বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ৩

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯

বিনয় মজুমদারের চিন্তার গাণিতিক ব্যাপ্তি, ১৪১৩ সালে ‘অউম’ পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকার যা বলেছিলেন, তা থেকে স্পষ্ট হবে, “তোমরা মহাগ্রন্থ শুনেছ কি? পড়েছ কি? জানো কি? পৃথিবীর যত বই আছে, সব বই মিলে আসলে একখানি বই। তারই নাম মহাগ্রন্থ। এই মহাগ্রন্থ নিজের প্রয়োজনে বাড়ে। ঠিক আমগাছের মতো বাড়ে মহাগ্রন্থের শাখা-প্রশাখা। মহাগ্রন্থ এখনই বেড়ে যাচ্ছে, এই কলমের মুখ দিয়ে এই মুহূর্তে মহাগ্রন্থ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান পাঠক যা পড়তে পড়তে টের পাবে। এবং এই যে পৃথিবীর যেখানে যত লোকই, এখন যারা লিখছে— সবার হাত দিয়েই মহাগ্রন্থ বেড়ে চলেছে। রসায়নশাস্ত্র, উড়োজাহাজ বানাবার বিদ্যা, লোকেদের লেখা চিঠি, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা— এইরূপ অসংখ্য বিষয়ে বর্তমান মুহূর্তে লেখা হচ্ছে, এ সবগুলিই একখানি মহাগ্রন্থের বৃদ্ধিমাত্র। যেমন আমগাছের ডাল একসঙ্গে অনেক গজায় এবং বাড়ে, তেমনি মহাগ্রন্থ একসঙ্গে অনেক গজায় এবং বাড়ে।”

‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কবিতায় বিনয় এই একই গাণিতিক ব্যাপ্তি লক্ষ্য করেছেন দর্শনে। তিনি বলেছেন:
দর্শনের জগতেও নানা পরিবার আছে, অগণন পরিবার আছে
সে-সকল পরিবার— আলাদা যে কোনো পরিবারে সবার চেহারা
চরিত্র ইত্যাদি প্রায় একরকমের হয়, তাই এত পরিবার হয়
এমন পরিবারের কারো সাথে কথা বলে নিতে গিয়ে যদি তাকে
পাওয়া নাই যায় তবে সেই পরিবারভুক্ত— একই পরিবারভূক্ত কারো
অন্য কারো কাছে সেই কথা বলে আসা যায় একই আলোচনা করা যায়;
তাতে খুব অসুবিধা হয় না, হয়তো বেশি সুবিধাও হয়ে যেতে পারে।

‘লোক’ পত্রিকার জন্য ২০০১ সালে শামীমুল হক শামীম বিনয় মজুমদারের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তাতে ছন্দ সম্পর্কে এরকম প্রশ্নোত্তর হয়েছিল:
প্রশ্ন: আপনি তো পয়ারেই কবিতা লিখলেন সারা জীবন। পয়ারেই কি আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
বিনয়: এখন আর পয়ারে লিখি না তো। হ্যাঁ, অধিকাংশই, সেই ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৫ পর্যন্ত পয়ারেই লিখে গেছি। একটানা। তবে আমার পয়ারে তফাত আছে, অন্য পয়ারের মতো না। তফাতটা আমি বলছি; শোনো, এটা হচ্ছে সংস্কৃত পয়ার, ছন্দিত সংস্কৃত ছন্দ আসলে। আর পয়ার ছন্দ বললাম দুটো। কিন্তু কর্কশ ছন্দ ছিল। সেটা মন্দাক্রান্তা ছন্দ। ওই মন্দাক্রান্তা ছন্দটা হচ্ছে মেঘদূতের ছন্দ। ছন্দটাকে ভেঙে আমি এমন বানালাম যে, পয়ার ছন্দটা খুব মিষ্ট হয়ে গেল। পয়ার ছন্দটাকে আমি মিষ্ট বানালাম নানান কাণ্ড করে। ‘আমার ছন্দ’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখেছি আমি। সম্পাদক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তার পত্রিকায় ছাপিয়েছে।

প্রশ্ন: পরে সেটা বই হয়ে বেরিয়েছে।
বিনয়: কোন বইতে যেন?
প্রশ্ন: ‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ ও অন্যান্য’ বইতে।
বিনয়: হ্যাঁ, প্রতিভাস থেকে বেরিয়েছে। সেই বইতে ‘আমার ছন্দ’ প্রবন্ধটি আছে। ‘আমার ছন্দ’ প্রবন্ধে পয়ার ছন্দে কীভাবে লিখেছি, পয়ার ছন্দটাকে আমি কীভাবে নিজস্ব পদ্ধতিতে নিয়ে এসেছি সেটা বিশদভাবে লিখেছি, খুবই বিশদভাবে লিখেছি। গাণিতিক ছবি-টবি দিয়ে খুবই সুন্দরভাবে লিখেছি। তারপরে পয়ারটা খুব মিষ্ট ছন্দ হয়ে গেল। এজন্য পয়ারেই, যেহেতু আমি পয়ারেই ওইরকমের মিষ্ট পয়ার লেখা আবিষ্কার করলাম; সেই হেতু ঠিক করলাম যে আমি এর পরে শুধু পয়ারেই লিখব, আর কোনও ছন্দে নয়।

‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ’ বইটিতে বিনয় মজুমদার লিখেছেন, “রূপ থেকে অরূপে আসা, আবার অরূপ থেকে রূপে ফিরে যাওয়া, রূপের সহিত অরূপের পারস্পরিক সম্পর্কে— এ সকল বিষয় অত্যন্ত মূল্যবান। গণিতশাস্ত্রেও ঠিক এই। একই ব্যাপার ঘটে। কোনো রূপের নির্যাসরূপে থিওরেম বা ফর্মুলা তৈরি করা হয়। অতঃপর সেই থিওরেম বা ফর্মুলা থেকে যত খুশি রূপ ফিরে পাওয়া যায়, যত খুশি রূপের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। এই অর্থে– ’এই করেছ ভালো, নিঠুর, এই করেছ ভালো…’ কবিতাটি একটি ফর্মুলা— জীবন ফর্মুলা।”

বিনয় মজুমদার রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে ফর্মুলা বলায়, অনুমান করা যায়, হয়তো, তিনি নিজের জীবনের ক্ষেত্রেই এই ফর্মুলাটিকে রূপায়িত হতে দেখলেন, যেমনটা রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ নিজেদের জীবনের ক্ষেত্রে দেখেছিলেন। চলবে