
অলঙ্করণ: বদরুল হায়দার
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ৭
প্রকাশিত : জুন ২১, ২০২৫
এসএসসি পরীক্ষার পর আমার জীবন খুব দ্রুত বদলে যেতে লাগলো। একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করি, যেটি পরবর্তীতে ‘একাকী নক্ষত্র’ শিরোনামে পল্লব পাবলিসার্স থেকে বই আকারে প্রকাশ হয়। এই উপন্যাসের নায়ক চারু হায়দারের জীবনে যা যা ঘটেছে পরবর্তী দশ বছর ধরে আমার জীবনে প্রায় তা-ই ঘটেছে। বলতে পারেন, এটি ছিল আমার মেনিফেস্টেশন বা ভবিষ্যৎ-আত্মজীবনী।
ঠাটারি বাজারের বিসিসি রোডে আব্বার খালুর বাসা, মানে আমাদের দাদার বাড়ি। নিজের দাদাকে কখনোই দেখিনি, ঠাটারি বাজারের দাদাকেই আপন দাদা জেনে বড় হয়েছি। তিনি আবার আব্বা-আম্মার বিয়ের উকিল বাপ হয়েছিলেন। ফলে আমার আম্মাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন। ঘটা করে নাইওর নিতেন। দাদার প্রথম সংসারে ৩ মেয়ে ও এক ছেলে। তারা থাকত বাসাবোতে একটি টিনশেড বাড়িতে। দ্বিতীয় সংসারে ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে, তারা ছিল ঠাটারি বাজারের বাড়িতে।
ঠাটারি বাজারের বাড়িটা ছিল অদ্ভুত। রাস্তার ওপর দুটি দোকান, একটি হিল টপ টি, যেটি ছিল দাদার ভাই পেরন মিয়ার দখলে, অন্যটি মিষ্টির দোকান ও বেকারি, বিখ্যাত সোসাইটি বেকারি। বেকারির ওপরে, দোতলায় ছিল দুটি রুম, সেগুলো ছিল দাদার দখলে, হিলটপটির পেছনে একটি ঘর, পুরো ছাদ ও বাড়ির ভেতরে একটি লম্বা টিনশেড, এগুলোও ছিল দাদার দখলে। আমার ধারণা, এই বাড়িটি কোনো অবাঙালির সম্পত্তি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরে সবাই যে যার মতো দখল করেছেন, অথবা নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছেন।
দাদাকে সবাই শিশু মিয়া বলে ডাকত। তার পোশাকি নাম ছিক কাজী ইয়াসিন। এই নাম আমি কী করে জানলাম তারও মজার ঘটনা আছে। তিনি ছিলেন রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার, এছাড়া তার ছিল রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। নবাবপুর রোডের ওপর অবস্থিত বিখ্যাত হোটেল আরাফাতের মালিক তিনি। জগন্নাথ কলেজের সামনে হোটেল আমানিয়া নামে আরো একটি রেস্টুরেন্ট করেছিলেন কিন্তু ছাত্রদের অত্যাচারে সেটা চালাতে পারেননি। ঠাটারি বাজারের মধ্যে ছিল তার গুড়া চায়ের দোকান ডন টি।
দাদার ছোটো দুই ছেলে সগীর ও মনির আমার কাছাকাছি বয়সের, সগীর ৬ মাসের ছোটো ও মনির ২ বছরের ছোটো। ওরা পড়ালেখায় বেশ পিছিয়ে ছিল। কোনো কারণে ওদের লজিং মাস্টার খুরশিদ সাহেব রাগ করে চলে যাওয়ায় দাদার কড়া নির্দেশ, কলেজে ভর্তি হওয়ার আগপর্যন্ত আমি যেন ঠাটারি বাজারে গিয়ে থাকি এবং সগীর ও মনিরের পড়াটা দেখিয়ে দেই। মূলত ওরা যেন একটু ডিসিপ্লিনের মধ্যে থাকে, সেই চেষ্টা করাই হবে আমার কাজ। সগীর কিছুটা ভদ্র হলেও মনির ছিল গাছের বান্দর। আমরা তিনজনই তিনজনকে তুমি করে বলতাম।
আমি স্থায়ীভাবে ওই বাড়িতে উঠেছি, এটা সগীর ও মনিরের জন্য ছিল একটা উৎসবের আনন্দ। শিক্ষক নয়, ওরা একজন বন্ধু পেয়েছে। আমিও মনে মনে ভাবলাম বন্ধু হয়ে যদি ওদেরকে কিছুটা মানুষ করা যায়, দেখি না চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে ওদেরকে আমি মানুষ বানাতে পারিনি বরং আমি নিজেই কিছুটা অমানুষ হয়ে ফিরে এসেছি। ওরা আমাকে জোর করে সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছে, প্রতিদিন প্রায় এক প্যাকেট সিগারেট খেয়েছি। শুধু সিগারেটে টান দিলেই হবে না, নিশ্চিত করা হতো ধোয়াঁটা পেটের ভেতরে যাচ্ছে কিনা।
