
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ২৪
প্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০২৫
বিপদ একা আসে না, বউ-বাচ্চাসহ পুরো পরিবার নিয়ে আসে। বাড়ি বিক্রির ধাক্কা সামলে উঠতে পারিনি, জিন্সের প্যান্টের ওপর শাদা পাঞ্জাবি পরে আরেক বিপদ এসে হাজির। কালো চকচকে শশ্রুমণ্ডিত গাট্টাগোট্টা লোক, নাম শামসুদ্দিন। আব্বার কাছে টাকা পাবে কিন্তু অনেক দিন ধরে নাকি আব্বার দেখা পাচ্ছে না।
আম্মা বলেন, কত টাকা?
লোকটি একটি হাসি দিয়ে বলেন, খালাম্মা অনেক টাকা। এই যে দেখেন কাগজ, খালুজান সই করেই টাকা নিয়েছেন।
শামসুদ্দিন সাহেব একটি নুডুলস ফ্যাক্টরির মালিক। আমরা যখন পুরনো ঢাকায় থাকতাম তখন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের প্রতিবেশী ছিল। সেই সুবাদে তার স্ত্রী আম্মাকে খালাম্মা ডাকে, স্ত্রীর খালাম্মাকে তিনিও খালাম্মা ডাকছেন। ভদ্রলোকের বয়স আম্মার কাছাকাছিই হবে, এই বয়সের একটা লোক আমার আম্মাকে খালাম্মা ডাকছেন, শুধু তাই না টাকা ফেরত পাবার জন্য বেশ কঠিন কঠিন ভাষায় কথাও বলছেন, আমি কিছুতেই লোকটির আচরণ মেনে নিতে পারছি না।
অনেক দেন দরবারের পর আম্মা প্রস্তাব করেন, এখন থেকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি তার শাহজাদপুরের বাড়িতে গিয়ে ৫০০ টাকা করে দিয়ে আসবো। এভাবে তার ঋণ শোধ করা হবে। আমি যেহেতু অঙ্কে ভালো, মুখে মুখে অনেক জটিল অংক করে ফেলতে পারি, হিসেব করে দেখলাম মাসে ৫০০ টাকা করে দিলে তিন বছরেরও বেশি সময় লাগবে তার টাকা শোধ করতে। তিনি কি এত লম্বা সময় ধরে টাকা ফেরত নিতে রাজি হবেন?
তিনি রাজি হলেন। শুরু হলো আমার একটি নতুন যুদ্ধ। এখন আমি ৩টি টিউশনি করি, একটি থেকে পাই আড়াইশো টাকা, একটি থেকে দেড়শো আর একটি থেকে পাই দুশো। মোট ৬০০ টাকা আমার মাসিক আয়। সেখান থেকে প্রতি মাসে শামসুদ্দিনকে দিতে হবে ৫০০ টাকা। আমি মাসের শেষে টিউশনির শেষ বেতনটা পেলেই ছুটে চলে যাই শাহজাদপুরে, শামসুদ্দিন সাহেবের বাড়িতে। কখনো তিনি বাড়িতে থাকেন, কখনো থাকেন না। তিনি না থাকলে তার স্ত্রীর হাতে টাকাটা দিয়ে আসি।
তার স্ত্রী অতিরিক্ত সুন্দরী। মেয়েটির গায়ের রঙ এত ফর্সা যে, তার চোখের মনিতেও সেই ফর্সা রঙের পোচ এসে লাগে, ফলে তার চোখ হয়ে গেছে রুশ মেয়েদের মতো সবুজ। সবুজ চোখের আপার অনেকগুলো বাচ্চা, ঘরভর্তি তার বাচ্চাকাচ্চা, পেটেও একটি, আসি আসি করছে। গর্ভবতী অবস্থায় তার চলাফেরা করতে বেশ অসুবিধা হয়, এই শরীর নিয়েও মাঝে-মধ্যে আপ্যায়ন করেন, কেক, বিস্কুট খেতে দেন, খুব মজার দুধ চা বানান। তার হাতের দুধ চায়ের স্বাদ আমি আজও ভুলতে পারিনি।
এই যে আমি আমার আয়ের প্রায় পুরোটাই শামসুদ্দিন সাহেবকে দিয়ে দিচ্ছি আমার কিন্তু তাতে একটুও খারাপ লাগছে না। বরং আমার আনন্দ ও গর্ব হচ্ছে। পরিবারের ঘাড়ে চেপে বসা ঋণের এই বিশাল বোঝাটা আমি হালকা করতে পারছি, এটা এক বিরাট আত্মতৃপ্তি। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে শামসুদ্দিন-পরিবারের কাছে টাকাটা পৌঁছে দেবার জন্য আমার মধ্যে একটা সাংঘাতিক তাড়না অনুভব করি এবং টাকাটা পৌঁছে দেবার পরে দারুণ একটা প্রশান্তিতে মনটা ভরে যায়।
