অলংকরণ: আহসান হাবিব

অলংকরণ: আহসান হাবিব

কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ৮

প্রকাশিত : জুন ২২, ২০২৫

ঠাটারি বাজারের দাদার বাড়িটা ছিল প্রকৃতপক্ষে আমাদের আরেকটা বাড়ি, স্থায়ী একটা আশ্রয়স্থল। আমার আব্বা পিতা-মাতা হারিয়ে কিশোর বয়সে ঢাকায় চলে আসেন। শিশু মিয়া দাদার আশ্রয়েই কৈশোরোত্তীর্ণ কাল থেকে ক্রমশ তার যৌবন বিকশিত হয়। তিনিই আব্বাকে বিয়ে করান, ব্যবসা শেখান। বলা যায় আব্বাও ছিলেন তার আরেকটা ছেলে। দাদার ছেলে-মেয়েরা, সকলেই, তখনও এবং এখনও আব্বাকে বড় ভাই হিসেবে সম্মান করতেন এবং করেন। বিয়ে করে আব্বা কেএমদাস লেনে আলাদা একটা বাসা নিয়েছিলেন বটে কিন্তু আসল ঠিকানা তার বহুদিন পর্যন্ত ৯ বিসিসি রোডই ছিল।

ঈদের দিন নামাজ পড়েই আমরা ওই বাড়িতে চলে যেতাম। কখনো আব্বা আলাদা করে কোরবানি দিতেন না। কোরবানির ঈদের দিন সকাল থেকে সারাদিন ঠাটারি বাজারের বাড়িতেই কাটাতাম। দাদা দুইটা গরু কোরবানি দিতেন, সব মাতুব্বরি আব্বার হাতে, কার কী দায়িত্ব তা ঠিক করে দেয়া, কাটাকুটি করা, মাংস ভাগ করা, গরিবদের দেওয়া, আত্মীয়দের দেওয়া ইত্যাদি সব আব্বাই করতেন। রাতে আমরা আমাদের ভাগের মাংস নিয়ে বাসায় ফিরতাম। বাড্ডায় এসে, যখন আমি একটু বড় হলাম, তখন বলি, আব্বা, ঈদের দিন আর ঠাটারি বাজারে যাব না, আমরা আলাদা কোরবানি দেব। আব্বা বলেন, তোমার দাদা একা সামলাবেন কী করে? প্রথম প্রথম এমন হয়েছে, আমরা বাড্ডায় ভাগে কোরবানি দিয়েছি কিন্তু আব্বা চলে গেছেন ঠাটারি বাজারে। দুই, তিন বছর এমন হওয়ার পরে আস্তে আস্তে আব্বা ওখানে যাওয়া বন্ধ করেন।

ঠাটারি বাজারের স্মৃতিগুলো ভীষণ উজ্জ্বল এবং আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুরনো ঢাকার বাড়িগুলো ছিল গায়ে গায়ে লাগানো। এক শীতের দুপুরে মনির হঠাৎ আবিস্কার করে ছাদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে যাওয়া যায়, এভাবে লাফাতে লাফাতে ছাদ থেকে ছাদে হেঁটেই আমরা অনেক দূর চলে যেতে পারি। আসলে আমরা এটা শিখি বানরদের কাছ থেকে। রোজ বিকেলে আমাদের ছাদে একদল বানর আসত। কখনো পুরো পরিবার পরিজন নিয়েই চলে আসত। কোলে ছোটো বাচ্চাও থাকত। ওদের পেছনে ছুটতে গিয়েই আমরা ছাদ-হাঁটা শিখে ফেলি।

এরপর থেকে এটা আমাদের একটা খেলা হয়ে গেল। একদিন এভাবে লাফাতে লাফাতে মাইলখানেক দূরে, বনগ্রামে চলে যাই। এবং এক সময় এক বাড়ির ছাদ থেকে বনগ্রামের একটি গলির ওপর লাফিয়ে পড়ি। গলির ভেতরে তখন কয়েকজন কিশোরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। ওদের প্রায় পায়ের ওপর আকাশ থেকে দুই কিশোর দুদ্দাড় করে পড়ে। ওরা তো অবাক। আকাশ থেকে মাঝে মধ্যে ঢিল এসে পড়ে, আহত পাখি পড়ে কিন্তু মানুষ! মেয়েগুলো ভয় পেয়ে দৌড়াতে থাকে এবং কিছুদূর গিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়ত ওরা দুজন উড়াল মানবের ভগ্ন ডানাগুলো খুঁজছিল। মনির লাফ দিয়ে উঠে জোরে একটা ধমক দিয়ে বলে, ওই গেলি... মেয়েগুলো যেন এতক্ষণে স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে আসে।

