
আলোকচিত্রঃ রিফাত বিন সালাম
নীলকণ্ঠ
পর্ব ১
জয়িতা মৌসুমপ্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০১৮
বাইরে একটা পাখি ডাকছে এই রাতের বেলায় । নীলা আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করে বারান্দার দরোজাটা খোলা। অথচ, সে ছাড়া আপাতত এখানে কেউ নেই, এসব কি গোলমালটা শুরু হয়েছে ক`দিন ধরে নীলা কিছুই বুঝতে পারছে না । একটা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে সে এই মাঝরাতে- রোজ নিয়ম করে এই সময় ঘুম ভাঙছে আজকাল ।
পুরো বাড়িটায় কোথাও একটা নিঃশ্বাসের ও শব্দ নেই, কি অস্বস্তিকর এই সময়টা ! আর ঘুম আসতে চায় না । সকাল হবার রোজ অপেক্ষা । এই মাঝরাত থেকে । এত দীর্ঘ সময় ধরে, করার কিই বা আছে একা মানুষের, বারান্দার দরোজা লাগিয়ে এসে পানি খায় নীলা। হঠাত ঘুম আসতে থাকে তার । ঘুমের ঘোরে নীলা এইবার একটা আশ্চর্য্য স্বপ্ন দ্যাখে- তার দোতলা বাড়িটার ছাদে কে যেন গান করছে । বোঝাই যাচ্ছে না সে নারী না পুরুষ । নীলা পেছন থেকে ডাকে- এই কে, কে ওখানে ।
মানুষটা মুখ ফিরিয়ে হাসে, তারপর আবার গান গাইতে থাকে , অদ্ভুত এক সুরে ভোঁতা গলায় গান গেয়ে যায়। নীলা আবারো ডাকে- এইবার সে আর ফিরে চায় না।সোজা লাফিয়ে পড়ে দোতলা ছাদ থেকে। নীলা ধড়ফড় করে জেগে ওঠে । কি ভয়ংকর স্বপ্ন ওটা ! একটা কাজে এই মফস্বলে পোস্টিং হয়েছে তার । সরকারি কাজের যা হাল । দু`মাসের কাজ, ছ`মাস লাগছে। এই বাড়ীটা ঠিক করা হয়েছে তার জন্যে, সরকারি বাংলো এখানে যা দু-একটা আছে, সেগুলোর অবস্থা শোচনীয় , মনে হয় দেখে, ভূতেদের আড্ডাজমে গেছে অতদিনে। ভালো দেখে এই বাসাটা পাওয়া গেছে, সেসব আরো মাস তিনেক আগের কথা।
এই বাড়ীটা মালিক অন্তত ভালোভাবে রেখেছিলো। সে থাকে শহরে। তাই হয়তো শহুরে মেজাজে সব আসবাব বানানো , যদিও বেশ পুরোনো। বাড়ীর কাজের মানুষ আর কেয়ারটেকার বলতে সবই ওই বুড়ো শংকর। মালিকের অবর্তমানে সে-ই বাড়ীর দায়িত্ব রাখে বুঝে-শুনে। সে রোজ দুবেলা কাজ কর্ম সেরে,নিয়ম করে বিকেল শেষে চাবি বুঝিয়ে, মা আসি বলে বিদায় নেয়। চাইলেও নীলা বলতে পারে না, কাকু আপনি থেকে যান, বুড়ো অত কাজ কর্ম সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যায়। নীলা ঠিক করেছে, আজ থেকে যেতে বলবে। কথাটা বুড়োকে বলতেই মনে হলো- সে বেশ খুশি হয়েছে। "ঠিক আছে, আমি আজ এখানেই থেকে যাচ্ছি" - হেঁড়ে গলায় শংকর বলে। শংকর কথা বেশ কম বলে, এই তো আরেক মুশকিল, রাতের খাবার দেয়ার পর, নীলা বলে- বসুন আমরা একসাথেই খাবো। খেতে খেতে নীলা জিজ্ঞেস করে- আজ আপনি গেলেন না বলে, বাড়িতে আর কাকী কিছু মনে করবেন না তো?না, না , সে কি , আমার কেউ নেই, সে মারা গেছে আরো বছর দশেক আগে। কথাটা শুনে নীলা আফসোস করে। আচ্ছা কাকু, এই বাড়িতে কে থাকতো আগে ?
