
হৃদয় ছোাঁয়ার দিন
উপন্যাস ১১
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৭, ২০২০
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। চারদিন পর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। ঝড়ের ধকলের পর আবারও নির্বাচনী উত্তাপ ফিরে এসেছে। নির্বাচনী মাঠে ভাসানী ন্যাপ নেই। যে গুটি কয়েক দল নির্বাচনী লড়াইয়ে আছে তাদের না আছে নেতা, না আছে সমর্থক। আওয়ামী লীগ যদি সিংহ, বাকিরা মুষিক। সুতরাং ভবিষ্যৎ বেশ স্পষ্ট।
ঢাকার সন্ধ্যার নির্মেঘ আকাশে নেমে এনেছে কুয়াশার স্তর। প্রায় মাস তিনেক পর ছটটু ঢাকায় ফিরল। ঢাকা কেন যেন ওকে টানছে। ভাইবোনদের সাথে দেখা নেই প্রায় দুবছর। ভাইয়ের ছেলেমেয়ে বাবু আর মিষ্টিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। সামনে কঠিন সময়, অপেক্ষা করছে আন্ডার গ্রাউন্ড জীবন। সুতরাং ঢাকা ছাড়ার আগে সবার সাথে দেখা করতে হবে।
এখন ছটটু যাচ্ছে মহাখালীতে, ওখানে এক বাড়িতে সিরাজুল হকের আসার কথা। রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ছটটু মহাখালী লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে পৌঁছল। ডানদিকে ঘুরতে যাবে, ঠিক তখনই কুয়াশা ফুঁড়ে যেন বের হলো লোকটি। ঠিক কানের কাছে মাথা লাগিয়ে লোকটি বলল, ম্যাচের কাঠি আছে নাকি ভাই?
ছটটু পকেট হাতড়ে ম্যাচ বের করতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই নাটকীয় ভঙ্গিতে পিছিয়ে গেল লোকটি। ছটটু দেখল, লোকটি হাতের ভয়ংকর দর্শন পিস্তলটি ওর দিকে তাক করে আছে। ’নট নড়ন চড়ন। মাথার উপর হাত তোলো। নয়তো খুলি উড়ে যাবে।
এসবের মানে কি? ছটটু রাগত গলায় জানতে চাইল।
বুঝবে চাঁদ, চালাকি করলে মরবে। পালাতে চাইলে বিপ্লবীদের মেরে ফেলাই নিয়ম।
ছটটু বুঝলো, পুলিশের পাল্লায় পড়েছে। এখন প্রথম চিন্তা পালাতে হবে। ছটটু দ্রুত ভাবছে আর পিস্তলের দিকে তাকিয়ে সুযোগ খুঁজছে। ঠিক এ সময় পেছন থেকে আবির্ভাব ঘটল আরও দুজনের। ছটটুর দু’কাঁধে দুটি শক্তিশালী হাতের চাপ পড়ল। তীব্র চাপে ওর দু‘হাত নেতিয়ে গেল। ঝটপট ওর হাত দুটি টেনে তৃতীয় ব্যক্তি হাতকড়া পরিয়ে দিল। পরক্ষণেই কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা হলো ওর দু’চোখ। হাতকড়ার দড়িতে টান লাগছে। গরু টানার মতো টানছে কেউ। ছটটু নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল।
কয়েক পা হাঁটার পর লোকজনের কথাবার্তা কানে এলো। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল, কাকে ধরলেন ভাই?
ডাকাত! খুব বড় ডাকাত!
