হৃদয় ছোঁয়ার দিন

শেষ পর্ব

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৯, ২০২০

ছটটু আবার চোখ মেলে তাকালো। চারদিকে আঁধার। প্রচণ্ড শব্দে মাটি কাঁপছে থেকে থেকে। গুলি হচ্ছে। সবকিছু মনে পড়ছে এখন। চারদিকে শত্রু, গুলি থেকে নিজেকে বাচাঁতে হবে। ওদের দলটাকে নিরাপদে সরে যাওয়ার পথ করে দিতে হবে। গুলি করে হানাদারদের আটকাতে হবে। দুটো এসএলআর আর ম্যাগাজিন যেন মাটিতে গেঁথে আছে, হাজার মণ ভারি মনে হচ্ছে। ওসবসহ দেহটা টেনে টেনে ইঞ্চি ইঞ্চি করে রেইনট্রি গাছে আড়ালে নিয়ে এলো। এই শীতে প্রচণ্ড গরমে ছটটু ঘামছে। পানি খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে। ডান পা এখন পুরো অবশ। টেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক কসরৎ করে এসএলআরের নলটা গাছের গুড়ির পাশে বসাতে পারল। ছটটুর আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো। ট্রিগারে চাপ পড়ল, মৃদু ধাক্কা দিয়ে ছুটে গুলি ছুটে গেল। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ছটটু। গুলি আর বন্দুক কাজ করলে একজন যোদ্ধার আর ভয় কি? ডান পায়ের ব্যথা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ টিকে থাকতে পারলেই দলের সবাই নিরাপদ। কিশোর জাকির এই দলেই আছে। বয়স বড়জোর চৌদ্দ। ওর বেঁচে থাকা দরকার। আর প্রৌঢ় মণ্ডল, দেশ স্বাধীন হলেই তিনি তার দু‘মেয়ের বিয়ে দেবেন অনেক ধুমধামে। সেই বিয়েতে ছটটুর আগাম নিমন্ত্রণ। আরও কতজন আছে! সবার বাঁচতে হবে। ছটটু কান খাড়া করে গুলির উৎস আবিষ্কার চেষ্টা করে। তারপর একটা একটা করে গুলি ছোড়ে। হাতের জোর যেন কমে যাচ্ছে। ট্রিগার চাপার জন্য যথেষ্ট জোর পাওয়া যাচ্ছে না। এলোপাথারি গুলির বিরতি নেই যেন! কত সময় কেটেছে, কে জানে! দলের সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে নিরাপদ জায়গায় চলে গেছে। এখন পিছু হটা যায়। ছটটু শরীরটা নাড়াতে গেল। সাথে সাথে টনটনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল সারাদেহে।

একটা ভো ভো শব্দে চোখ খুলল ছটটু। আশপাশে কারা যেন ড্রামের কাটা টিন সোজা করার জন্য হাতুড়ি পিটাচ্ছে। বড় বিচ্ছিরি শব্দ! ছটটু চোখ বন্ধ করে ফেলল। হাতুড়ি পেটা বন্ধ করার জন্য কাউকে বলা দরকার। এই বিদঘুটে শব্দে কী কারও ঘুম আসে! ছ্টটু আবার চোখ খুলল। টিন পেটানোর শব্দ এখন আর নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। হঠাৎ করে প্যাডেল স্টিমারের ভেঁপুর শব্দ ভেসে এলো। ছটটু দেখল, সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে হলদে রং প্যাডেল স্টিমার। স্টিমারের বিশাল চিমনি থেকে ভলকে ভলকে উঠছে কালো ধোঁয়া। কালো ধোঁয়ায় এখন আকাশ দেখা যাচ্ছে না। স্টিমারের দোতলা ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক দঙ্গল স্বাস্থ্যোজ্জ্বল শিশু। কী চমৎকার পোষাক-আষাক। শিশুরা ছটটুকে দেখে হাত নাড়ছে। এই শিশুদের মধ্যে ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা বোনের ছেলেমেয়েরাও আছে। কিন্তু এই সব শিশুরা কোথায় যাচ্ছে? ওরা কি জানে না এখানে ভয়ংকর যুদ্ধ হচ্ছে! নদী ছেড়ে স্টিমারটা মাঠের ভেতর চলে এলো কেন? সবাই জানে, এই স্টিমার প্রতি ভোরে দুপাশের প্যাডেলে প্রচণ্ড ঢেউ তুলে কীর্তনখোলা নদীকে জাগিয়ে তোলে। প্রতি সকালে স্টিমারের ভেঁপুর শব্দে বরিশাল শহরের ঘুম ভাঙে। সেই নদী ছেড়ে স্বপ্নের শিশুদের নিয়ে নির্বোধ সারেং স্টিমারটা এখানে নিয়ে এসেছে! সারেংকে কিছু একটা বলা দরকার। ছটটু কিছু বলার আগেই স্টিমারটা পেছন দিকে ঘুরে গেল। তারপর খুব দ্রুত দিগন্তে মিলিয়ে গেল। নিরাপদেই জাহাজটা চলে গেল। স্বস্তি পেল ছটটু। স্বস্তির কারণেই ঘুম চলে এলো দুচোখে।

কম্যন্ডার কম্যন্ডার... দূরাগত একটা ডাকে ছটটু চোখ মেলে তাকালো। ওর কানের পাশে মুখ নিয়ে কথা বলছে কেউ। চিনতে পারল, এত কিশোর জাকির! তারপর তাকালো এসএলআরের দিকে। ওটা পজিশন মতোই আছে। হাতটাও ট্রিগারে আছে। ‘ও কম্যন্ডার, শরীরের রক্ত সবশেষ। ক্যমনে আপনারে সরামু।’ ছটটুর পাশে ঝুঁকে, মাটিতে শুয়ে কানের কাছে মুখ এনে ফোঁপাতে ফোঁপাতে জাকির বলল। গুলির আওয়াজ ছাপিয়ে জাকিরের টুকরা টুকরা কথা শুনতে পেল ছটটু।

সবাই দূরে গেছে কম্যন্ডার স্যার, আপনে না ঠেক্যাইলে সবাই মরতাম। কিন্তু আপনার পা তো শেষ কম্যন্ডার। মণ্ডল স্যার আমারে পাঠাইল খালি হাতে। না, গ্রেনেড আছে দুইটা।

জাকিরকে পাশে পেয়ে মনের সব শক্তি একত্রে করে মাথাটা একটু উঁচু করে চারদিকটা দেখে নিল ছ্টটু। তারপর ট্রিগারে হাত দিল। একঝাঁক গুলি বেরিয়ে গেল। এই করতেই ঘেমে উঠল। মাথার ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। আবার ট্রিগার চাপার চেষ্টা করল ছটটু, কাজ হচ্ছে না। হাতটা এখন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।

সামনের মাঠের ঘাসগুলো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে যেন। কী অদ্ভুত, ঘাসগুলো বড় হতে হতে কাশগাছ হয়ে গেল। তারপর ওগুলো থেকে বের হতে লাগল সাদা সাদা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল, কাশফুল।  পুরো মাঠটাই এখন কাশবন। কাশবনের ভেতর থেকে কেউ একজন বেরিয়ে আসছে, এদিকেই। সাদা শাড়ি গায়ে এক রমণী, এই যুদ্ধভূমিতে কি চায় সে? ছটটু বিড়বিড় করে বলল, জাকির জাকির, দেখে আয় ওই মহিলা এখানে কি চায়? যুদ্ধ হচ্ছে চারদিকে, মারা যাবে যে! জাকির জাকির...

জাকিরের কোনও সাড়া নেই। এই এক মুশকিল জাকিরকে নিয়ে। কাজের সময় কোথায় যেন হারিয়ে যায়! বকা দিলে মাথা নিচু করে হাসতে থাকে। ছটটু মাঠের দিকে তাকালো। সেই রমণী এদিকেই দিকেই আসছে। আরে এ যে দেখছি পারুল! ফিল্ড হাসপাতাল ছেড়ে পারুল এখানে কি করছে! মনে পড়ছে, ছটটুর পায়ে কিছু একটা হয়েছে, চিকিৎসা দরকার। পারুল নিশ্চয়ই ছটটুকে ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে যাবে। ওখানে পায়ের চিকিৎসা হবে। পারুল সারাক্ষণ পাশে থাকবে। পারুলকে ছুঁয়েও দেখা যাবে। পা ভালো হলে আবার যুদ্ধে যাওয়া যাবে। এবার আর ভুল হবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে পারুলকে নিয়ে আসতে হবে। সেই কিশোরবেলায় একদিন পারুলের কাছ থেকে জোর করে ভালবাসা আদায় করেছিল। সেই দিনের মতোই যেন এই দিনটি। এদিকে তাকিয়ে পারুল যেন হাসল। ছটটু ওকে ডাকল, ছটটুর ডাকে পারুল এগিয়ে আসছে। একটা প্রশান্তির ধারা নেমে এলো মাথা বেয়ে শরীরে, দেহে হতে পায়ে। ইচ্ছে হচ্ছে, এভাবে ঘাসের বুকে অনন্তকাল শুয়ে থাকতে।