নীলা বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে।শংকর বলে- আগে মালিকই থাকতো, বেশ আগেই ওরা শহরে চলে গেছে। বাড়িটা ওঁদের পৈতৃক সম্পত্তি। আচ্ছা, তবে এত বড় বাড়ি ছেড়ে গেলো কেনো? নীলার প্রশ্নটা শুনে, শংকর চুপ থাকে বেশ কিছুক্ষণ। কি হলো ? নীলা আবার জিজ্ঞেস করে, শংকর বলে- " সে বড় দুঃখের কথা , এখন রাত-বিরেতে ওসব কথা না বলাই ভালো, মা "নীলা কথাটা শুনে একটু অবাক হলেও চুপ থাকে। মনে মনে ভাবে, শংকর আসলেই জানে? নাকি এমনি এমনি ওসব বলছে। ও তো আবার বাড়ির মালিকদের খুব বিশ্বস্ত লোক। তবু -বয়স হয়েছে ওর। নীলা খেয়ে রেডিও অন করে। এই মফস্বলে পুরো ৯-১০ ঘন্টা এমন করে লোডশেডিং হয় যে, বিদ্যুৎ আছে সে` কথা বেমালুম মনে থাকে না তাই, টিভির ব্যাবস্থা করেনি সে নিজেই। ভীষণ একটা ভ্যাপসা গরম পড়ছে এবার।
রেডিওতে আবহাওয়ার খবরে বৃষ্টির কথা শোনা যায়, রেডিও বন্ধ করতেই শুরু হয় গুড়ি বৃষ্টি। শংকর নিচে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর নীলাও তখন জানালার একটা কপাট বন্ধ করে ঘুমোতে চেষ্টা করে। মাঝরাতে বৃষ্টির বেগ বাড়তেই নীলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনে হয় দূরে কোথাও টেলিভিশনে কেউ গান গাইছে।এই রাতে লোডশেডিং এর সময়ে কার ঘরে এত শব্দে টেলিভিশন চলছে,ভাবতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় তার। ভালো করে ঘোর কাটতেই সবটা একটু একটু নীলার বোধগম্য হয়! আর তারপর পুরো শরীর শীতল হয়ে আসে তার। জানালার ঠিক ওপারে বাড়ির লাগোয়া যে বারান্দা আর তা পেরুলোই ছাদের একটা অংশ এ পাশে। সেখানে কেউ হাঁটছে যেনো, আর গান গাইছে গুণগুণ করে। কন্ঠটা ঠিক মেয়েলি নয়। তবে খুব চাপা গলা। দীর্ঘদিনের ঠান্ডাজনিত রোগে ভুগতে থাকা শ্লেষ্মা জড়ানো গলা। ব্যাপারটা মনে হতেই শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে আসে তার। নীলা ডাকতে থাকে প্রাণপণে- কাকু আপনি আছেন ? আমি এখানে কিছু দেখতে পেলাম, জলদি আসুন! নিজের কন্ঠ নিজের কাছেই ভারী লাগে তার।
তারপর হঠাৎ কি হয়- একটা জমকালো বিদ্যুতের রেখা আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যেনো ছাদের মাঝখান টায়। সে আলোতে নীলা স্পষ্ট দেখতে পায়- একটা ১৯ কি ২০ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে এ দিকে চেয়ে। ফর্সা ছেলেটার ঠোঁটের কোণে হালকা রক্ত। নীলা পাথরের মতো জমে যায়। কতক্ষণ সে ওভাবে তাকিয়ে থাকে সে জানে না। মনে হয় যেনো সময়টা স্থির হয়ে আছে। এভাবে কত সময় যায়- কেউ জানে না, নীলা টের পায় সকালে, সকালে তার ঘুম ভাঙ্গায় শংকর। বৃষ্টি তখনো জেঁকে আছে বাইরে, ফোঁটা ফোঁটা ম্যাড়মেড়ে বৃষ্টি।
চলবে.........