আসামে জন্মেও ‘বিদেশি’ অপবাদে উচ্ছেদ বাঙালি মুসলিমদের

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০২৫

বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যে বাঙালি মুসলিমদের ঘরবাড়ি ভেঙে উচ্ছেদ করে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা এমন সময়ে ঘটছে যখন আসামে আগামী বছর শুরুতেই রাজ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি পুনর্নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রচার চালাচ্ছে।

সম্প্রতি আসামের গোলপাড়া জেলায় এক খোলা মাঠে নীল ত্রিপলের নিচে আশ্রয় নিয়েছে শত শত মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশু। যাদের বাড়ি সরকারি জমিতে ‘অবৈধভাবে’ বসবাসের অভিযোগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার মুসলিম পরিবারকে ঘরছাড়া করা হয়েছে।

আসামের এই অভিযানকে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ কর্মসূচি বলা হচ্ছে। এসব মুসলিমকে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিতাড়নের কাজ চলছে। বিশেষ করে, ২০২৪ সালের আগস্টে ঢাকায় ভারতঘনিষ্ঠ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকেই এই ধরপাকড় তীব্র হয়েছে।

গোলপাড়ায় উচ্ছেদের শিকার ৫৩ বছর বয়সি আরান আলি বলেন, “সরকার বারবার আমাদের হয়রানি করে। আমরা আসামের জন্মসূত্রে বাসিন্দা হয়েও আমাদের বিদেশি বলা হয়।”

ভারতের ৪০৯৭ কি.মি. দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে আসামেই রয়েছে ২৬২ কি.মি. সীমান্ত, যা বাংলাদেশ ঘেঁষা। আসাম বরাবরই অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের জন্য পরিচিত। অনেকের আশঙ্কা, বাংলাদেশ থেকে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধরনের বাঙালি অভিবাসীদের আগমন স্থানীয় সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে ‘দখল’ করে ফেলবে।

বিজেপির উগ্রপন্থি নেতা ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, “বাংলাদেশ থেকে অব্যাহত মুসলিম অনুপ্রবেশ ভারতের জাতীয় পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলেছে। আমরা সাহসের সঙ্গে এই অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি।”

তিনি দাবি করেন, “২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে আসামে মুসলিম অভিবাসীরা বর্তমানে প্রায় ৩০% জনসংখ্যা গঠন করে। কয়েক বছরের মধ্যে এই সংখ্যা ৫০%-এ পৌঁছে যাবে।”

২০২১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে শর্মার সরকার ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করেছে, যাদের প্রায় সবাই বাঙালি মুসলিম। এক মাসেই ৫টি অভিযানে ৩,৪০০টি বাঙালি মুসলিম পরিবারের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষক গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক প্রভীন দন্তি বলেন, “আইনগতভাবে বৈধ হলেও বাঙালি মুসলিমরা এখন ভারতের ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সহজ টার্গেট হয়ে উঠেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আসামের পুরনো জাতিগত জাতীয়তাবাদ বিজেপির ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশে গেছে। ফলে লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে বাঙালি ভাষাভাষী মুসলিমরা।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, “ভারত সরকার অভিবাসীদের হান্ট করার নামে হাজার হাজার অসহায় মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এটা আসলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বৈষম্যমূলক নীতির অংশ।”

ভারতের বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, বিজেপি ভোটের আগে ধর্মীয় মেরুকরণ তৈরি করতে এসব উচ্ছেদ ও বিতাড়নের পথ বেছে নিয়েছে। আসামের বিধানসভার সদস্য ও বিরোধী নেতা অখিল গগৈ বলেন, “এই পদক্ষেপগুলো বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভজনক।”

আসামের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ঘোষণা করেছে, তারা ক্ষমতায় ফিরে এলে উচ্ছেদ হওয়া বাড়িগুলো পুনর্নির্মাণ করবে এবং যারা সেগুলো ধ্বংস করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

কিছু রাজ্য বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর (পুশব্যাক) পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও কয়েকজনকে আবার ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। কারণ তাদের ‘বিদেশি’ ঘোষণা করার বিরুদ্ধে আদালতে আপিল বিচারাধীন ছিল।

আসাম সরকারের তথ্যমতে, রাজ্যের বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলো প্রায় ৩০ হাজার ব্যক্তিকে বিদেশি হিসেবে ঘোষণা করেছে। এদের অনেকেই বহু বছর ধরে ওই অঞ্চলে পরিবার ও জমিজমাসহ বাস করলেও দারিদ্র্যের কারণে আদালতে লড়াই করতে পারে না।

২০১৬ সালে নয়াদিল্লি ঘোষণা করেছিল, প্রায় ২ কোটি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ভারতে বসবাস করছে। শেষ ২০২৫ সালের মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ২,৩৬৯ জনের তালিকা তৈরি করেছে এবং ঢাকা সরকারকে দ্রুত যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ এবং শেখ হাসিনার পতনের প্রেক্ষাপটে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলো ‘অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার’ নামে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা আরও জোরদার করেছে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে হাজারও গরিব, প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষ।