হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ২৮

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৬, ২০২০

সফল ঢাকা আভিযানের পর ইমাম এখন বিপুল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। বাংলাদেশ যে খুব দ্রুত স্বাধীন হবে, সে ব্যাপারে ওর কোনও সন্দেহ নেই। সিরাজুল ওকে কয়েকদিন নিশ্চিতপুরে থাকতে বললেও ইমাম গা করছে না। ’রিডার ডাইজেষ্ট’ ঘেঁটে আরবান গেরিলাদের নিয়ে লেখা প্রবন্ধ পড়ে। ইমামের এখন নিজেকে আরবান গেরিলা ভাবতেই ভালো লাগে। অপারেশনের দুদিন পরই ইমাম আবার ওর লাল ভক্সওয়াগান নিয়ে ঢাকা শহর চষে বেড়ায়। এমন কি, ওদের হামলার জায়গাটাও দেখে আসে। আগের মতোই যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে পাকিন্তানি সৈন্যদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে।
 
একরাতে ইমামের নিশ্চিত ঘুমটা ভেঙে গেল তীব্র কড়া নাড়ার শব্দে। বাবা-মা দুজনই দরজায় দাঁড়িয়ে। আর্মি পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। মা-বাবার পেছনে একজন মেজর আর সুবেদার দাঁড়ানো। সুবেদার ইমামের দিকে চায়নিজ রাইফেল তাক করল। আরও দুজন সৈনিক এসে রুম তল্লাশি শুরু করল। আধাঘণ্টা ধরে তাণ্ডব বয়ে গেল রুমের মধ্যে। এক সৈনিক আলমারির ভেতর থেকে অর্ধেক শেষ হওয়া ভ্যাট ৬৯ বোতল বের করার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেল। মেজরের চেহারায় হাসি ফুটে উঠল। মেজর এবার বাবা-মাকে জেরা করার জন্য পাশের রুমে নিয়ে গেলেন।

মেজরের ধারণা, ঢাকায় যে নাশকতা চলছে তাতে ঢাকার কিছু যুবক জড়িত। এ কারণে পাড়ায় আল বদররা সন্দেহভাজন যুবকদের তালিকা তৈরি করেছে। এ তালিকায় ইমামের নাম রয়েছে। কিন্ত তল্লাশি করে বাড়িতে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। আর যে ছেলে রুমের ভেতর ভ্যাট ৬৯ এর বোতল রাখে সে নিশ্চয়ই ভারতীয় চরদের সাথে থাকবে না। মেজরের কথায় ইমামের বাবা-মা নিশ্চিত বোধ করলেন। তারপর আবার বললেন, ইমামকে দেখা গেছে ঢাকার বিভিন্ন চেক পয়েন্টে পাহারাদার সৈনিকদের সাথে আড্ডা দিতে। এটা করে সে সৈনিকদের অন্যমনস্ক করতে চেষ্টা করেছে কিনা, জানতে হবে। এজন্যই ঘণ্টাখানেক সময়ের জন্য থানায় যেতে হবে। মেজর ইমামের বাবা-মাকে আশস্ত করে ইমামকে নিজের জীপ গাড়িতে তার পাশে বসালেন। ঘণ্টাখানেক পর আবার ইমামকে নিজে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন বলে আশ্বাস দিলেন।

গাড়িটা যখন থানায় না গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে গেল তখন ইমাম নিশ্চিত যে, ধরা পড়ে গেছে। ইমাম সিদ্ধান্ত নিল, পরিণতি যাই হোক, কোনও কিছুই স্বীকার করবে না। প্রথম চলল মিষ্টি কথায় কথা আদায়ের চেষ্টা। তবে এসব জেরায় ফার্মগেটে হামলার কোনও প্রসঙ্গ আসেনি। ইমাম নিশ্চিত, ফার্মগেট হামলার সন্দেহভাজনদের মধ্যে ও নেই। তারপর তিনদিন ধরে জেরার নামে চলল না ধরনের অত্যাচার। এসব অত্যাচার কখনো সজ্ঞানে কখনো অজ্ঞানে সইতে হয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে সবই সয়েছে। তিনদিন পর অর্ধমৃত অবস্থায় ইমামকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ইমাম পরে জেনেছে, ওর বাবার তদ্বিরের জোরে ওকে জেলখানায় পাঠিয়েছে। নয়তো পাঠাতো পরাপারে।

স্বাস্থ্যটা আগের মতো না থাকলে কী হবে, জেলখানায় ইমামের স্বভাবটা আগের মতোই আমুদে থাকল। ইন্টারপেটারের কাজও জুটে গেল। বাংলাকে উর্দু আর ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতে হয়। ইমাম নতুন বন্দি এলে তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি জানতে চায়। কেউ বিশ্বাস করে ওকে বলে, কেউ বলে না। জেলখানার ভেতরে পাখিদের আনাগোনা দেখে জেলের বাইরে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগে। তবে ইমামের একটাই কামনা, ও জেলে থাকার সময় যেন স্বাধীনতা না আসে। স্বাধীনতা আসার দিন ইমাম মুক্ত বাতাসে থাকতে চায়। স্বাধীনতার দিন লাল ভক্সওয়াগান গাড়িতে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা লাগিয়ে সারাদিন সারারাত ঢাকার এ মাথা সে মাথা চষে বেড়াবে। চলবে