ছটটুর কানে এলো অনেক দূর থেকে ভেসে আসা শ্লোগান, নৌকা মার্কায় দিলে ভোট শান্তি পাবে দেশের লোক।
ছটটুকে কাঠের চেয়ারে বেঁধে বসিয়ে দেয়া হলো। ওর চোখের বাঁধনটা খুলল কেউ। তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ছটটুর সামনে বেশ বড়সড় টেবিল। কমপক্ষে পাঁচশো ওয়াটের বাল্ব টেবিলের দেড় ফুট উপরে ঝুলে আছে। তীব্র আলোয় টেবিলে ওপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
ডু ইউ নো ইংলিশ? টেবিলের ওপার থেকে ভরাট কণ্ঠে প্রশ্ন করল কেউ একজন।
লিটল বিট।
তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমার জ্ঞান কিছুটা কম, তোমার কাছ থেকে জেনে নেব। এই আর কি! আশা করি, সাহায্য করবে। ঠিক আছে?
ছটটু মাথা নাড়ল।
আচ্ছা মি. ছটটু, ভিয়েতনাম যুদ্ধে কারা বিজয়ী হবে? আমেরিকা নাকি ভিয়েতনামী কমিউনিস্টরা?
অবশ্যই ভিয়েতনামী গেরিলারা। প্রত্যয়ী কণ্ঠে ছটটু বলল। পরমুহূর্তে উপলদ্ধি করল, মস্ত ভুল হয়ে গেছে। ছটটু ফাঁদে পা দিয়েছে, এখন ফেরার পথ নেই।
তোমার এই ধারণার কারণ কি? ফের প্রশ্ন করেন প্রশ্নকর্তা।
জনগণ কখনো পরাজিত হয় না।
চমৎকার মি. ছটটু! আর ভারতের নকশালবাড়ির আন্দোলনে কারা বিজয়ী হবে?
আমি ঠিক জানি না।
কেন?
ওদের সর্ম্পকে আমার তেমন ধারণা নেই।
অবাক কাণ্ড! ভিয়েতনাম সর্ম্পকে জানো অথচ বাড়ির কাছে নকশালবাড়ি সর্ম্পকে জানো না?
আমার তেমন ধারণঅ নেই।
আছে মি. ছটটু, আছে। তুমি তো নকশালবাড়ি থেকেই এলে। তা এ নির্বাচন বানচালের জন্য কি কি অস্ত্র নিয়ে এসেছ? বলে ফেলো।
আমি কখনো নকশালবাড়ি যাইনি।
দেখো ছটটু, তোমার বয়স কম। আমাকে সহযোগিতা করো। জীবনে অনেক কিছু পাবে। থ্রি ডব্লিউ ওম্যান, ওয়েলথ এন্ড ওয়াইন। আমাকে সাহায্য করলে এখান থেকে এয়ারপোর্টে যাবে। করাচি-লাহোর ঘুরে আসবে। এখন বলো, অস্ত্রেগুলো কোথায়। আর সিরাজুল হক কোথায়?
আমি তো বলেছি আমি নকশালবাড়ি যাইনি। সিরাজুলকেও চিনি না। কোথায় থাকে তাও জানি না।
ওকে ফাইন। শক্ত বিপ্লবী, শক্ত দাওয়াই দরকার।
আলোটা নিভে গেল। কারও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ছটটু ধারণা করল, ওকে পুলিশ ধরেনি। সামরিক বাহিনী ধরেছে। আর এটা সম্ভবত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। এরা ছটটুদের দল সর্ম্পকে অতি ধারণা পোষণ করেছে। নকশালবাড়ির সাথে ওদের কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। ছটটু কেন, ওদের দলের কেউ সীমান্তের ওপারে যায়নি। অস্ত্র বলতে আছে সিরাজুলের একটা ভাঙা পিস্তল। ভয় দেখানো ছাড়া আর কোনও কাজে আসে না। অনেক কষ্টে গুলি ছোড়া গেলেও টার্গেট মিস হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। আর হাতে তৈরি যে ককটেল, সেগুলোর ধ্বংস ক্ষমতা বিবেচনায় আনলে, ওদের যাবতীয় কার্যকলাপ নির্দোষ কৌতুকে পরিণত হবে।