বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা

প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ জন্মশতবার্ষিকী। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তাকে নিবেদিত একগুচ্ছ কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

রক্তের গম্বুজ

তর্জনি তুলতেই
আকাশ আমাদের হয়ে গেল
পা ফেলতেই
চৌহদ্দি নির্দিষ্ট হয়ে গেল
এবং তাকাতেই
প্রবাহিত হতে থাকলো নদী
তার কণ্ঠস্বরে সূর্য ও সবুজ এক হলো,
‘আমার সোনার বাংলা…’

স্বপ্ন ডাক দিয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায়।
সাতচল্লিশে বনে-বনে বাঘ
বাহান্নোর কুমির ভেসে যায় ভাটায়
সুন্দরী কাঠের নাও পাল তুলতেই
পদ্মা-যমুনা মেশে বঙ্গোপসাগরে
ছেষট্টি ফরফর ওড়ে, চৌচির মাটি—
ঊনসত্তর পোড়ে, মচমচে বুটে ও চক্চকে বেয়োনেটে
সত্তর পার হয় সাহসে
একাত্তরে কলস উপুড়
রক্ত ও ক্রোধের মধ্যে পাঁক ও ঘৃণা,
‘শুয়োরগুলো খেদা!’

বত্রিশ নম্বর এখন রক্তের গম্বুজ
তার চূড়ায় মূল দলিল, নকশা আর পর্চা…

লুৎফর রহমান রিটন

মুজিবের থাকা না থাকা

দেয়ালে দেয়ালে সারা দেশজুড়ে লেখা ছিল তার নাম
পুরনো দেয়াল সেই অজুহাতে করিয়েছি চুনকাম।
টিভির ফুটেজে সংরক্ষিত ছিল তার যত ছবি
এডিট করেছি ইরেজ করেছি নষ্ট করেছি সবই।

ছোটদের যত পাঠ্যসূচিতে লেখা ছিল তার নাম
জ্ঞাণপাপী কিছু লেখক জুটিয়ে সব ছেঁটে ফেললাম।
রেডিওতে ছিল তাকে নিয়ে গাওয়া কালজয়ী কিছু গান
ইরেজ করেছি নষ্ট করেছি গান হলো অবসান।

চলচ্চিত্রেও ছিল তার ছবি, দিয়েছি বেজায় ঘষে
ভেবেছি মুজিব ইতিহাস থেকে চিরতরে গেছে খসে।
ইতিহাস থেকে মুজিবের নাম মুছে দিয়ে অতঃপর—
উল্লাসে মাতি, নেই নেই নেই, নেই সেই মুজিবর।

এত মুছলাম এত কাটলাম এত ঘষলাম তবু
এই বাংলায় মুজিবর নেই বলতে পারি না কভু।
এত কাটাছেঁড়া তবুও মুজিব কী করে সজীব রয়?
এই বাংলায় কারা অবিচল মুজিবের কথা কয়!

প্রকৃতির কাছে পাঠ নিতে নিতে অবশেষে জানলাম
এই বাংলার পরতে পরতে লেখা আছে তার নাম!
যেদিকে তাকাই এই বাংলার মাটি আর আসমান
সবখানে দেখি মুজিবের ছায়া আর তার জয়গান।

প্রতিদিন জেনো সূর্যের নামে মুজিব উদিত হয়
প্রতিদিন জেনো দখিনা বাতাস মুজিবের নামে বয়।
প্রতিদিন জেনো মুজিবের নামে সহস্র ফুল ফোটে
মুজিবের নাম গান হয়ে ওঠে হাজারো পাখির ঠোঁটে।

প্রতিদিন জেনো ভোরের শিশির মুজিবের নামে ঝরে
মুজিবের নামে টাপুর টুপুর অঝোরে বিষ্টি পড়ে।
রাতের আকাশে মুজিব জোছনা, আকাশে মুজিব চাঁদ
নদী কলোকলে ঝর্ণার জলে মুজিবের সংবাদ।

ফসলের মাঠে প্রতি মৌসুমে প্রতিটি শস্যকণা
মুজিবের যত কীর্তিকে নিয়ে করে শুধু আলোচনা।
কৃষকের চোখে হাসে মুজিবর নবান্ন উৎসবে
মুজিব মুখর শাপলার বিলে ডাহুকের কলরবে।

নৌকার পাল লাঙলের ফলা এবং ধানের শীষে
ঊর্মির ভিড়ে সমুদ্র তীরে মুজিবর আছে মিশে।
বটের ছায়ায় উদাসী দুপুরে রাখালের প্রিয় বাঁশি
সিম্ফনি তোলে, মুজিব তোমাকে ভালোবাসি ভালোবাসি।

