কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ৩৫

প্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০২৫

এক বিকেলে আলাউদ্দিন কানের কাছে মুখ এনে আস্তে করে বলে, জহির ভাই, চলেন বিয়ার খাই।

সতর্ক পত্রিকা বিক্রি করে হাতে কিছু টাকা এসেছে। এখানে বলে রাখি, পত্রিকার সম্পাদক আমি হলেও মালিক কিন্তু আমি নই। আলাউদ্দিন হলো পত্রিকার মালিক। আয়-ব্যয়ের হিসাব ওর কাছে। আমি খুব কম বয়স থেকেই কোনো কিছুর মালিক হতে চাইতাম না। কিন্তু কাজ করতে চাইতাম। একটা ন্যাচারাল লিডারশীপ আমার মধ্যে শৈশব থেকেই ছিল। নেতৃত্বটা আমার ওপর অর্পিত হতো সবচেয়ে কঠিন ও জটিল কাজের দায়িত্ব নেবার কারণেই। দলগত কোনো কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্তটি দিতে পারার কারণেই নেতৃত্ব আমার কাছে চলে আসত। পাড়ার ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন আমি, ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন আমি অথচ আমি কিন্তু দলের সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড় নই।

নেতৃত্ব দেবার দক্ষতা আমার ছিল, কিন্তু মালিকানা বিষয়টা আমার একেবারেই পছন্দ হতো না। পরবর্তীতে কনক আর আমি ঢাকা শহরে প্রচুর সংগঠন করেছি, অনেক বড় বড় অনুষ্ঠান করেছি, প্রায় সব কাজ আমিই করেছি কিন্তু কখনোই টাকা তোলা ও ব্যয় করার দায়িত্বটি আমার হাতে নিইনি। কখনোই কোনো সংগঠনের প্রেসিডেন্ট কিংবা সেক্রেটারি হতে চাইনি।

তরুণ বয়সে সিদ্ধ কিংবা নিষিদ্ধ নতুন সব কিছুর প্রতিই একটা তীব্র আকর্ষণ থাকে। আলাউদ্দিনের এই প্রস্তাবে আমি দারুণ আগ্রহী হয়ে উঠি। তাই তো, একদিন চেখে দেখা দরকার বিয়ার জিনিসটা কেমন।

আমি শুনেছি হোটেল জাকারিয়ায় বিয়ার পাওয়া যায়, চলো একদিন যাই। কিন্তু নিশ্চয়ই অনেক দাম।
দাম কত জানেন কিছু?
সঠিক জানি না, তবে ১০০ টাকার কম হবে না।
ঠিক আছে চলেন যাই।
আচ্ছা, যাব একদিন।
একদিন না, এখনই চলেন।
এখনই?
হ্যাঁ, এখনই।

আমরা দুজন গুলশান ১ নম্বর গোল চত্বর থেকে ৬ নম্বর বাসে চড়ে মহাখালি টিবি গেইটে নামি। হোটেল জাকারিয়া একটি তারকা হোটেল। দুই তরুণ সেখানে বিয়ার খেতে যাবে, ওরা পাত্তা দেবে তো? আমরা বয়সে তরুণ হলেও, সম্ভবত আলাউদ্দিনের তখনও ১৮ বছর হয়নি, যথেষ্ঠ পরিণত আচরণ করা শিখে গেছি। নির্বাচিত এমপির বাসায় গিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছি, পৌর-ওয়ার্ডের চেয়ারম্যানের, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের, যিনি একজন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, সাক্ষাৎকার নিচ্ছি এবং এইসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কথা শোনেন, সাক্ষাৎকার দেন, কাজেই আমরা তো আর যেনতেন বালক বা কিশোর নই।

জামার কলার টেনেটুনে ঠিকঠাক করে দুজন ঢুকে পড়ি। একটি টেবিলে বসেই আলাউদ্দিন পায়ের ওপর পা তুলে দিল। ভাবটা এমন, বিয়ার, ওয়াইন এইসব তো আমরা রোজই খাই।

কালো প্যান্টের ওপর শাদা শার্ট এবং ফুলের মতো ছড়ানো বো-টাই পরা ভীষণ চৌকস এক ওয়েটার হাতে কাগজ কলম নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি বলি, দুটো বিয়ার দিন।

ভাগ্যিস তিনি জানতে চাননি কোন ব্র‍্যান্ডের বিয়ার দেবেন, তাহলেই আমাদের জারি-জুরি আর বিদ্যার দৌড় ফাঁস হয়ে যেত।

বিয়ার এলো। মুখে দিয়ে টের পাই, ভীষণ তিতা ও বিস্বাদ এক তরল। কিন্তু আমাদের মুখের অভিব্যক্তি যেন কেউ টের না পায় সেজন্য হাসি হাসি মুখে দুজন দুজনের দিকে তাকাই। বিয়ারের ক্যানে যা লেখা আছে তা ভালো করে পড়ে ফেলি। জার্মানির হেইনিক্যান বিয়ার, এলকোহলের পরিমান ৫ শতাংশ। এই তথ্যগুলো ভালো করে জেনে নিই এজন্য যাতে ভবিষ্যতে এই বিষয়ে দক্ষতা দেখাতে পারি এবং বন্ধুদের সঙ্গে ভাব নিয়ে কথা বলতে পারি।

