
পরিণতি
উপন্যাস পর্ব ৫
সুলতানা পারভীনপ্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০১৮
আবির ভাই?
ডাকটা শুনে পিছনে ফিরলাম। নেহা কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পাইনি। হ্যাঁ নেহা, বলো।
এইটা বীথির ডায়েরী।
কী হয়েছে তোমার?
কিছু না। আপনি এটা পড়েন। কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিয়েন।
নেহা আমার থেকে মুখ লুকালেও বুঝতে পারছিলাম, এই মেয়েটাও বীথির জন্য কাঁদছে। বীথির ডায়েরিটার দিকে তাকালাম। মাঝারি সাইজের একটা ডায়েরি। কালচে নীল রঙের খোলসে মোড়া ডায়রিটা বীথির সমস্ত ছেলেমানুষির সাক্ষী। সুন্দর গোটা গোটা পরিষ্কার হাতের লেখা। আর প্রতিটা লেখার সাথে কাগজের খুটিনাটি জুড়ে দেয়া।
এই যে সেদিনের ঘটনা। বীথি আর আমি নদীর ধারে বেড়িয়ে এসেছি। তার একদম চুলচেরা বিবরণ। সাথে একটা কাগজের নৌকা জুড়ে দেয়া আছে। রঙ করা নদীর নীল পানিতে কাগজে এঁকে সেখানে কাগজ কেটে বানানো মাছ ছেড়ে দিয়েছে। অসাধারণ লাগছে জিনিসটা। আমার সাথে রাগের কথাগুলোও লেখা আছে। তবে আবছা আবছা। বুঝতে পারছি, চোখের জলে কাগজের লেখাগুলো ধুয়ে গেছে বারবার।
খো আছে ওর আর আমার প্রথম দেখার দিনটাও। সে প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা। আমি তখন ফাইনাল ইয়ারে আর বীথি ফাস্ট ইয়ারে। প্রথমদিন আমাকে দেখেই মেয়েটা থমকে দাঁড়িয়েছিল। ব্যাপারটা পড়ে হেসে ফেললাম। ওকে দেখে আমার অবস্থাও হয়েছিল এমনই। কোনো কারণ নেই। পরিচয় নেয়। অথচ একে অন্যকে দেখে অন্য একটা জগতে চলে যাই যেন।
যাই হোক। ডায়েরিতে লেখা আছে অনেক কিছুই। তবে লেখাগুলো কেবল আমাদেরকে কেন্দ্র করে। কবে কোথায় দেখা হয়েছে, কবে আমি বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলাম বলে ওর রাগ হয়েছে। কবে আমি অসুস্থ ছিলাম বলে ও আমার জন্য নফল রোজা রেখেছে। কবে আমার সাথে শাড়ি পড়ে বেরিয়েছে। কবে প্রথম আমার হাত ধরেছে।
ডায়েরিটা যেন সচরাচর লেখনি নয়। যেন এক একটা চিঠি। আমার কাছে লেখা চিঠি। শেষদিনের চিঠি যেটা সেটা পড়ে বুঝতে পারছিলাম না কি হয়েছে। চিঠিটা এমন:
আবির,
তুমি জানো আজ খুব মন খারাপ আমার। পাঁচটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছি। খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে। অথচ প্রতিবার মোবাইলটা কেঁপে উঠলে ঘুমটা কোথায় যে চলে যায়! খালি মনে হয়, তুমি কল করেছ। তুমি কল করছ। কিন্তু মোবাইলটা হাতে নিতেই মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। আচ্ছা, বলো তো, আমি কি খুব বেশিই খারাপ? সত্যিই কি আমি তোমার আর বাবা-মার সর্ম্পকটা নষ্ট করে দিচ্ছি? উনাদেরকে বাবা-মা ডাকার অধিকারটা সত্যিই কি আমার নেই বলো?
তোমার বোনটা কেমন আছে? মেহের, কি সুন্দর নাম না?? জানো, ও প্রায়ই আমাকে কল দেয়। আমরা কত কথা বলি। একেবারে বন্ধুর মতো। আমি কি ওকেও তোমার থেকে দূর করে দিচ্ছি? ছোট্ট কিছু স্বপ্ন দেখেছি জানো তো, তোমাকে নিয়ে-বাবা-মা-আর মেহেরকে নিয়ে। শুধু তোমাকেই তো চাইনি বলো কখনো-সবাইকেই চেয়েছিলাম তো। আচ্ছা, তোমাকে ভালোবাসাটাই কি আমার একমাত্র অপরাধ বলো? বাবা খুব চিন্তা করে এসব নিয়ে তাই না আবির? তোমার থেকে দূরে থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব না আবির-কিন্তু যাদেরকে তোমার চাইতেও বেশি ভালোবাসি তাদের ঘৃণা নিয়েও বা বাঁচব কি করে? বাবাকে প্লিজ বলে দিও, তোমাকে তাদের থেকে কখনো কেড়ে নেব না আমি। কক্খনো না। বিশ্বাস করো। এর চাইতে আমি...
ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। বীথিকে কে কী বলেছে সেটাই বুঝতে পারছি না। এই মেয়ে যে গুরুতর পর্যায়ের পাগল জানা ছিল। কিন্তু এমন কিছু একটা করে বসবে, ভাবিনি কখনো। ভাবছি, ওকে বোঝানো উচিত যে, ওর চাইতে ভালো কেউ আমার জীবনে আসতেই পারে না। কথাটা বাবাকেও বুঝানো উচিত। এখন সমস্যা হলো, বাবাকে বুঝাতে পারব কীনা জানি না। আর বীথি? ওকে যে কিভাবে বুঝাবো সেটা আমি নিজেও জানি না। হালকা নড়ার আওয়াজে চোখ তুলে বীথিকে দেখলাম। অস্বস্তি নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে। চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিলাম।
চলবে