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর অন্ধকার সয়ে এলো দু’চোখে। রুমটায় কোনও জানলা নেই। শুধু লোহার ভারি দরজা। বাইরের একটি শব্দও এই রুমে আসে না। আসে না পাখির ডাক। মানুষের কথাবার্তা। এমনকি ভারি বুটের শব্দও। এখানে সময় সম্পর্কে কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। এখন রাত না দিন, কে জানে? মনে পড়ে, ধরা পড়ার দু’ঘণ্টা আগে ছটটু পরাটা ভাজি খেয়েছিল। রাতে ভাইয়ের বাড়িতে খাওয়ার কথা ছিল। এক সময় খুব খিদে পেয়েছিল। এখন খিদে-পিপাসা কিছুই নেই। নিজেকে অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে।
এখানে বিরাজমান কবরের নিস্তব্ধতা আর একাকিত্ব সময়টা সীমাহীন প্রলম্বিত করেছে। হাত-পা চেয়ারের সাথে বাঁধা থাকায় সারা দেহের শিরা-উপশিরায় ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে। ইচ্ছে হচ্ছে, হাত-পা ছড়িয়ে সারা দেহটা মেঝেতে লুটিয়ে দিতে। ছটটুর আর কিছু ভালো লাগছে না। আধোঘুম আধো জাগরণের মধ্যে সময়টা কেটে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, ইন্টারগেশনের সময় লোকটিকে সাহায্য করলেই বোধ হয় ভালো হতো। মুক্তি মিলত। কোটি মানুষের দেশে সাধ্য কি ওদের মতো দু’চার-দশজন বিপ্লব করে! এ তো মরিচিকা, সস্তা আবেগ। কিছু তো হবেই না, কেবল ছোটাছুটি সার!
বিগত কয়েক বছর কত কষ্টেই না জীবন কেটেছে। ঝক্ঝকে আয়নার মতো সোনালি যৌবনে পড়েছে ধুলির আস্তরণ। এই লোকটিকে সাহায্য করলেই সোনার পাথর বাটি হাতে এসে যাবে। ছটটু আর সহ্য করতে পারে না। লোকটিকে ডেকে সব বলে দিতে হবে। ছটটু চিৎকার করল, কে আছ ভাই... উঁচু ছাদে ওর কথা প্রতিফলিত হলো কেবল। কেউ এলো না। বেশ কয়েক বার চিৎকার করেও লাভ হলো না। সাউন্ড প্রুফ রুম বোধ হয়! হতাশায় ছটটুর মাথাটা ঝুঁকে পড়ল। এসব কি ভাবছে? নিজেকে এত নির্বোধ মনে হচ্ছে কেন? ছটটু কি পাগল হয়ে যাবে? ভাবনাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে যেন? দলের সবাইকে ছটটু ধরিয়ে দেবে, ছটটু হবে বিশ্বাসঘাতক। যুগ যুগ ধরে বিপ্লবীরা ওর নামে থুথু ছিটাবে। যে যা খুশি বলুক, ছটটুর দরকার হাঁটাচলার স্বাধীনতা। মুক্ত বাতাস! এই বাতাসের জন্য ছটটু প্রয়োজনে সব কিছু করতেই রাজি। আবার এলোমেলো হচ্ছে সব কিছু।
ছটটুর সামনে এখন ভাসছে ওর সঙ্গি সাথিদের মুখ। পেন্ডুলামের মতো দুলছে ছটটুর চিন্তা। সুযোগ নিয়ে সুবিধাবাদীদের দলে ভিড়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। জীবনে সবই পাওয়া যাবে। ছটটু তাই করবে। আবার একটু চেতনা ফিরে এলো বোধ হয়। এ সব ভাবনার কোনও মানে নেই। ছটটু বিশ্বাসঘাতক হতেই পারে না। এ জীবনটা হয়তো চলে যাবে। এর চেয়ে বেশি আর ক্ষতি কি হবে! ছটটু মারা গেলে অন্তত একজন বিশ্বাসঘাতক কমে যাবে। যাক, এখনো মাথাটা খারাপ হয়নি। এখন কেবল একটু ঘুমাতে পারলে ভাল হতো!
