মাহফুজ আলম
পাঠচক্র কইরা নিজেরে নেলসন ম্যান্ডেলা ভাবলে তো হয় না
সাদ রহমানপ্রকাশিত : অক্টোবর ০২, ২০২৪
প্রথম আলোতে সাজ্জাদ শরিফের সঙ্গে মাহফুজ আলমের ইন্টারভিউটা ‘মাস্টারমাইন্ডিয়’ হইছে। অর্থাৎ ভালো হয় নাই। সবাইরে ক্যামন জানি উপদেশ দেওয়ার মতো কইরা কথা বলেন তিনি। মনে হয়, দেশের সব মানুষ আর সব রাজনৈতিক দল তার মুখের কথা শোনার জন্য বইসা আছে, আর সেই কারণে তিনি কথা বলতেছেন।
এইটা প্রশ্নকর্তা সাজ্জাদ শরিফের সমস্যা না। সমস্যাটা মাহফুজ আলমেরই। তার মধ্যে উপদেশ দেওয়ার প্রবণতাটা বেশি। তিনি নিজেরে কিছুটা নেলসন ম্যান্ডেলা মনে করতেছেন। কিন্তু তিনি কি সাতাইশ বছর জেল খাটছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠচক্র কইরা আর দুই পাতা ইকবাল আহমেদ পইড়া নিজেরে নেলসন ম্যান্ডেলা ভাবলে তো হয় না।
মাহফুজ আলমের উপদেশ শুইনা যে দেশের রাজনৈতিক দলগুলা ‘বিশুদ্ধিকরণ’ কার্যক্রম শুরু কইরা দিবে না, তা বলাই বাহুল্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাহফুজকে বিল ক্লিনটনের সামনে জুলাই-আগস্টের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করাইয়া দিয়া ভুলই করছেন, এইটা এখন বোঝা যাচ্ছে। মাহফুজ এখন এই তকমা মাথায় লইয়া নাচার পরিকল্পনা করতেছেন।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আসল মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনার রেজিম স্বয়ং, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নিজের ফ্যাসিবাদ। মানুষ হাসিনার স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ হইয়া গেছিলো, ফলে মানুষ এই আন্দোলনে নিজেরে বিপুলভাবে শরিক করছিলো। একটু সরলিকরণ করলাম, বাট ঘটনাটা এইরকমই ঘটছে। মাহফুজ আর নাহিদদের মতো মাস্টারমাইন্ডদের ছাড়া কি আগেরবারের কোটা আন্দোলন হয় নাই? নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয় নাই?
অর্থাৎ বড় আন্দোলন ‘দার্শনিক’ মাস্টারমাইন্ড ছাড়া সংঘটিত হয় না, এইটা ভুল কথা। কিন্তু আগেরবারের কোটা আন্দোলনের পরে নুরুল হক নুররা গণভবনে গেছিলো। তার কারণ, হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা তখনও এতো বিকট ছিল না। কিন্তু ধরেন, এবারের আন্দোলন থামানো হইলে কিংবা নাহিদ-মাহফুজরা গণভবনে গেলে মানুষ কি তা মাইনা নিতো? নুরুল হক নুরদের যাওয়া মাইনা নিছিলো।
এতে বোঝা যায়, শেখ হাসিনার ব্যাপারে মানুষের কনসেপশন দুই হাজার আঠারো-উনিশ সালে যা ছিল, দুই হাজার চব্বিশ সালে তা ছিল না। মাহফুজ ও নাহিদরা মূলত মানুষের এই অবস্থান, অর্থাৎ মানুষের এই আদেশকে অনুসরণ করতে পারছিল। এই গণআদেশ অনুসরণ করার জন্য তারা আমাদের ধন্যবাদার্হ, এরই মধ্যে তাদেরকে সেই ধন্যবাদ আমরা দিছিও।
কিন্তু তার মানে এইটা না যে, তারা এখন ভাবটা এমন করবেন, যেন বিগত চাইর বছর ধইরা তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গুরুবার আড্ডা’ পাঠচক্র করতেন বইলা জুলাই-আগস্ট আন্দোলন সফল হইছে। ঘটনা এইরকম নয়। এইসব নার্সিজিজম পরিহার করলে ভালো হবে।
দেখেন ইন্টারভিউতে সাজ্জাদ শরিফকে পাইয়া মাহফুজ তাদের ‘গুরুবার আড্ডা’ নিয়া কী বলতেছেন।
“২০২১ সালে অক্টোবর মাসে আমরা ‘গুরুবার আড্ডা’ নামে পাঠচক্র শুরু করলাম। প্রথমে নাহিদ ইসলামসহ আমরা ছিলাম চারজন। পরে আবু বাকের মজুমদারসহ আরও তিনজন যুক্ত হলেন। …আমরা কামরুদ্দীন আহমেদের লেখা যেমন পড়েছি, তেমনই লেনিনের বা ইসলামি রাষ্ট্রভাবনার বাস্তবতা নিয়েও আলোচনা করেছি। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, ইকবালকে নিয়ে আলোচনা করেছি। এভাবে আমরা চিন্তা ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির ব্যবধান যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছি।”
লক্ষ্য করার বিষয় হইলো, দেখেন, প্রথমেই নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারের নাম উল্লেখ কইরা মাহফুজ এটা প্রতিষ্ঠা করতেছেন যে, আড্ডাটা ছিল খুবই সীমিত কয়েকজন মানুষের মধ্যে। যেন এই গুটিকয়েক মাস্টারমাইন্ডের মাথা থেকেই জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান বাইর হইয়া আসছিল। তারপর তিনি বলতেছেন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ও ইকবাল ইত্যাদি পড়ার মাধ্যমে তারা ‘চিন্তা ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির ব্যবধান’ কমাইয়া আনছেন। এইখানে ‘চিন্তা’র সঙ্গে ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি’র ব্যবধান কমানোর সূত্রটা কী? বুঝলাম না।
ধইরা নিচ্ছি, ভারত, পাকিস্তান আর যোগ দর্শনের সংমিশ্রণ ঘটাইয়া তারা এই ব্যবধান কমাইতেছিলেন। (হা হা)। সত্যি কথা যদি বলি, তাইলে বলতে হয়, মাহফুজ আসলে এইভাবে প্রকল্পটারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে নিয়া যাইতেছেন, তার কারণ জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের বুদ্ধিবৃত্তিক গুরু ফরহাদ মজহারের হাত থেকে তিনি বাঁচতে চাইতেছেন। আসল ‘গুরু’রে বাদ দেওয়ার জন্যই এই ‘গুরুবার আড্ডা’ লইয়া কচকচ করতেছেন। এর আগেও তিনি ফরহাদ মজহারকে গা থেকে ঝারার জন্য চেষ্টা করছেন। বাট প্রচেষ্টাটা একটু সিলি।
যেই চিন্তার ভিতর দিয়া আপনি আসছেন সেই চিন্তা আপনার ঝাইরা ফেলতে হবে ক্যানো? দরকার তো নাই! মাহফুজ আলমরা যতক্ষণ না পর্যন্ত ইউনূসের চিন্তা-পদ্ধতি রপ্ত করতে পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ফরহাদ মজহারকে গা থেকে ঝাইরা ফেলার চিন্তা আত্মঘাতী হবে।
লেখক: কবি