
‘তাণ্ডব’ বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে তাণ্ডব চালাচ্ছে
স্বাধীন খসরুপ্রকাশিত : জুন ১৭, ২০২৫
কোরবানি ঈদের বাংলা সিনেমা ‘তাণ্ডব’ দেখলাম। সিনেমাটি মুক্তির পর থেকে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নিউজ পোর্টালে রিভিউ ফলো করছিলাম। সিনেমার লিচুরও বাগানে গানটি কী পরিমান জনপ্রিয় তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই গানের ভিডিও রিলস দেখলেই আঁচ করা যায়। আর এটা শুধু মানচিত্রের ভেতরে নয়, বহির্বিশ্বে সব বয়সী সকল বাঙালির কাছে সমাদৃত। বলা যায় হালের আনন্দ উৎসব মুখর রিলস বা ট্রল নৃত্য।
‘তাণ্ডব’ বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে তাণ্ডব চালাচ্ছে। এই ঈদে যে কয়টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে তাণ্ডবের ধারেকাছে অন্য কোনো সিনেমা নেই। গত রোজার ঈদেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মুক্তি পায় ৬টি সিনেমা। তার মধ্যে শাকিবের ‘বরবাদ’ ছিল সুপার হিট। এখনো ‘বরবাদ’ সিনেমা হলে চলছে। শাকিব খানের সিনেমা বলে কথা! রয়েছে শাকিব খানের বিশাল ফ্যান ফলোয়ার দল ‘শাকিববিয়ান’। দুই বাংলায় বর্তমান সময়ে একাই রাজত্ব শাকিবের।
অভিনয়, লুক, শারীরিক ফিটনেস, হেয়ার স্টাইল, পোশাক, সর্বোপরি অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছেন নিজেকে। আরেকটা লক্ষ্যণীয় বিষয়, ঢালিউড টালিউড বাণিজ্যিক সিনেমায় আগে ছোট ছোট চরিত্রকে তেমন প্রাধান্য দেয়া হতো না। ছোট চরিত্রে বন্ধু বান্ধব, আত্বীয় স্বজন, গাড়ির চালক, এমনকি ইউনিটের যে কাউকে দাঁড় করিয়ে দেয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। বিষয়টি ছিল স্টুডিও পাড়ায় বাইরে যাওয়ার দরকার কী, এরে ওরে ডেকে দাঁড় করিয়ে দাও।
টাকার দিক থেকেও সাশ্রয়ী তো বটে। বরবাদ ও তান্ডব সিনেমায় আমি প্রথম খেয়াল করলাম ছোট চরিত্রে, এমনকি একটি দুটি দৃশ্যেও প্রতিষ্ঠিত, স্বনামধন্য অভিনেতাদের যুক্ত করা হয়েছে। তা আমার কাছে খুবই ভালো ও প্রশংসনীয় দিক। সব চরিত্রই সমান ভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আমার কাছে ভালো লাগার আরেকটা কারণ, বেশিরভাগই আমার পরিচিত সহশিল্পী। তান্ডবে টেলি পর্দার বেশি শিল্পী প্রসঙ্গে দু’একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শাকিব নিজেই বলেছেন, সিনেমায় ছোট পর্দা আর বড় পর্দা বলে কিছু নেই। অভিনেতা তো অভিনেতাই, তা যে কোনো মাধ্যম হোক।
দেখলামম নিয়মিত অনিয়মিত অনেক সহশিল্পী সিনেমা পর্দায়। আরেকটা লক্ষণীয়, বিষয় হচ্ছে, আশির দশকের পর থেকে বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের নমুনা বা স্টাইল ছিল অতি উচ্চমাত্রার সংলাপ, উচ্চমাত্রার অভিনয়, একদম যাত্রা মঞ্চে অভিনয়ের মতো। সেখান থেকে আমাদের বাংলা সিনেমা ইদানীং অবশ্যই বলা যায় অনেকটাই মুক্ত। সিনেমার কারিগরি দিক, সম্পাদনা, চিত্রায়ণ, সংগীত, আলোক প্রক্ষেপণ, পোশাক, সেট, লোকেশন ও আবহ সঙ্গীতসহ সবদিকেই এগিয়েছে বর্তমান বাংলা সিনেমা। এককথায় বলা যায়, বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের সিনেমায় এখন আধুনিকতার ছোঁয়া দৃশ্যমান।
