তর্কবাগীশ উপাধি মোটেও সাধারণ অর্থ বহন করে না

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৭, ২০২৪

১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি। চলনবিল অঞ্চলের উল্লাপাড়ার সলঙ্গার হাট বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। কিন্তু এ আন্দোলন ছিল অহিংস। অহিংস-অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে সেদিন সলঙ্গার হাটে তিলঠাঁই পর্যন্ত ছিল না। লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার মানুষ এই ছোট্ট হাটে জড়ো হয়েছে স্বাধিকার চেতনায়। আন্দোলনে উত্তাল উত্তরবঙ্গের সুবিখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা হাটে বৃটিশবাহিনী সেদিন ইতিহাসের বর্বরতম হামলা চালায়। গণহারে হত্যা করে হাজার-হাজার মানুষ। সেদিন অগণিত লাশের গণকবর দেয়া হয় সিরাজগঞ্জের রহমতগঞ্জে।

যদিও কাগজে-কলমে সাড়ে চার হাজার মানুষের আনুমানিক হিসেব পাওয়া যায়, কিন্তু আদতে নাকি সলঙ্গা হাটে সেদিন দশ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল বৃটিশবাহিনী। স্বাধিকার চেতনায় উজ্জ্বীবিত হবার দায়ে একসঙ্গে এত মানুষ হত্যার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। বৃটিশদের এই হত্যাযজ্ঞ সেই সময়ের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম বলেই চিহ্নিত আজও।

সেদিন সলঙ্গার হাটে মুক্তিকামী মানুষের নেতৃত্বে ছিলেন ২২ বছরের এক যুবক। এই যুবকটির নাম আব্দুর রশিদ। সেদিনের সেই কিশোর নেতাই পরে জাতীয় নেতা মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ উপাধিতে ভূষিত হন। সেদিন তিনি সলঙ্গা হাটে বিদেশি পণ্য বর্জনের আন্দোলনে নেতৃত্বের জন্য বৃটিশবাহিনীর চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বন্দি হন।

স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তসিঁড়ি সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক, ঋণসালিশী বোর্ড প্রবর্তনের পথিকৃৎ, বর্গা আন্দোলনের অবিসংবাদিত কাণ্ডারি, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে অকুতোভয় যোদ্ধা এই মহান নেতা, আজীবন গণমানুষের নেতা মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের প্রয়াণের ৩৩তম বার্ষিকী আজ। তার অমর স্মৃতির প্রতি আমার প্রণতি।

মরহুম মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলাধীন তারুটিয়া গ্রামে এক পির বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ বড়পির হযরত আবদুল কাদির জিলানীর (র.) বংশধর শাহ সৈয়দ দরবেশ মাহমুদ ১৩০৩ সালে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে বাংলাদেশে আসেন।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় মাওলানার পক্ষে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশ নেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি যুক্ত প্রদেশের বেরেলি ইশতুল উলুম মাদ্রাসা, সাহারানপুর মাদ্রাসা, দেওবন্দ মাদ্রাসা ও লাহোরের এশাতুল ইসলাম কলেজে অধ্যয়ন করেন ও তর্কশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে তর্কবাগীশ উপাধিতে ভূষিত হন।

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯৩৩ সালে রাজশাহীর চাঁটকৈড়ে নিখিলবঙ্গ রায়ত খাতক সম্মেলন আহবান করে ঋণ সালিশী বোর্ড আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রাখেন। তিনি ১৯৩৭ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নাটোরে কৃষক সম্মেলন আহবান করেন। তিনি গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। ১৯৩৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তিনি বাংলা, আসাম ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত বাংলার এম.এল.এ হিসেবে তৎকালীন ব্যবস্থাপক পরিষদে পতিতাবৃত্তি নিরোধ, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ও বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে গঠিত ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগ দেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশি নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দল গঠন করেন এবং নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

আওয়ামী মুসলীগ দলীয় সদস্য হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৫৫ সালের ২২ আগস্ট তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি নির্মাণে যে সব মনীষী কালজয়ী অবদান রেখেছেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তার গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে `স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার-২০০০` (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। পঁচাত্তর উত্তর সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠনেও মাওলানা তর্কবাগীশ পালন করেন প্রাগ্রসর ভূমিকা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনাকালে মাওলানার নেতৃত্বে্ গঠিত হয় ১৫ দলীয় ঐক্যজোট। স্মর্তব্য, নববই দশকের দুর্বার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূলধারাটিই ছিল এই ঐক্যজোট।

