আহমদ মেহেদীর খুদে গল্প ‘শীতের এক রাতে’

প্রকাশিত : জুলাই ০২, ২০২২

রাত ১২টা। কল বাজছে। ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইল হাতে তুলে দেখি, সুমি।
জিজ্ঞেস করল, হ্যালো, কী করো?
বললাম, সন্ধে থেকে জ্বর। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোমার কি অবস্থা? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
ও, তাহলে চলে এসো। দেখে যাও আমাকে। একটু থেমে সুমি আবারও বল, যদি সাহস থাকে চলে আসো... হি হি হি...!
জেদ চেপে গেল। হোক না এত রাত, আমি আজ তাকে দেখতে যাবই। জেদের কথা তাকে আর বলতে গিয়েও বললাম না। ততক্ষণে জ্বর নিয়েই প্রিয়তমাকে সারপ্রাইজ দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি।

কুটুম্বপুর-কালিয়ার চর রোডের সাথে আমাদের  নয়নাভিরাম সবুজ গ্রাম। আমাদের এখান থেকে সুমিদের বাড়ি যেতে পনের টাকা সিএনজি ভাড়া লাগে কিন্তু এত রাতে তিনশো টাকা দিয়েও কিছু পাওয়ার আশা করা নিরর্থক। যেন আজকে মাতাল জোসনা পড়েছে। বাজারে গিয়ে দোকানদার জসিমকে ডেকে তুললাম। বেচারা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল। দোকানের দরজা খুলেই বুঝল, কেন তার মূল্যবান ঘুম নষ্ট করেছি। এক প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেডজেস নিলাম।
জসিম জিজ্ঞেস করল, কই যাবেন রুবেল ভাই?
কোথাও যাব না। আছি, বাজারেই আছি।

ও আচ্ছা, বলেই সে দোকান বন্ধ করে দিল। আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম। বাম কানে হেডফোন লাগিয়ে সুমিকে কল দিলাম।
সুমি বলল, এখনো ঘুমাওনি তুমি?
বাজারে এসেছি।
কেন?
এমনি।
যাও, বাড়ি চলে যাও। আমি থাকলে তো মাথায় পানি ঢেলে দিতাম।

প্রসংগ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলছি আর হাঁটছি। সুমি তখনো জানে না যে, আমি তার বাড়ির দিকেই আসছি। বিপদসংকুল নির্জন পথ। হাতে স্মার্টফোন, পকেটে তিন হাজার টাকা। এ রাস্তায় কিছুদিন পরপরই ডাকাতি হয়। বিকালে দাদি-চাচিরা পাশের বাড়ির মোফাচ্ছেলের বউয়ের জ্বিন-ভূত ধরা নিয়ে যে আলোচনা করেছিল, রাস্তার পাশের কবরস্থান আরও সামনে গিয়ে হিন্দুদের একটি চিতাল দেখে, উ! গা হিম হয়ে যাবার মতো অবস্থা। মনে মনে আল্লাহর নাম ডাকছি আর ভাবছি, কী দরকার ছিল এত রাতে জিদ করার।

সিগারেট চলছে একটার পর একটা। মুরুব্বিরা বলে থাকেন,  আগুন হাতে থাকলে নাকি জ্বিন-ভূত কাছে আসে না। তাই এই সিগারেট জ্বলন থেরাপি। ৪০-৪৫ মিনিটের পথ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টার।
অবশেষে বাড়ির কাছাকাছি আসার পর সুমিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কোন ঘরে?
কেন?
না এমনি, জানার ইচ্ছে হলো, তাই।
বড় ভাবির ঘরে।
ভাবির ঘরটা কি পুবপাশে?
হ্যাঁ, আচ্ছা বলো তো তুমি কি সত্যি সত্যি এসে পড়লে নাকি? তার কণ্ঠে বিস্ময়।
ভাবির ঘরের পুবদিকে কী আখের খেত?
সুমি আবেগ মাখানো কণ্ঠে বলল, তুমি কই? প্লিজ জান বলো আমাকে।
ওকে আর টেনশান না দিয়ে বললাম, ঘরের পেছনে।
সুমি বলল, তাড়াতাড়ি দক্ষিণ দিকের কামরাঙা গাছ বরাবর জানালার কাছে আসো।

এটা বলেই ফোনের লাইনটা সে কেটে দিল। আমি জানালার কাছে হাত রাখতে না রাখতেই সুমি তার কোমল হাতে আমার হাতটা ধরে ফেলল। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না, নির্বাক দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইল। আর আমি চাঁদের আলোয় ওর হাসিমাখা মুখটি দেখে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেললাম। কিছুক্ষণ পরে তার ডাকে স্বাভাবিক হলাম।
ভিতরে আসো।

রুমে ঢুকতেই সুমি পরম মমতায় আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ভোর হওয়ার অনেক আগেই আবার বাড়িতে চলে এলাম।

আজ সে সুমি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে, ভুলে গেছে পবিত্র ভালবাসার কথা! তের বছর হতে চলছে, তার সাথে কথা হয় না। দেখা তো দূর কী বাত। ভাবির কাছে শুনেছি, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছে। দোয়া করি, সে যেন সবসময় সুখেই থাকে। তবে সেই চাঁদনি রাতের হাসিটা এখনো আমি ভুলিনি আর আমৃত্যু ভুলতেও পারবো না।