার দশ মিনিটের মধ্যেই কলিং বেল বাজলো। বাবা গেট খুললেন, দুই সাইকেল আরোহী ভেতরে এলো। এদেরকে বাবু কখনো দেখেনি। এরা বাবার বন্ধু হতেই পারে না। বাবা তেমন কিছু না বলে সাইকেলের ক্যারিয়ারে খাবারের হাঁড়ি তুলে দিলেন। দড়ি দিয়ে ওগুলো বাঁধা হলো। বাবার সাথে দু’একটা কথা বলেই ওরা চলে গেল। বাবার চেহারা দেখে মনে হলো, বাবাও যেন কিছু একটা লুকাতে চাচ্ছেন। বাবার চেহারা দেখে বাবু কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না।

পরদিন বাবু মাকে অনেক চাপাচাপি করতে মা বললেন, ওসব খাবার মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে। বাবু খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরল। বাবাকে না বলার শর্তে নিজের মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্পটা বলল। মা অবাক বিস্ময়ে বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

প্রতিদিন জানালা দিয়ে আকাশ দেখে বাবুর সময় কাটে। ওদের জানালা দিয়ে দেখা যায় ’ডি-প্যালেস’ হোটেল। এই হোটেলের একটা পাকিস্তানি পতাকা টাঙ্গানো। বাবু একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করে। রোজ দুপুরে কয়েকটি কাক এখানে উড়াউড়ি করে। একদিন দেখল, একটি কাক কি মনে করে পতাকায় ঠোকর দিল। দেখাদেখি অন্য কাকেরা উড়েউড়ে পতাকায় ঠোকর বসাতে লাগল। পরদিন একই সময়ে কাকগুলো এলো। কিছুক্ষণ পতাকায় ঠোকর দিয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।

এখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আজ নিশ্চয়ই কাকগুলো আসবে না। এই বৃষ্টিতে কাকেরা কি উড়তে পারে? বাবু জানালা দিয়ে তাকালো, বৃষ্টি উপেক্ষা করে কয়েকটি কাক এখনো উড়াউড়ি করছে। আর থেকে থেতে পাকিস্তানি পতাকাটিকে ঠোক্কর দিচ্ছে। কাকেরা কি পাকিস্তানি পতাকার মধ্যে খাবার জিনিশ খুঁজে পেল? বাবু ভাবছে। চলবে