তিনি একজন সুসাহিত্যিকও ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে, শেষ প্রেরিত নবী, সত্যার্থে ভ্রমণে, ইসলামের স্বর্ণযুগের ছিন্ন পৃষ্ঠা, সমকালীন জীবনবোধ, স্মৃতির সৈকতে আমি, ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইত্যাদি। এছাড়া তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তার নামে কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ক. নুরুন্নাহার তর্কবাগীশ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, রায়গঞ্জ
খ. চড়িয়া মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ বিজ্ঞান মাদ্রাসা, উল্লাপাড়া
গ. পাটধারী মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ উচ্চ বিদ্যালয়, সলংগা, উল্লাপাড়া
ঘ. মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পাঠাগার
ঙ.মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ফাউন্ডেশন

১৯৫৬-২৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটানা দশ বছর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কাবগীশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন, যুগ্ম সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদকের দ্বায়িত্ব পালন করেন তর্কবাগীশের সাথে। শেখ মুজিবুর রহমানের মানস গঠনে তর্কবাগীশের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। তার রাজনৈতিক দর্শন, বক্তৃতার ষ্টাইল, মানুষের প্রতি ভালবাসা, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম সবই ছিল তর্কবাগীশের প্রভাবে আচ্ছন্ন।

বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু এক নিবন্ধে লেখেন, ‘১৯৫৭ সালের ১৩ জুন শাবিস্তান হলে ও গুলিস্তান হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। ওয়ার্কিং কমিটি নতুন করে গঠণ করা হয়। হঠাৎ করে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ফলে একটি বড় রকমের ধাক্কা এলো দলে। সাতান্নতেই হাল ধরতে হলো শেখ মুজিবকে, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিলেন। এভাবে ক্রান্তিকালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও আবদুর রশিদ তর্কবাগিশকে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়।’

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে এই মাওলানার সান্নিধ্যে। তিনি তর্কবাগীশের ছায়াসঙ্গি হয়ে থেকেছেন সেই সময়টায়, ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে। তিনি মাওলানাকে কাছে থেকে দেখেছিলেন। আর মাওলানা প্রিয় সহকর্মি, প্রিয় শিষ্যকে কাছে থেকে গড়ে ছিলেন। দুজনের জীবনের নানান স্মৃতি কথা কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে ইতিহাসের পরতে পরতে।

স্বাধীনতার পর তারই প্রচেষ্টায় মাদ্রাসা শিক্ষা পুনরায় চালু হয়। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ ও একে বিজ্ঞান সম্মত রূপদান করেন। এছাড়া ইসলামি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি বেতার ও টেলিভিশনে কোরআন তেলাওয়াতের নিয়ম চালু করেন। বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের কথা উঠলে একদল এসে বলবে মাদ্রাসা শিক্ষার ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে আরেক সুবিধাবাদী দল সবসময় এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে সমস্যা থেকে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও কম যান না। কিন্তু এই সমস্যার কথা আবদুল রহমান তর্কবাগীশ বলে গেছেন ৭২ সালেই।

২৬ ফাল্গুন (১৯৭২) শুক্রবার মাওলানা আবদুল রশিদ তর্কবাগীশ বলেন, “বৈশ্বিক শিক্ষা বৈষয়িক শিক্ষা বিবর্জিত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষালব্ধ জ্ঞান সমাজ জীবনে খুব একটা কাজে আসে না। তিনি প্রচলিত স্বতন্ত্র মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।”

তিনি আরো বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ঘোষিত হওয়ায় ধর্ম শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেকের মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই আশংকার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কারণ ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মশিক্ষাকে নির্বাসন দেয়া হয়নি।”

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ উপমহাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে গত শতকের আট-এর দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অবধি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অথচ কি আমাদের কি দৈন্যতা যে নবপ্রজন্মের কাছে তিনি প্রায় অপরিচিত।

যিনি তর্কে পারঙ্গম, তর্কে যার ক্লান্তি নাই, খুব সাধারণ অর্থে তাকেও তর্কবাগীশ বলা যায়। কিন্তু মাওলানা আবদুর রশীদের তর্কবাগীশ উপাধিটি মোটেও কোনো সাধারণ অর্থ বহন করে না। যুক্তিশীলতার মধ্য দিয়ে আবদুর রশীদ হয়ে ওঠেন তর্কবাগীশ। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম-সাধনার প্রতিটি পর্যায়ে, ইতিহাস সাক্ষী, এই মাওলানা পালন করেন ত্যাগ-সুন্দর ভূমিকা, যা অনন্যতায় সমুজ্জ্বল।