হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ২৯

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০২০

আমানকে সিরাজুল বলেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক শুধু গুলিই ছোড়ে না, গুলি ছোড়ার যোদ্ধা তৈরি করতে দুই থেকে ছয় মাস সময় লাগে। কিন্তু আমানের মতো চলচ্চিত্র বোদ্ধা তৈরি হয় লাখে একটা। ক্যামেরা কামান বন্দুকের চেয়ে অনেক শক্তিশালী অস্ত্র। আমানের উচিত ক্যামেরাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করা। সীমান্তের ওপার থেকে আগত এক মুক্তিযোদ্ধার কাছে আমান অনেক তথ্য পেয়েছে। জহির রায়হান, আলমগীর কবির সীমান্তের ওপারে আছেন। ক্যামেরা নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ান। ওদের তৈরি বিভিন্ন ফুটেজ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে। এ কাজে জড়িত হওয়া আমানের আজন্ম ইচ্ছে। পারভিনের সাথে এসব পরিকল্পনা করে কত অলস সময়ই না কেটেছে! পারভিন না থাক, ওর প্রেরণা তো আছে। এই প্রেরণা দিয়ে আমান আরেক যুদ্ধে নামবে!

বৃটেনেও নাকি বাঙালিরা স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে। পারভিন হোক না অন্যের ঘরণী, যদি স্বাধীনতার জন্য কাজ করে তবে আমানের ভালো লাগবে। স্বাধীনতার পর আমান আবার ঢাকা ফিরে আসবে। হয়তো নতুন দেশ দেখতে পারভিনও লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে আসবে। তখন নিশ্চয়ই পারভিনের সাথে দেখা হবে। মাঝে মাঝে মনে হয়, পারভিন লন্ডন যায়নি, ঢাকায় কোথাও আছে। খালা ওকে মিথ্যা বলছেন। পারভিন হয়তো এখনো আমানের জন্য পথ চেয়ে বসে আছে। স্বাধীন দেশে আমান আবার ঢাকায় ফিরে যাবে। খুঁজে বের করে একদিনের জন্য হলেও পারভিনের মুখোমুখি বসে গরম কফি খাবে।

ছটটুকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আর ঘাঁটির সবার সাথে কী চমৎকার সর্ম্পকই তৈরি হয়েছে! কিন্তু ছটটুই ওকে সীমন্তের ওপারে যাওয়ার জন্য বেশি চাপাচাপি করছে। সুতরাং এক সকালে স্থানীয় এক গাইডকে নিয়ে আমান সীমান্তের পথ ধরল। আমান জানে, স্বাধীনতা হলো একমুখি। দেশ স্বাধীন হলে আমান আবার এ পথে ফিরে আসতে পারবে। স্বাধীন না হলে এ পথে আর ফেরা হবে না।

এ এলাকায় নভেম্বরের প্রথম থেকেই হিমালয়ের উত্তরের বাতাস বইতে থাকে। আর এখন নভেম্বর শেষ হতে চলেছে। শীত ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। এ মাস থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ জোরদার হচ্ছে। ভয়াবহ সব যুদ্ধে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে উভয় পক্ষে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে এমাস থেকেই রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। পারতপক্ষে ওরা এখন ঘাঁটি থেকে বাইরে আসে না। কার্যত ভারত সীমান্ত সংলগ্ন বিশাল এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ বিচরণ ভূমি।

এ এলাকায় বৈউথা স্কুল আর সংলগ্ন এডিও অফিস এলাকায় ঘাঁটি করে আছে পাকিস্তানি বাহিনী। এ ঘাঁটি দখলে এলেই বিশাল এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এসে যাবে। তারপর ঢাকার ওপর আক্রমণের চাপ বাড়ানো যাবে। তারেকের সাথে একত্রে ঠিক করা যুদ্ধ পরিকল্পনার খুটিনাটি নিয়ে ছটটু ভাবছে। রাত তিনটায় জিরো আওয়ার। দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করবে ছটটুর দল। তারেক ওর বাহিনী নিয়ে হামলা করবে পশ্চিম দিক থেকে।