মায়ের আঁচলে বোনের বেনীতে বাবার জায়নামাজে
অষ্টপ্রহর মুজিবর আছে সকল শুভর মাঝে।
কিষাণি বধূর সন্ধ্যা প্রদীপে পড়ে মুজিবের ছায়া
নকশি কাঁথার বুননে বুননে মুজিবের যত মায়া।

জারি সারি আর ভাটিয়ালি গানে মুজিবের যত কথা
মুজিবের প্রেমে নুয়ে পড়ে ঘাস লাজুক স্বর্ণলতা।
শরতে আকাশে শাদা শাদা মেঘ মুজিবের ছবি আঁকে
ধ্রুবতারা হয়ে মুজিবর আছে তারাদের ঝাঁকে ঝাঁকে।

বইয়ের মলাটে মুজিবর আছে কবিতার পঙক্তিতে
ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে নাটকে ও সঙ্গীতে।
মুজিব মূর্ত চারুশিল্পীর বিমূর্ত ক্যানভাসে
বাংলার দুখে বাংলার সুখে মুজিবর কাঁদে, হাসে।

মিছিলে মিছিলে শ্লোগানে শ্লোগানে পোস্টারে ফেস্টুনে
লাল অক্ষর আরো লাল হয় মুজিবের তাজা খুনে।
শ্রমিকের ঘামে মজুরের শ্রমে শিশুদের সমাবেশে
উদ্দীপনার হিমালয় হয়ে মুজিব দাঁড়ায় এসে।

শিক্ষার্থীর মননে মেধায় মুজিবর জাগ্রত
ধ্বংসস্তুপে মুজিবর জাগে ফিনিক্স পাখির মতো।
লাখো শহিদের শোনিত প্রবাহ মুজিবের পানে ধায়
জোনাকির আলো জ্বলে আর নেভে বিনম্র শ্রদ্ধায়।

দ্রোহে প্রতিবাদে প্রতিরোধে জেনো মুজিবর আছে কাছে
স্মৃতিসৌধ ও শহিদ মিনারে মুজিবর মিশে আছে।
মুজিবর আছে বাংলাদেশের অপরূপ পতাকায়
মুজিবর আছে মানচিত্রের মায়াভরা আঙিনায়।

এদেশের কোটি মানুষের বুকে মুজিব নিয়েছে ঠাই
তিনি অবিনাশী অবিনশ্বর তাহার বিনাশ নাই।

রবিউল হুসাইন

বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে

হঠাৎ করে ঢাকা শহর উঠলো জ্বলে
আমরা তখন হতভম্ব অবাক হয়ে
চেঁচিয়ে উঠি, কী হলো এই মধ্যরাতে অসময়ে
চারদিকে গুলি গোলার শব্দ কেন দাবানলে

পুড়ছে নগর কামান ছুঁড়ে বাড়ি-ঘর-দোর
ধ্বংস করে মানুষ মারে নির্বিবাদে কারা এরা
নিরস্ত্র আর নির্দোষীদের পরে জানি পাক-সেনারা
নির্বাচনে হেরে ওরা পাগলা কুত্তা খুনীর দোসর

করছে শুরু বাংলা-নিধন নির্বিচারে নিষ্ঠুরতায়
এমন কি বাংলাভাষার শহিদ মিনার স্বাধীনতার
উৎস-প্রতীক সেটিকেও বোমা মেরে নৃশংসতার
বিকৃত এক মনোরোগে গুঁড়িয়ে দিল বর্বরতায়

সেই ভয়াল রাতে লক্ষ মানুষ খুন করেছে পাকসেনারা
তিরিশ লক্ষ গণহত্যার শুরুটি হয় এমনি করে তাদের হাতে
শোষণ-শাসন অত্যাচার আর অবিচারের রক্তস্রোতে
সিনান করে বাঙালিসব শপথ করে পাকিদের করবে তাড়া

মার্চের সাতে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
এভাবেই স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধ পঁচিশ মার্চে সূচনা

ডিসেম্বরের ষোলতে শেষ হাজার বছরের পরাধীনতা
আর মার্চের ছাব্বিশে শুভযাত্রা বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ছেচল্লিশ বছর থেকে আজ দৃশ্যমান বাংলাদেশের অস্তিত্ব
সুখে-দুঃখে চিরটিকাল টিকে থাকুক বাঙালির এই কৃতিত্ব

শহীদ কাদরী

হন্তারকদের প্রতি

বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনও উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না।

তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম,
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিল,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলাভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলার মানুষ

এর চেয়ে ভয়াবহ কোনও কথা আমি আর শুনবো না কোনও দিন।