
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ১১
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০১৮
সারাদিনের খাটুনিতে আমরা কিছুটা ক্লান্ত। যখন হোমে পৌঁছালাম, বিকেলের রক্তিম সূর্য ডুবু-ডুবু করছে। দ্রুততার সঙ্গে মেরির সেলুট কিছু দৃশ্য কামেরার ফিতায় ধারণ করলাম। হোমের পুকুর, হাঁস-মুরগি ও গরুর খামার, সঙ্গে বায়ো গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার কৌশল, আবাদী জমি ইত্যাদি। হোমের সব কিছুই এখানে অবস্থানরত ছেলেমেয়েদের দ্বারা উৎপাদিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। আমরা তা ধারাবাহিকভাবে শুট করলাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। আলো নেই্। আমাদের সাথে পর্যাপ্ত লাইট আছে। তা জ্বালানোর জন্য উদ্যোগ নেয়া হলো। উদ্দেশ্য মেরিকে দিয়ে এক গানের চিত্রায়ণ করব, মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।
রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আমরা ওই গানের চিত্রায়ণ করলাম। সাথে মেরির ইন্টারভিউ। ওই দিনের একটি কথা বারবার আমার মনে দাগ কাটে। সেদিন একটা দৃশ্যে আমি মেরির চোখে কান্নার মুহূর্ত ধারণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটি নিতেই যত ঘটনা... টানা এক ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করছি কিন্তু মেরির চোখে পানি আনতে পারছি না। ইউনিটের সবাই হাঁপিয়ে উঠেছে।
মেরি বলল, মেহেদী ভাই, বাদ দেন। আমি পারছি না।
মামুন বলল, মেহেদী ভাই, দৃশ্যটা কি নেয়া খুবই জরুরি?
রুমী ভাই বলল, ভাই, জেনারেটরের পাওয়ার কিন্তু শেষ হয়ে যাচ্ছে। শুটিং কি আর করবেন?
মেহেদী ভাই বলল, মিতা, বাচ্চাদের ঘুমানোর সময় তো হয়ে গেল। রাত ১১টা বাজে।
কিন্তু এই দৃশ্যটি লাগবেই আমার।
আমি শুটিংয়ের সকল লাইট বন্ধ করে দিতে বললাম। মেরিকে বললাম, চলো বারান্দা থেকে হেঁটে আসি। তখন শুটিং চলছিল তাদের বিশাল তিন-তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায়। আমি তাকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু সময় কথা বলার পর জিগেশ করলা, আচ্ছা মেরি, তুমি কি তোমার মাকে দেখেছ?
মেরি বলল, জী না ভাইয়া।
তার কোনও কথা শুনেছো?
হাঁ, শুনেছি। নানির কাছ থেকে।
তোমার বাবার সম্পর্কে কি তোমার ধারণা আছে?
না নেই।
তুমি মা বলে কোনোদিন কাউকে ডেকেছো?
হ্যাঁ।
কাকে?
প্রিন্সিপাল স্যারের স্ত্রীকে।
উনি কি তোমাকে ভালোবাসেন?
হ্যাঁ।
উনি তোমাকে খুব আদর করেন?
হ্যাঁ করেন।
তোমার মা বেঁচে থাকলে তিনি কি প্রিন্সিপাল স্যারের স্ত্রীর চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন?
অবশ্যই। মা তো তিনিই। তিনিই তো আমাকে জন্ম দিয়েছেন।
তোমার মায়ের কোনও ছবি আছে তোমার কাছে?
জী আছে।
কোথায়?
আমার পড়ার ঘরে।
চলো তোমার পড়ার ঘরে।
আমরা তার পড়ার ঘরে গেলাম। তার বইয়ের মধ্যে রাখা তার মায়ের ছবিটা বের করে মেরি আমাকে দিল। আমি দেখলাম এবং তাকে ভালো করে দেখতে বললাম।
রাত সারে ১১টা বাজতে চলল। লাইট অন করতে বললাম। লাইট অন হলো। মামুন প্রস্তুত টেক নেবার জন্য। মেরি অনেকটা আনমনা হয়ে বসে পড়ল তার অবস্থানে। ক্যামেরা অন হলো। ক্যামেরা চলছে... মেরি কথা বলতে-বলতে ক্যামেরার দিকে তাকাতেই তার দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল...
সবাই স্তব্ধ। হটাৎ ইউনিটের সবাই চিৎকার করে বলে উঠল, হইছে হইছে। সাথে হাততালি।
আমি ততটা অবাক হইনি। মৃত মায়ের ছবি দেখে কারও চোখে অজান্তে পানি আসবে না, তা কি হয়! মেরি তখনও কাঁদছে। আমি অনেকটা নীরবে শুটিং প্যাকআপ করে নিচের দিকে নেমে এলাম। ধন্যবাদ মাকে। ধন্যবাদ মেরিকে।
চলবে...