পারুল আসছে। পারুলকে ছোঁয়া যাবে। পারুলকে দেখার জন্য ছটটু মাথাটা আরেকটু তুলল। একি, পারুল দেখি শূন্যে ভাসছে! ওর সাদা শাড়ি কাশফুলের সাদার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ওকে থামানো দরকার। ছটটু প্রচণ্ড চিৎকার করে পারুলকে ডাকল, কেবল একটা গরগর আওয়াজ বেরুল ছটটুর গলা থেকে। ছটটুর চোখের সামনে থেকে কাশবন, মাঠ, আলো সব নিমিষে মিলিয়ে গেল। গুলির শব্দে আর জাকিরের ফিসফিসানিতে ছটটু চোখ তুলে তাকাল। শরীরের সব জোর একত্র করে ছটটু ট্রিগার চাপল। অল্প একটা আওয়াজ বেরুল, গুলি বেরুনোর কোনও শব্দ নেই। তাহলে গুলি শেষ। নিঃসঙ্গ যোদ্ধার জন্য নির্মম অভিশাপ। ছটটু জাকিরের দিকে তাকাল। জাকির কোমরে বাধা গামছার বাঁধনখুলে একটা গ্রেনেড বের করে ছটটুর হাতের পাশে রাখল। ছটটু কিছু বলার আগেই ক্রলিং করে জাকির ছটটুর পাশ থেকে সরে যেতে লাগল। এই ছেলেটাকে নিয়ে এই এক মুশকিল। হুটহাট করে একেকটা কাণ্ড করে বসে। ছেলেটা নিরাপদে সরে যেতে পারলেই ভালো। কিন্তু ওর হাতের গ্রেনেডটা রেখে যেতে পারত! দুটো গ্রেনেড থাকলে দ্বিগুণ সময় টিকে থাকা যায়। চোখের পাতাগুলো ভারি মনে হচ্ছে। জোর করে ছটটু চোখের পাতা খুলল।

ক্রলিং করে জাকির যেখানে গিয়ে ঘাপটি মেরে আছে তার দশগজ সামনেই কয়েকটি ইস্পাতের ফলার ওপর চাঁদের হালকা আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। কালো কালো ছাঁয়াগুলো স্পষ্ট হচ্ছে, ব্যয়নেট লাগানো সঙ্গীন উঁচিয়ে ওরা বৃত্তকারে এগিয়ে আসছে। এখনো ছটটুর কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে, তারপরও ছটটুর হাতটা চলে গেল গ্রেনেডের ওপর। আঙ্গুল স্পর্শ করল গ্রেনেডের পিন।  জাকির যেখানে লুকিয়েছে সেখানে তাকালো ছটটু। সঙ্গীন উঁচানো বৃত্তটা আরও ছোট হচ্ছে। ছটটু দেখল, হঠাৎ করে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল জাকির। হাতের গ্রেনেড উড়ে গেল। পরমুহূর্তে শূন্যে ঝাঁকি খেল জাকিরের ছোট্ট দেহ। তারপর ছিটকে পড়ল মাটিতে। একই সময়ে প্রচণ্ড শক্ ওয়েভের ধাক্কায় কেঁপে উঠল মাটি। দাঁতে দাঁত চেপে ছটটু শক্ ওয়েভের ধাক্কা সামলাতে চেষ্টা করল। পায়ে থেকে প্রচণ্ড ব্যথা ছড়াচ্ছে। ছটটু জাকিরের দেহটা দেখার চেষ্টা করল। এখান থেকে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে স্তূপীকৃত মাংসে স্তূপ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। ওগুলো থেকে বোধ হয় ধোঁয়া বের হচ্ছে।

গ্রেনেড ভালোই কাজ করেছে। কিশোর জাকির বার বছরের জীবনটা দিয়েই এ কাজটি করেছে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের পরই থেমে গেছে গুলির শব্দ। চারদিক আবার স্বাভাবিক রাতের মতোই ঝিঁঝির ডাক। রাতজাগা পাখির ডাক। শিয়ালের হুক্কা হুয়ার দূরাগত শব্দে মুখর হলো। অতি ক্ষীণ একটা আশা, বেঁচে থাকার আশাটা একটু একটু আশা জাগাচ্ছে যেন। ছটটু চোখের পাতা বন্ধ করল। অনেক দূর থেকে একটা গানের সুর ভেসে আসছে। ছ্টটু গানের সুরটা বোঝার চেষ্টা করল। আরে, এ যে ডিএল রায়ের সেই বিখ্যাত গান, এমন দেশটি কোথাও তুমি...

ছটটু হাত দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল। শিশুকালে দেখা মাকে এত বছর পর হঠাৎ মনে পড়ল। এখন চোখ খুললেই বোধ হয় মাকে দেখা যাবে। গানের শেষকলিটা এখন শোনা যাচ্ছে। ছটটু চোখ খুলল, রাতের আঁধার এখন অনেকটা মিলিয়ে গেছে। সেই আলোয় ছটটু দেখল, রাইফেলের নলে আটকানো দুটো বেয়নেট হাত পাঁচেক দূর থেকে এগিয়ে আসছে। ছটটু আঙুলটা গ্রেনেডের পিনের স্পর্শ পেল। আস্তে করে পিনটা সরে গেল। গ্রেনেড ছোড়ার মতো জোর অবশিষ্ট নেই। তবে হাতটা একটু সরাতে পারলেই গ্রেনেডটা মাটিতে পরবে। ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা এখনও বেজে চলেছে।

ছটটুর হাত থেকে গ্রেনেডটা মাটিতে পড়ে গেল। একটা দেহের হাড়-মাংস শত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে নরম মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল।