চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ২১

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ২৫, ২০১৯

ছোট থেকেই একটা কথা কানে এসেছে কানাঘুষোর ছলে, ‘ওর মা ওকে এসব শেখাইনি কিংবা ও মিশতে জানে না’। এসব অর্থে অন্তঃসারশূন্য ঠুনকো সামাজিকতা, ভালোবাসার নামে উপহারটি হাতে তুলে দিয়ে তারপর গোল হয়ে বসে পরনিন্দা পরচর্চা, মানুষের খুঁত খুঁজে খুঁজে দেখানো, ঢিপ করে পেন্নামটি ঠুকেই পিছনে গালাগাল, কিংবা ঠাকুরের সামনে হাত জোড় করে বসে চোখ টিপে টিপে দেখা যে রান্নাঘরে বেড়াল ঢুকলো কিনা!

না। নিজের তৈরি সিলেবাস আর নিজস্ব স্বতন্ত্র পাঠে সত্যিই শেখা হয়নি দ্বিচারী মানুষের সাথে মেলামেশার পাঠ। সেই কারণেই আমি একা ও একাকিত্বে সহজীভূত। সেই কারণেই আমার খোঁজ সমুদ্রে মুক্ত খুঁজে বেরানোর মতোই দুর্গম, ও স্বচ্ছ। এই আপনারা যারা ভীষণ ভালোবাসার দাবি ও অধিকার নিয়ে কেবল আমাকে বিদ্ধ করে এসেছেন এতদিন, তাদের বলি, আপনাদের মতো সহজ সস্তা ভালোবাসা কিংবা তার চেয়েও সহজতর অবহেলায় নিজেকে লুটিয়ে দেয়ার কোনো অভ্যাস আমার নেই।

বিশ্বাস করা আর বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার মধ্যে অনেক ফারাক আছে। যেমন আছে সমাজে বেঁচে থাকা আর সামাজিক জীব হয়ে ওঠার মধ্যে। আর এই মাঝখানের পথটা মিথ্যাচারে ভরা। খুব কম মানুষই আসলে পরস্পরের হয়। বাকি বেশিটাই তো ভান। নিরুপায় হয়ে থেকে যাওয়া। যত এই সিস্টেমকে গভীর থেকে চিনেছি তত বুঝেছি, সত্যিই এ আমার জন্য নয়। কারণ এত এত মিথ্যাচারের মধ্যে জলভাত হয়ে বেঁচে থাকা বড় কঠিন। কে কাকে ঠকায় না বলুন তো? স্বামী স্ত্রীকে? মা ছেলেকে? বন্ধু বন্ধুকে? আসলে এই সিস্টেমের মধ্যে খাপ খাওয়াতে খাওয়াতেই মানুষ দ্বিচারী হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন উনুনে বসালে জল ফুটে ফুটে বাষ্প হয়, ঠিক তেমন।

তাই ভাবি, ভাগ্যিস, তেমন করে শিখে ওঠা হলো না কিছু। তাই তো তাদের মতোও হয়ে ওঠা হলো না নিজের ভেতরের অজস্র অন্ধকারের নাগপাশে জর্জরিত যারা অকারণেই অন্যকে টেনে ধরে নামাতে ব্যস্ত চিরটাকাল। আমার তো সেই মনটাই নেই। বেশিরভাগ বেঁচে থাকাটাই একটি অদৃশ্য দৃশ্যপটের মতো অনির্দিষ্ট দূরত্বে গেঁথে থাকে আজকাল। ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠার অভ্যাস আমার চিরায়ত।

মনে মনে, কোনো এক পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে পড়ে থাকি। অভিমানী বালক যেন। এ সমাজ এ জীবন আমার নয় আমার নয়। অথচ এই মানুষ যেখানেই গিয়ে পড়ুক না কেন সেখানটাই নিজের মতো বানিয়ে নেয়। নিজের মতো প্রশ্নহীন কেবল যার কলেবরটাই আছে।

আরে আমাকে ছাড়রে বাপু। আমি চললাম ঝোলা নিয়ে। সুদূরে অন্তরীক্ষে কোথাও এই চলে যাওয়ারও কোনো ছাপ থাকে না যদিও। সেখানে কেবলই এক নৈঃশব্দ্যের শব্দে বুঁদ চিরপ্লাবী সময়ের পাতা ঝরে পড়ে। চলবে

লেখক: কবি ও গদ্যশিল্পী