এবার নির্মাতা রাইহান রাফি সম্পর্কে কিছু কথা বলি। পরিচয় অভিনেতা শিমুল খানের মাধ্যমে ঢাকা মগবাজার মিডিয়া গলির কোনো এক অফিসে। পরিচয়ে জানতে পারি আমার অঞ্চল মানে সিলেটের মানুষ। জেনে আনন্দিত হয়েছি, বর্তমান সময়ে বৃহত্তর সিলেটের তেমন কেউ নেই সিনেমা পাড়ায়, তাই। যদিও বাংলা সিনেমার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের প্রথম নির্বাক সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’ থেকে শুরু করে, অনেক গুণীজনের পদচারণা ছিল বাংলা সিনেমার সাথে অগ্রভাগে।
পরিচয় পর্বে রাফির লেখাপড়ার পেছনের গল্প ও সিনেমা নিয়ে তার আগ্রহ দেখে কিছুটা বিস্মিত হই। এরমধ্যে একটা সিনেমা সে বানিয়ে ফেলেছে। সিনেমার গল্পের বিষয়টি নিয়েই আমাদের আলোচনা ছিল। গল্প শুনে আমি নিজ থেকে রাফিকে অনুরোধ করি সিনেমাটি মুক্তি না দেয়ার জন্য। পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে পারে, এসব ভেবে। তখন ও সিনেমাটি সেন্সরে জমা দেয়া হয়নি। রাফিকে প্রশ্ন করি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে থাকা বা সিনেমা বানানোর ইচ্ছের কথা। উত্তর জেনে আবারও বারণ করি ঐ সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে জমা না দিতে।
তার কিছুদিন পরই আমি বিলেতে চলে আসি আমার ছোট্ট সুন্দর পরিবার নিয়ে। তবে রাফির সাথে অবশ্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে ‘পোড়া মন ২’। জাকির হোসেন রাজুর ‘পোড়া মন’ সিনেমার সিকুয়েলে নির্মিত। সাথে সাথে না হলেও পরে দেখেছি। দেখেছি মৌলিক গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘সুড়ঙ্গ’। এটাই আমার দৃষ্টিতে রাফির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা এবং এই সিনেমায় দক্ষতার পরিচয় দৃশ্যমান। দেখেছি ‘পরান’ ও ‘তুফান’। প্রত্যেকটা সিনেমার গল্প আলাদা, নির্মাণে ভিন্নতা, আধুনিকতা।
আবারও বলছি, বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণ শৈলী পেশাদারিত্বের সাথে বর্তমান সময়ে আধুনিক নির্মাতা রায়হান রাফি। শাকিব খান অনবদ্য, এক কথায় একাই একশো। জয়া আহসান আবারও প্রমাণ করে দিলেন তার দক্ষতা। ভালো লেগেছে আফজাল হোসেনকে অনেক দিন পর সিনেমায়। বাকি প্রত্যেকে যার যার চরিত্রে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সাবিলা নূরের সিনেমায় অভিষেক শাকিব খানের সাথে বেশ ভালো লেগেছে। বাণিজ্যিক সিনেমায় ভবিষ্যতে আরো ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে। সিয়াম ও নিশোর কেমিও দর্শকদের আনন্দের মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে সিয়ামের কেমিও ছিল ফাটাফাটি, ছিল খুবই উপভোগ্য।
তাণ্ডবের সিকুয়েল আসবে তা বুঝতে সময় লাগেনি, এবং তাতে আগ্রহেরও কমতি নেই দর্শকদের। গল্পে টুইস্ট থাকা ভালো, দর্শকদের ও পছন্দ। শুরুতেই যদি শেষ বুঝা যায় তাহলে আগ্রহ কমে যায়। তবে সিনেমার দ্বিতীয় ভাগে এত বেশি টুইস্ট রাখা হয়েছে, তা অনেকটা অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। যেমন ‘অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।’ রায়হান রাফির জন্য সকল শুভকামনা থাকলো সবসময়। জয় হোক বাংলা সিনেমার, জয় হোক বাংলা সংস্কৃতির।
লেখক: অভিনেতা