এভাবে প্রতি মাসে যেতে যেতে ওদের পরিবারের সঙ্গে একটা সখ্য গড়ে ওঠে। মাঝে-মধ্যেই নুডুলসের এক গাদা প্যাকেট দিয়ে দেন, সেগুলো আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে, আত্মীয়দের মধ্যে বিলিবন্টন করি। এভাবে দুই বছর নিয়মিত টাকা দিতে থাকি। এক মাসও মিস করিনি। একদিন টিউশনির শেষ বেতনটা পেতে অনেক রাত হয়ে যায়। আম্মার নির্দেশ ছিল আমি যেন টাকা নিয়ে কখনোই ঘরে না আসি, আগে ঋণ শোধ হবে, তারপর ঘরে ফিরবো।
বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় শামসুদ্দিন সাহেব আমাকে হেঁটে হেঁটে অনেকটা পথ এগিয়ে দেন। তখন তিনি আমাকে বলেন, বাদল, তোমার মতো এমন সুসন্তান আমি আমার জীবনে দেখি নাই। আমি আল্লাহর কাছে হাত তুলে সব সময় দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোমাকে অনেক বড় করেন।
এর কয়েক দিন পরে শামসুদ্দিন সাহেব এক গাদা ফলমূল নিয়ে আমাদের বাসায় এসে হাজির। তিনি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদে কেঁদে আম্মাকে বলেন, আমি খুব খারাপ মানুষ খালাম্মা। ছোটো একটা বাচ্চা ছেলে টিউশনি করে যা আয় করে তা আমি নিয়ে নেই। এই টাকাটা দিয়ে এই বয়সের একটা ছেলে আনন্দ করবে, নিজের জন্য ভালো জামাকাপড় কিনবে, সেই সুযোগটা সে পাচ্ছে না।
এরপর তিনি আমাদের অবাক করে দিয়ে বলেন, এখন থেকে আর এভাবে টাকা দিতে হবে না। বাকি টাকা যখন পারেন দিবেন। না পারলে দিবেন না।
শুধু তাই না, তিনি বরং উল্টো আম্মাকে বলেন, কোনো দরকার হলে আমাকে খবর দিবেন খালাম্মা, মনে করবেন, আমিও আপনার একটা ছেলে।
আমরা যারপরনাই অবাক হই তার কথা শুনে। প্রথম দিন এই লোকই টাকার জন্য খুব কঠিন কঠিন কথা বলেছিল আম্মাকে। এই সময়ের মধ্যে আম্মা ও আমি অনেক গবেষণা করে দেখেছি, এত এত টাকা দিয়ে আব্বা করেছেটা কী? কিন্তু কোনো কূল কিনারা করতে পারি নাই। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলে নীরব হয়ে যান, কোনো উত্তর দেন না।
আমার আব্বা-আম্মার মধ্যে একটা দারুণ ব্যাপার আছে। নিজেরা খুব ঝগড়া করবে কিন্তু আমরা কারো পক্ষ নিতে পারবো না। যদি কখনো দেখি, আব্বা তো ঠিকই বলেছেন, বরং আম্মাই ভুল বলছেন, তখন আব্বার পক্ষ হয়ে আম্মাকে কিছু বলতে গেলেই আব্বা রেগে যান। রেগে গিয়ে তিনি পুরো ইউটার্ন করে আম্মার পক্ষ নিয়ে নেন এবং আমাকে বকা দিতে থাকেন। তখন তারা দুজন এক পক্ষ হয়ে যান আমি হয়ে যাই তাদের প্রতিপক্ষ।
আবার আম্মা ঝগড়া লেগে আব্বাকে খুব বকাঝকা করেন ঠিকই কিন্তু পরে আমাদের কাছে এমনভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করেন যেন আব্বা একদম নির্দোষ, আম্মা অযথাই আব্বাকে বকেছেন। এটা তিনি এজন্য করেন যাতে আব্বার প্রতি আমাদের কোনো রাগ বা ঘৃণা না জন্মায়। তাদের দুজনের এই বিষয়টা আমার দারুণ ভালো লাগত।
এত এত ঋণের পরেও আব্বার প্রতি যাতে আমাদের ভালোবাসা একটুও না কমে সেজন্য আম্মার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। চলবে