
আয়নায় মুখ নয়, দেখা যাবে ভেতরটাও
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৪, ২০১৮
আয়নার সামনে বসে আছেন। দেখছেন নিজেকে। এ দেখায় একটু ফাঁকি আছে। আয়নায় যা দেখছেন, তা আপনার বাইরের রূপ। ভেতরটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। আপনার ভেতরও একজন মানুষ আছে। সে মানুষটা বাইরের মানুষটার থেকে একদম আলাদা। আপনার ভেতরের মানুষটা খুব নীরবতার মধ্যে থাকে। ওই মানুষটার ভালোলাগায় আপনার ভালো লাগে। খারাপ লাগায় আপনার খারাপ লাগে।
আপনার ভেতরে যে মানুষটা আছে, সে বাইরের এই পৃথিবী থেকে খুব একা। আপনার মধ্যে ওই মানুষটা জগতের কাউকে তার অনুভূতির কথা বোঝাতে পারে না। আর তাই সে একা একা থাকে। একা একা তার মতো সে গড়ে নেয় এক জগৎ, যা আপনার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে তৈরি। আর তাই আপনার ভেতর ওই মানুষটার জগৎটাকে বলা যেতে পারে আকাঙ্ক্ষার জগৎ।
আকাঙ্ক্ষার জগতে প্রতিটি মানুষই একা। খুব একা। কী রকম? তবে বলছি শুনুন। দূরপাল্লার কোনো বাসযাত্রায় রাতের বেলায় যাচ্ছেন আপনি। টিকিট কেটে বাসে উঠে দেখলেন, আপনার পাশে সুন্দরী এক মেয়ে বসে আছে। আপনিও বসে পড়লেন আপনার সিটে। ওই মেয়েটির পাশে। যেতে যেতে চাঁদের রহস্যঘেরা আলো রাস্তার গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে এসে পড়ছে মেয়েটির সুন্দর চকচকে মুখের ওপর।
আপনার ভালো লাগছে। এ সৌন্দর্য দেখে যে কারোরই ভালো লাগে। এরপর যদি আপনি তার হাত ধরেন তো আপনার গণপিটুনি খাওয়ার নিশ্চয়তা যে কেউই দেবে। কিন্তু আপনি যদি আপনার আকাঙ্ক্ষায় মেয়েটিকে নিয়ে কোনো এক নদীর তীরে সারারাত কাটিয়ে দেন, তাহলে কিন্তু আপনাকে কেউ গণপিটুনি দিতে আসবে না। অথচ বাস্তবে যেরকম তৃপ্তি আপনি পেতেন তা আপনি নিতে পারছেন আপনার আকাঙ্ক্ষার জগতে।
মানুষের আকাঙ্ক্ষার এই জগৎ ভয়ংকর। খোলা চোখে যারা জগৎ-সংসার দ্যাখে, তাদের কাছে এ জগৎ সেভাবে ধরা নাও দিতে পারে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সুতো ধরে একটু এগোলেই ধরা পড়বে ভয়ংকর এ চেহারা। একটা মানুষ আপনার আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। দীর্ঘদিন ধরেই চলছে-ফিরছে। একদিন হঠাৎ দেখলেন, সেই মানুষটা এমন এক কাজ করছে যা আপনি কখনো কল্পনাও করতে পারেননি।
আপনি কল্পনা করতে না পারলেও ওই মানুষটার ভেতর এই চেহারা ছিল। আপনার আয়নার ওই মানুষটাকে আপনি যেরকম দেখতে পেতেন, সে আসলে তা না। এটা বোঝার পর মৃত্যু ঘটে সম্পর্কের। মানুষের সমাজে হরহামেশাই ঘটছে এ ঘটনা।
‘যখন আঁধার যখন কুয়াশা’ নামে বছর সাতেক আগে একটি উপন্যাস লিখি। এটি প্রকাশ করে অনুপ্রাণন প্রকাশনা সংস্থা। বইটি আমার রক্তাক্ত আত্মজীবনী। আয়নায় যেরকম আপনার বাইরের চেহারা দেখা যায়, এ কাহিনি পড়তে পড়তে আপনিও সেরকম নিজের ভেতরটা দেখতে পাবেন। পড়তে পড়তে খুলে যাবে আপনার ভেতরের চোখ। অনুভূতি কেঁপে উঠবে, আর চিড় ধরবে আপনার চিন্তায়।
এ রচনা এমন এক সময়ের, যখন আমার সামনে সম্পর্কের আড়াল একটার পর আরেকটা ভেঙে যাচ্ছে। বেরিয়ে পড়ছে পরিচিত মানুষের মধ্যে থেকে অপরিচিত মানুষ। ওই মানুষটার নানা রঙের ছলাকলা মুখোশ। এতদিন যে সব মুখোশ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে থাকতাম।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কে এত ফাঁকি যে, তা নিতে গিয়ে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে। ওই সময়, যখন লিখছি এ রচনা, রক্ত ঝরছে আমার দেহ থেকে। আর আমি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে লিখে যাচ্ছি মানুষের আড়াল ভাঙার গল্প, যখন আঁধার যখন কুয়াশা। এই লিখে যাওয়া ছিল আমার নিয়তি। লিখে ওঠার পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আমি মদ্দিমাঠের একা একটি গাছের ছায়ার মতো একা একা থাকি। একা একা বেঁচে থাকি।