সগীর ও মনির দুই ভাই কাড়াকাড়ি শুরু করে দিল আমি কার সঙ্গে সময় কাটাবো। দুজনের রুচি ছিল ভিন্ন। সগীর সারাদিন বেবিট্যাক্সি নিয়ে এ-মহল্লা, সে-মহল্লা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতো, বাইক চালাত। মনির পছন্দ করত সাইকেল চালাতে, মারামারি করতে, বেগম বাজারে গিয়ে ভিসিআরে সিনেমা দেখতে। আমি প্রায়শই ওদের দুই ভাইয়ের কাড়াকাড়ির মাঝখানে পড়ে বিপদগ্রস্ত হতাম।
এক পড়ন্ত বিকেলে, কিছুটা মেঘলা আকাশ, মনির আমাকে ছাদে টেনে নিয়ে গেল। কী একটা নাকি দেখাবে। দোতলার যে ঘর দুটো, সেগুলোর ছাদে ওঠা খুব ঝুকিপূর্ণ ছিল। সিঁড়ি ছিল না, অন্য অংশের রেলিংয়ের ওপর উঠে দেয়াল বেয়ে লাফ দিয়ে উঠতে হত। ওরা অভ্যস্ত, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যায়, ভয়ে ভয়ে আমিও উঠি। তিনতলার ওপরে উঠে মনির কার্নিশে বসে এবং আমাকেও বসতে বলে। এরপর আমাকে বসিয়ে রেখে ও উঠে দাঁড়ায়। পকেট থেকে লাল টেপে মোড়ানো একটা চৌকোনো বস্তু বের করে। আমি বলি এটা কী?
ককটেল।
বলো কী। তাড়াতাড়ি পকেটে রাখো।
মনির হাসতে হাসতে ওটাকে ওপরের দিকে ছুঁড়ে মারে এবং লুফে নেয়। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কার্নিশের নিচে ব্যস্ত বিসিসি রোড। যদি হাত ফসকে পড়ে তাহলে বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। যদি এখানেই ফুটে যায় তাহলে তো আমরা দুজনই শেষ। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলা ওদের দুই ভাইয়ের নিত্য দিনের ঘটনা। পরবর্তীতে কাপ্তান বাজারের এক দুর্ধর্ষ ত্রাসের নাম হয়ে ওঠে মনির। আমি মনিরের লোক এই কথা বললেই ঠাটারি বাজারের সব দোকানি চাঁদা দিয়ে দিত। ওদের চাচাত ভাই হোসেন ছিল ওদের লীডার, কাপ্তান বাজার এলাকায় ওদের ছিল আলীশান এক চারতলা বাড়ি।
সগীর ছিল কিছুটা ভীতু প্রকৃতির কিন্তু হোসেনের সঙ্গে সঙ্গে থাকত। একদিন আমিও ওদের সঙ্গে বিসিসি রোডে হাঁটছি। সগীর দল থেকে একটু পিছিয়ে পড়ে আমাকে টেনে ধরে। বলে, তোমার হাতটা দাও। আমার হাতটা ওর কোমরের কাছে রাখা কিছু একটাতে ধরিয়ে দেয়। আমি বুঝতে পারি বস্তুটা একটা আগ্নেয়াস্ত্র। সগীর আমাকে নিশ্চিত করানোর জন্য জামাটা সরিয়ে বাটটা দেখায়। এই ঘটনার পরে আমি কাউকে কিছু না বলে, কাপড়-চোপড় রেখে, ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসি।
যে সময়টা ছিলাম এর মধ্যে অন্তত দু`বার দাদা আমাকে দিয়ে তার ঠিকাদারি ব্যবসায়ের ওয়ার্ক-ইন-প্রোগ্রেস বিল বানিয়ে নিয়েছেন। তখনই কাগজ-পত্রে তার পোশাকি নামটা দেখি। আমি হিসাবটা খুব দ্রুত ও সুন্দরভাবে করতে পারায় তিনি বলেন, তোর চাচারা তো কেউ মানুষ অইত না। এই ব্যবসাটা আমি তরেই দিয়া যামু, তুই কৈলাম থাকিস, যাইছ গা না।
জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাই বিফলে যায় না। পরবর্তীতে বাড্ডার একজন ঠিকাদার তার হিসাবরক্ষকের অনুপস্থিতিতে আমাকে দিয়ে বেশ কয়েকবার তার প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্ক-ইন-প্রোগ্রেস বিল তৈরি করিয়েছেন। প্রত্যেকবার বিলটা বানিয়ে দিলেই তিনি আমাকে একশো, দেড়শো টাকা সম্মানি দিতেন। মাস্টার্সে পড়ার সময় এই ধরনের অংক করতে গিয়ে আমার অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে, দ্রুত অংকগুলো শিখে ফেলতে পেরেছি।