ঠিক মধ্যরাতে ওরা যাত্রা শুরু করল। হাঁটা পথে দু’ঘণ্টার পথ। রাত আড়াইটায় পজিশনে যেতে হবে। তারেকের একজন লোক এসে সব পরিকল্পনা যাচাই করে গেছে। ছটটদের সাথে আছে তিনটি লাইট মেশিনগান। একটি দু‘ইঞ্জি মর্টার, আর আটটি চায়নিজ রাইফেল। তারেকদের কাছে আছে এইচএমজি। মিলিত ফায়ার পাওয়ার পাকিস্তানিদের চেয়ে খুব একটা কম হবে না। আজ খুব ঘন কুয়াশা পড়েছে। কুয়াশা ঢাকা চাঁদ আলো ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এমন আলো-আঁধারি, একটা সফল হামলার জন্য মোক্ষম বটে। শীতের শিশিরে ভেজা আল পথ ধরে ওরা হাঁটছে। ওদের দলটা প্রায় নিঃশব্দে পথ চলছে। শীতের গ্রাম সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে ঘুমিয়ে যায়। নিশাচর পাখি পশু আর ঝিঁঝির ডাক ছাড়া এখন প্রকৃতিতে মানুষ্যসৃষ্ট কোনও শব্দ নেই। এরাতে কারও জেগে থাকার কথা নয়। তবু বাড়তি সর্তক থাকতে হচ্ছে।  

এক বছরে কী দ্রুতই না সব কিছু পাল্টে যাচ্ছে! গত বছর এ সময়টায় দক্ষিণ বঙ্গের ওপর বয়ে গেছে ভয়াবহ সাইক্লোন। মানুষ মরেছে অসহায় পশুর মতো। আর পচিশ মার্চ রাতে মানুষের ওপর পশুর মতোই ঝাপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। গত এক বছরে ঝড় আর মানুষের তাণ্ডবে এ বাংলা আজ ক্ষতবিক্ষত। আর ছটটুর জীবনটাও কী বিপুল পাল্টে গেছে! ধরা পড়ে জেলে যাওয়া, অলৌকিকভাবে জেলমুক্তি, তারপর পেশাদার সৈনিকের মতো যুদ্ধে যাওয়া, আর এখন যুদ্ধ জয়ের ম্বপ্ন দেখা!

পনেরো জনের এই দলটিতে আছে পঞ্চাশ বছর বয়সের মণ্ডল। দলের সবচেয়ে বয়স্ক আর কম বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা। আর প্রায় কিশোর জাকির। মুক্তিযুদ্ধে আসার গল্পটা যার যার আলাদা। ছটটুর বয়স এখন ছাব্বিশ। আজ যদি মারা যায় তবে পৃথিবীর কী এমন আসে যাবে! কথা হলো, কি রেখে যাচ্ছি পৃথিবীর জন্য। কবি সুকান্ত মারা গেছে একুশ বছর বয়সে। অথচ বয়সকে অতিক্রম করে কি অদ্ভুত সৃষ্টিই না রেখে গেছেন! পারুলের কথা মনে পড়ছে। কিশোর বয়সে ক্ষণিকের জন্য পারুলকে ভালো লেগেছিল। তারপর পারুল মুছে গিয়েছিল। বিয়ে হয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল। কাকতলীয় ভাবে সেই পারুল আবার ওর জীবনে ফিরে এসেছে। এ যুদ্ধ পারুলকে বিধবা করেছে। বাবাকে দুঃসময়ে হারিয়েছে। পারুল এখন আবার নুতুন জীবন শুরু করছে, প্রতিশোধের জীবন। পারুলের জীবনে এখন ছ্টটুর কোনও স্থান নেই। মফঃস্বলের সহজ সরল পারুল কী অদ্ভুত ভাবেই না পাল্টে গেছে!

পারুল ফিল্ড হাসপাতালে প্রতিদিন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় অমানুষিক পরিশ্রম করে চলছে। মনে পড়ে, পারুলকে পাওয়ার জন্য কী তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ফিল্ড হাসপাতালে ঝড়ের মতো উদ্দাম হয়ে উঠেছিল। একদা কুমারী পারুল যে নাকি অক্লেশে সব উজার করে দিতে চেয়েছিল, সেই পারুল কি নির্মমভাবেই না ছটটুকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখনো কানে বাজে তীব্র শ্লেষ মেশানো, চাবুকের আঘাতের মতো পারুলের উক্তি, ছিঃ আপনি দেখি পাকিস্তানি সৈন্যর চেয়েও খারাপ।

তীব্র অনুশোচনার পর লজ্জা আর সংকোচে ছটটু আর পারুলের মুখোমুখি হয়নি। পারুলও হয়তো এ জীবনে আর ছটটুকে ক্ষমা করতে পারবে না। তারপরও পারুলকে নিয়ে স্বপ্নটা মিলিয়ে যায়নি। সেই কিশোর বেলার দিনগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসে। চলবে