ছটটু ঘুমাতে যাবে, চোখের পাতা এক করেছে কি করেনি, ছাদে ঝুলে থাকা সার্চ লাইট জ্বলে উঠল। সারা ঘরে আলোর বন্যা। দু’চোখের পাতা আপনা আপনি খুলে যাচ্ছে। ওরা ছটটুকে ঘুমাতে দেবে না।
এই বানচোত, জামা কাপড় খোল। উর্দু ভাষায় দাড়িঅলা লোকটি ধমকে উঠল। এ পর্যন্ত কেউ খারাপ আচরণ করেনি। খন সেই পর্ব শুরু হলো বোধ হয়। ছটটুকে নিয়ে আসা হয়েছে বাথরুমের মতো একটি কক্ষে। দাড়িঅলা ছাড়াও আছে দৈত্যর মতো দুটো লোক। তিনজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের সামনে নগ্ন হতে বিব্রত বোধ হচ্ছে।
খোলা শালা। তাগিদ দিল আরেকজন।
ছটটুর অপেক্ষায় না থেকে সত্যি সত্যি লোকটি ওর পাজামার গিঁটে হাত দিল। ক্ষুধা, দুর্ভাবনা আর ঘুমহীনতায় ছটটুর শরীর শক্তিহীন। মন চাইলেও ওদের প্রতিরোধে শরীরের সায় নেই। ছটটু নিজেই নগ্ন হয়ে দাঁড়াল। সাথে সাথে তিনজনই ঝাঁপিয়ে পড়ল। চুল ধরে ওকে মেঝেতে শুইয়ে দিল। নাইলনের দড়ি দিয়ে কোরবানির গরুর মতো বাধা হলো হাত-পা। এবার তিনজনে মিলে ওর গোটা দেহটা ঢুকিয়ে দিল ড্রামের ভেতর। মাথা কেবল থাকাল ড্রামের বাইরে। তীব্র ঠাণ্ডা পানির স্পর্শে কেঁপে উঠল ওর গোটা দেহ। পানিতে নিশ্চয়ই বরফ দেয়া। তীব্র ঠাণ্ডা পানিতে চারদিকে কি সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওগুলো ইনজাকশনের মতো অগনিত সূঁচ ফোটাচ্ছে। ব্যথা থেকে রক্ষা পেতে পানিতে খলবলিয়ে উঠল দেহটা। সাথে সাথে দ্বিগুণ হলো খোঁচা। ঊরু, তলপেটে, বাহুতে কোথায় নয়!
এর নাম শিং মাছ টিট্টমেন্ট। ছটটুর যন্ত্রণা দেখে হাসতে হাসতে বলল দাড়িঅলা।
ব্যথা থেকে রক্ষা পেতে দাঁত দিয়ে দু’ঠোঁট কামড়ে ধরল ছটটু। চোখের পাতায় নেমে এলো অন্ধকার। বিষজর্জর অনুভূতিটা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে। শূন্যে নেমে এলো ছটটুর চিন্তাশক্তি। ছটটু জ্ঞান হারালো। অর্ধ চেতন অবস্থায় ছটটুর জ্ঞান ফিরল। কোথাও শুয়ে আছে। চোখের পাতা হাজার মন ভারি মনে হচ্ছে। কোথাও থেকে একটা দূরাগত শব্দ ভেসে এলো যেন, সিরাজুল হক কোথায়? অস্ত্রগুলো কোথায়? উত্তর না দিলে তোকে মেরে ফেলবো।’ ছটটু কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল। ওর মুখে দিয়ে কেবল ঘরঘর শব্দ বের হলো। উঠে বসার চেষ্টা করতেই ওর দেহটা ঝপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। ফের জ্ঞান হারালো সে। চলবে