মনিরের আরো একটা নেশা ছিল, বেড়ানোর নেশা, দূর দূরান্তে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে চলে যেত। সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যেত। ওর এই অভ্যাসটা আমার খুব ভালো লাগত। যখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন একবার আমাকে নিয়ে যায় গাজীপুরে। ওর বড় আম্মার প্রথম সন্তান আমাদের রোকেয়া ফুপু। তার স্বামী সম্ভবত একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। গাজীপুরে একটি নির্জন দোতলা বাংলোতে থাকতেন তারা। তাদের বড় মেয়ে রুবী দশম শ্রেণির ছাত্রী, আমার চেয়ে এক ক্লাস ওপরে পড়ত।
ওদের বাড়িটাকে আমার কাছে মনে হয়েছিল স্বর্গ। এমন সুন্দর বাড়ি দূর থেকে দেখেছি, সিনেমায় দেখেছি, কখনো ভেতরে ঢোকার সুযোগ হয়নি। বারান্দার টবে রজনীগন্ধা, হাস্নাহেনা ফুটে আছে। বাড়ির সামনেও ফুলের বাগান। আমরা দুপুরে খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেই। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি স্বর্গে একজন অপ্সরা হাঁটাহাঁটি করছে। অপ্সরার নাম রুবী। বারান্দার চেয়ারে বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রুবীর সঙ্গে কয়েক মিনিট সময় কাটিয়েছিলাম। একটা ডিভাইন ফিলিংস অনুভব করছিলাম। জীবনে এই প্রথম অন্যরকম এক ভালোলাগা বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে। শুধু যে একটি মেয়ের প্রতি ভালোলাগা তাই নয়, নিজেকেই যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিল, পৃথিবীকে অনেক বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিল।
সুন্দরের সান্নিধ্য ও স্পর্শ মানুষের হৃদয়ে কল্যাণের আলো জ্বেলে দেয়, তখনই টের পাই। রুবীর মুখশ্রীটা ছিল অনেকটা বিপাশা হায়াতের মতো, ধারালো, গায়ের রঙ ছিল ভীষণ উজ্জ্বল, আর ও ছিল বেশ লম্বা, মেদহীন শরীর। জানালার গ্রিল ঠেলে শেষ বিকেলের আলো এসে যখন ওর মুখে আছড়ে পড়ছিল তখন এক অপার্থিব সৌন্দর্যে অবগাহন করছিল পৃথিবী। প্রস্ফুটিত রজনীগন্ধার পাশে এক সুন্দরী নারী বসে থাকলে তখন ফুলের গন্ধটাও অন্য এক উচ্চতায় উঠে যায়।
কাঞ্চনে থাকতেন মনিরের আরেক বড়ো বোন জ্যোৎস্না ফুপু, তার স্বামী ছিলেন বাওয়ানী জুট মিলের অফিসার। তাদেরও সুন্দর কোয়ার্টার ছিল। জ্যোৎস্না ফুপুর ছোটো ছোটো দুটি মেয়ে আঁখি এবং মুনা ফুটফুটে দুটি খরগোশ শাবকের মত ছোটাছুটি করত। কাঞ্চনে বেশ কবার গিয়েছি এবং একেকবার গেলে অনেক দিন থাকতাম। ওখানে ঠিক সময়ে খাওয়া, গোসল করা, ঘুমুতে যাওয়া এই ডিসিপ্লিনগুলো আমার দারুণ ভালো লাগত, যেটা ঠাটারি বাজারে ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত। ঠাটারি বাজারের বাড়িতে কোনো কোনো দিন দুপুরে কম করে হলেও ১৫/১৬ জন অতিথি থাকত, মাঝে মাঝে খাবারে টান পড়ত, আবার রান্না বসাতে হত, দেখা যেত আমাদের খেতে খেতে বিকাল ৪টা হয়ে গেছে। রাতে ঘুমানোরও কোনো ঠিক নেই। রাত দুইটায় এক দল অতিথি এসে হাজির, কাজেই আমাদের ডেকে তুলে অন্যঘরে পাঠানো হচ্ছে, এইসব উল্টাপাল্টা জীবন-যাপনে আমি খুবই বিরক্ত হতাম। চলবে