আবে মাইনসের পোলাপাইন!
আমরা তখন উঠে এক দৌড়।
এইরকম হাজারো দুষ্টামির গল্পে ঠাসা ঠাটারিবাজারের কৈশোর। বিকেল হলেই আমরা সবাই ছাদে উঠে যেতাম। চেয়ার পেতে, পাটি বিছিয়ে সবাই বসে বসে আড্ডা দিতাম। ছাদের এই আড্ডাটা আম্মা ও দাদি খুব উপভোগ করতেন। আমাদের ঘিরে একদল বুনো বানরও এই আড্ডা উপভোগ করত। তখন বানরদের জীবন-যাপন, এবং বাঁদরামো নিয়ে নানান গল্প শুরু হতো। দাদির কাছে একটা গল্প প্রায়ই শুনতাম। এই পাড়ারই একটি বাচ্চা চুরি হয়ে যায়। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, ঘর থেকে ঘুমন্ত বাচ্চা কোথায় গেল? সারাদিন খোঁজাখুঁজি করে কোথাও পাওয়া গেল না। বিকেলের দিকে একটি বুড়ো বানর বাচ্চাটিকে কোলে করে এনে ছাদের কার্নিশে বসে আছে। বাচ্চার বাবা এক কাদি কলা উপঢৌকন দিয়ে বাচ্চাটিকে ফেরত পায়। এখনো জানি না এটা কী সত্যি গল্প না কেউ বানিয়েছে।

হেলে পড়া দুপুর থেকে রাত অব্দি ছাদে আড্ডা চলত। রাস্তার উল্টোদিকে ছিল স্টার কাবাব, ওখান থেকে একটু পর পরই মোগলাই আসত, ডালপুরি, সিঙ্গারা, কাবাব আর মালাই ভাসা দুধ চা আসত। সোসাইটি বেকারি থেকে পেটিস, পেস্ট্রি আসত। রাস্তার মাথায় ছিল মরণ চাঁদ মিষ্টির দোকান, ওখান থেকে মিষ্টি আসত।

তখন স্টার কাবাব খুব পুরনো ধাচের একটা রেস্টুরেন্ট ছিল, অনেক পরে এর আধুনিকায়ন করা হয়। দাদার হোটেল আরাফাত ছিল একটা ক্যাশ কাউ। ওখান থেকে প্রতি মাসে তখনকার দিনেই তিন লাখ টাকার বেশি মুনাফা আসত। দুই হাতে উড়িয়েও শেষ করা যেত না। এছাড়া দাদার ঠিকাদারি, চা-পাতার দোকানের আয় এইসব তো ছিলই। এই অফুরন্ত অর্থপ্রবাহের কারণেই দাদার ছেলে-মেয়েদের কারোরই পড়ালেখা হয়নি। শুধু তার ছোটো মেয়ে হোসনা, আমার সামান্য একটু বড়ো, কলেজে গিয়েছিল। হোসনা ফুপু কলেজে পড়তেন বলে তার মধ্যে অন্যরকম একটা অহংকার ছিল। যেন তিনি এই বাড়ির কেউ না, অন্য কোনো জগৎ থেকে আসা একজন মানুষ। বাড়ির সকলেই তাকে একমাত্র শিক্ষিত মানুষ জ্ঞান করে অতিরিক্ত ভক্তি, শ্রদ্ধা করত কিংবা সমীহ করত। এই শিক্ষাটাও হয়ত আমি তখনই পেয়েছিলাম যে এডুকেশন খুব পাওয়ারফুল একটা জিনিস, সকলেই এই ক্ষমতাকে সমীহ করে।

১৯৮৮ সালের বন্যার সময় যখন আমাদের বাড্ডার বাড়িঘর তলিয়ে যায় তখন আমরা সবাই প্রায় আড়াই মাস ঠাটারি বাজারে দাদার বাড়িতে ছিলাম। কিছুদিন পরপর আব্বা এবং আমি এসে বাড়িটা দেখে যেতাম, পানি কমলো কিনা জেনে যেতাম। ছোটো দাদীর বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও তিনি যথেষ্ট যৌবনবতী এবং সুন্দরী  ছিলেন, তার বয়স তখন চল্লিশের শুরুর দিকে। দাদি খুব বাংলা সিনেমা দেখতে পছন্দ করতেন। আম্মা গেলেই দাদি সিনেমা দেখার আয়োজন করতেন। তখন সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যেতাম। অভিসার ও মধুমিতা হলেই বেশি যেতাম আমরা। গুলিস্তান, নাজ আমাদের পছন্দের তালিকায় ছিল না কারণ এই দুটি হলের পরিবেশ ততটা আরামদায়ক ছিল না। সেই সময়টাতে আমজাদ হোসেনের ভাত দে, বেলাল আহমেদের নয়নের আলো, চাষী নজরুল ইসলামের চন্দ্রনাথ প্রভৃতি সিনেমা দেখি। চলবে