খুব কষ্ট করে বিয়ার দুটো শেষ করি। বিল আসে ১৭০ টাকা। অর্থাৎ একেকটা বিয়ারের দাম ৮৫ টাকা। তখন ৮৫ টাকা কিন্তু অনেক টাকা। বাস ভাড়া ছিল ৩০ পয়সা, আমি শামসুর রাহমানের কবিতার বই কিনি ৩৫ টাকা দিয়ে, উত্তর বাড্ডায় এক কাঠা জমির দাম ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা।

বাইরে বেরিয়ে এসে আমরা দুজন বিজয়ের আনন্দে একটা লাফ দিয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি। সালাউদ্দিন নিষিদ্ধ জগতের মানুষ হলেও তখনো বিয়ার খায়নি, আমরা এরই মধ্যে এই নিষিদ্ধ বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছি, এই আনন্দে দুই কিশোর আত্মহারা।

সতর্ক পত্রিকায় মুস্তফা ফারুক একটি গল্প দেন। গল্পের নাম ফাল্গুনীর প্রেম। কিন্তু ছাপাখানার ভূত সেটিকে বানিয়ে দেয় ফাল্গুনীর মেপ্র। কাগজ ছাপা হওয়ার পরে আমরা ভয়ে আর ফারুক ভাইয়ের কাছে যাই না। কিন্তু তিনি কারো কাছ থেকে পত্রিকা পেয়ে গেছেন। কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু আমাদের কিচ্ছু বলেননি। অনেক দিন পরে যখন দেখা হয়, বলেন, ছাপাখানায় এইরকম ভুল হয়ই। এটা তো আর তোমাদের দোষ নয়। তোমরা যে এই বয়সে এত কষ্ট করে কাগজটা বের করছ সেটাই তো অনেক বড় কাজ।

ফারুক ভাইয়ের এই মহানুভবতা আমাদের মুগ্ধ করে। আমরা দুজনই তাকে পছন্দ করতাম, এই ঘটনার পরে আরো বেশি পছন্দ করতে শুরু করি। পরবর্তীতে, মানে অনেক বছর পরে, ফারুক ভাই একটি টিভি নাটক বানাতে চাইলে আমি ও আলাউদ্দিন তাকে অর্থের যোগান দিই এবং নাটক প্রচার হওয়ার পরে তিনি যথাসময়ে আমাদের টাকা ফেরত দিয়ে দেন।

একদিন জসীম উদদীন পরিষদের সাহিত্যসভা শেষ করে আমি ও আমিনুল হক আনওয়ার হেঁটে হেঁটে বাসায় যাচ্ছি। রাস্তায় এক যুবক আমাদের ধরে, আসলে হক সাহেবকে ধরে, আমরা ষোলোই ডিসেম্বর উপলক্ষে একটা ম্যাগাজিন বের করবো, আপনি আমাদের ম্যাগাজিনের জন্য লেখা দেবেন।

আমি সেই যুবককে চিনি না। তিনিও আমাকে চেনেন না। আমিনুল হক আনওয়ার বলেন, পয়সা দেবেন তো?

যুবক আমতা আমতা করছিল। তিনি বলেন, সম্মানি ছাড়া আমি কবিতা দেই না।
জি, সামান্য কিছু দেব।

যত সামান্যই হোক অসুবিধা নেই। কিন্তু সম্মানি দিতে হবে। এদেশের লোকেরা কবিদের সম্মান করতে শেখেনি। কবিদের সম্মান না করলে জাতির উন্নতি হবে না।

এইরকম একটা লেকচার দিয়ে তিনি সেই যুবকের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন, পরিষদের একজন প্রতিভাবান তরুণ কবি, ওর লেখাও নেবেন।
অবশ্যই। ভাই তুমিও লেখা দিও।

সেই রাতে বাসায় ফিরে ওদের ম্যাগাজিনের জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি কবিতা লিখি। কবিতার নাম ‘ইতিহাস’। কবিতাটি লিখি ১৯৮৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। সেই সময়ে লেখা প্রায় সব কবিতাই ফেলে দিয়েছি, এটিও ফেলে দেই দেই করে ফালাইনি, তৃতীয় কবিতার বই ‘দ্বিতীয়বার অন্ধ হওয়ার আগে’ গ্রন্থে রেখেছি। বইটি আউট অব প্রিন্ট হলেও বাংলা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘কবিতা সমগ্র’ প্রথম খণ্ডে ২২৭ পৃষ্ঠায় আছে। কবিতা সমগ্র এখনও বাজারে আছে।

আত্মজীবনীতে অনেক কবিতার কথাই আসবে, সেই কবিতাগুলো পুরোপুরি তুলে দিলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই পুরো কবিতা তুলে না দিয়ে কয়েক লাইন করে তুলে দেব। এই কবিতার শেষ চার লাইন এখানে উল্লেখ করছি:

মুক্তি পাগল সেই ছেলেরা
এভাবেই একদিন হলো লাশ
পাতাকাটা দিয়ে গেল আমাদের
ওরা হলো বাংলার ইতিহাস।

বাড্ডার সেই ম্যাগাজিনে এটি ছাপা হয় এবং ওরা খুব পছন্দ করে, ফলে ওদের জন্য পরের বছর আরও একটি মুক্তিযুদ্ধের কবিতা লিখি। চলবে