চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ২

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯

সেসময়টা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জার ছিল না। ভাগ্যিস ছিল না। কাগজে লেখা ভালোবাসার প্রতিটা হরফ ঝাপসা হতে হতে তবু থেকে গেছে তাই, গুঁড়ো হয়ে ফুরিয়ে যেতে থাকা হলুদাভ সৌজন্যে। উলটে পালটে দেখার প্রয়োজন হয়নি তেমন করে। অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়নি তবু। হারিয়ে ফেলার বা পুড়িয়ে ফেলার মতো ঔদ্ধত্য বা ঔদাসীন্য গ্রাস করেনি কোনোদিন। কিন্তু বোতাম টেপার সুযোগ থাকতো যদি, ইচ্ছে মতো কিছু লিখে দেয়া বা মুছে ফেলার সহজ একখানা অপশন, তাহলে কী হতো জানি না। ভালো হতো না মোটেই। কারণ, আমি তো ভুলে যাওয়ার মানুষ নই। মুছে ফেলারও মানুষ নই। তবু যান্ত্রিক অপশন মানুষের সামনে অনেকগুলো পথ বাতলে দেয়, থেকেও না থাকার কিংবা লিখেও মুছে ফেলার। সমস্তটাই ইথারে, এও এক আশরীর অশরীরী যাপন, নয়তো কি?

বানিয়ে বানিয়ে বাঁচা হয়ে ওঠেনি আমার কোনোদিন। আমার এই ত্রিশ অতিক্রান্ত মহীরূহ হতে চাওয়া জীবনের এতটুকু মাত্র বানানো নয়। আমার কোনো বানানো যাপন নেই। বানানো কবিত্ব নেই। বানানো মহানুভবতা নেই। বানানো ক্রোধ নেই। সবথেকে বড় কথা, আমার কোনো বানানো প্রেম নেই। ভাবা যায়! এই যে অস্থি মজ্জা মেদ রক্ত শরীর অতিক্রান্ত জীবন, আজানুলম্বিত বোধের ভারে নতমস্তক এই যে আমি, জল আকাশ কিংবা একাকিত্ব বোধক অতিপ্রাকৃতিক সংযোগে ক্রমশ মৃত্যুর আবাহন করে চলেছি যে এই অকারণ, এর পুরোটাই আসল? কোথাও এতটুকু `নাটক` নেই কেন আমার?

এই গোটা `আসল` একটা আমিকে নিয়ে রোজ রোজ নড়েচড়ে চলা বড় কঠিন। কারণ যা কিছু সত্য, যা কিছু শাশ্বত, যা কিছু অবশ্যম্ভাবী তা ছাড়া আমার বলার নেই আর কিছু। তাই যা বলি, সে কথারা কোন বিপন্নতার তোয়াক্কা করে না। বিপন্ন তো এই জীবন, প্রতিদিন যাকে ধারণ করছি নিজের ভেতর। কত ইচ্ছেরা মরে যাচ্ছে রোজ সামান্য আদর না পেয়ে, সেইসব সেরে উঠতে না পারা অসুখের মূল্যে সঞ্চয় করেছি যত কথা, হে বানানো সাহিত্যের দেবতা, তুমি তার কি মূল্য বুঝবে?

ইচ্ছে করে না মুছে দিতে তোমার লিখে পাঠানো এক এক পঙ্‌ক্তি। তবু মুছে দেই। কেন রাখবো বলো তোমায়? এ জীবন ভারাক্রান্ত, পারলে তাকে নাও। নাও এ আশরীর জমে ওঠা ফেনিয়ে ওঠা মদ। আমি ঘুমোতে চাই। আমার ঘুম ফুরোচ্ছে না কিছুতেই। ঠিক যেমন করে আমি ঘুমোতে চেয়েছিলাম, প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে গেছি রাত্রির উদ্বাহু জঠরে। এখন রোজ রাতে যে আসে, ফিরিয়ে দিতে হয় তাকে। কারণ একটাই, সে তো তুমি নও!

সে কি আমাকে ঘুম পাড়াতে পারবে? আনিদ্রা জাগরণের মধ্যে সে আমাকে টেনে নিচ্ছে একটু একটু করে। আমি পারছি না আটকাতে। এই তীব্র সুখ আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে অগম্য এক জীবনের কথা, অপার করুণায় কে আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল যেন দিনগত মোহে। অ্যান্ড আই কুড নট গেট ওভার ইট, এভার! অনন্য।

সে কি লিখে দিয়ে গিয়েছিল যেন? সেও এক দর্শন। এক জীবনপ্লাবী জলস্ফীতির কথা লিখেছিল সে। ভাগ্যিস কোনো বোতাম টিপে লেখা নয়, যা মুছে দেয়া গেলে দিতামই হয়তো নিমেষে। যে পাতাটি হলুদ হয়ে এসেছে ক্রমশ, পাক ধরেছে তার গোপন জবানবন্দির শিরোণামে, যাকে লেখা সেও জেনে গেছে এতদিনে সরল বালিকাটির মতো পড়ে থাকার সময় নেই আর অনুসন্ধিৎসু দরজায়, ফিরে গেছে সে মানুষও ন্যূব্জ গলিত সময়ের পাঁকে, তবু রয়ে গেছে সেই `অভিজ্ঞান`, স্থির জলাশয় ছুঁয়ে থাকা নুয়ে পড়া পাতাটির মতো—

শোক আসে মাঝে মাঝে
ধুয়ে দিতে মোহ
পৃথিবী ভাগের নেশা পাঁচ পুরুষের সঞ্চয়বাসনা
বৃদ্ধ পিতার ভার, আশ্লিষ্ট প্রেমের লাঞ্ছনা
শোক আসে মাঝে মাঝে।

বন্যা আসে মাঝে মাঝে
ভেঙে দিতে গৃহ
সচকিতে বলে দিতে অনিত্য সংসার
নতুন গাছের চারা নব কিশলয়
দেবতার ধন সব, মানুষের নয়
বলে দিতে, আকাঙ্ক্ষার পরিণতি এই
সব বিত্ত বলি দিয়ে এখানেই বসে থাকা
তাও বুঝি নয়
শোক আসে, বন্যা আসে, আপদ প্রলয়—

ভেঙে দিতে গৃহ
ধুয়ে দিতে মোহ।

লেখক: কবি