
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ৩১
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মার্চ ২৮, ২০১৮
মায়া বলল, আমরা কি জন্ম থেকেই খারাপ?
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, জন্ম খারাপ নয়, জন্মগ্রহণ সম্পর্কিত নিয়মনীতি খারাপ।
তাতে আমাদের সমস্যা কি?
সমস্যা তোমাদের নয়। সমস্যা তাদের, যারা অন্যায়ভাবে তোমাদেরকে এ পেশায় নিযুক্ত থাকতে বাধ্য করছে কিংবা অন্যায়ভাবে অবৈধ সন্তান প্রসবের মাধ্যমে নতুন ভ্রূণ সৃষ্টি করছে। চলো বাইরে ঘুরতে যাই।
চলো। আমরা দুজনই হাঁটতে যাব?
হ্যাঁ। রশিদ ভাই ইচ্ছে করলে আমাদের সাথে থাকতে পারে।
তাহলে চলো, কিন্তু তোমার লজ্জা করবে না?
করবে তো। করবে না কেন? মানুষেরই তো লজ্জা করবে। কিন্তু আমার লজ্জা এখানে আসার আগে বাসায় রেখে এসেছি।
যাক, সাহস আছে দেখি!
তোমার বাবু যদি জানে তুমি আমাকে নিয়ে এখানে-সেখানে হাঁটাহাঁটি করেছো, তখন?
সমস্যা নেই। সে তোমার ব্যাপারে কিছুই বলবে না। সে জানে, তুমি আমাদেরকে নিয়ে কাজ করছো।
তাহলে চলো।
পল্লীর বাইরের রেললাইনের পাশে সুন্দর ঘাসের ওপর দিয়ে আমরা পাশাপাশি হাঁটছি। এখানে চোখের সামনে নিষিদ্ধ পল্লী দৃষ্টিগোচর হলেও পায়ের নিচে অনুভবযোগ্য কচি ঘাসগুলো দুমড়ে-মুড়ে প্রশান্তির এক কোমল সুখানুভূতি দিচ্ছে আমাদের। সকালের শিশির ভেজা সকালের ঘাস যতনা সুন্দর, মোহনীয়, আবেদনময়ী হিসেবে নিজেকে সুর্যের আলোতে নিজের রূপ সৌন্দর্যের আলোক শিখা ছড়াতে থাকে... সেই সৌন্দর্যের যবনিকাপাত ঘটে রাতের অন্ধকারে কতিপয় মানুষের নখের গভীর আঁচড়ে। হাঁটতে হাঁটতে মায়া বলল, তুমি তো আমাদেরকে নিয়ে কাজ করতে আসছো?
হ্যাঁ।
তাহলে দ্রুত কাজ শেষ করে চলে গেলেই তো হয়।
তুমি কি আমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাচ্ছো?
না। বলছি, সবাই যেভাবে কাজ করে চলে যায়, তুমি সেভাবে করো না কেন?
সবার চিন্তা সমান নয়। দ্রুত কাজ করতে গেলে কি তোমাদের বিষয়ে এত কিছু জানতে পারতাম? তুমি কি আমার একজন ভালো বন্ধু হতে পারতে? আমি তোমাকে বেশ্যা ভেবেই চলে যেতাম... মানুষ হিসেবে কি ভাবতে শিখতাম?
এত কিছু বুঝি না। কেউ একটু ভালোবাসলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
ভালোবাসা কি খারাপ? তোমার কাছে?
ভালোবাসা খারাপ নয়। ভালোবাসার নামে প্রতারণা করা করা খারাপ। যেহেতু আমি ভালোবেসে প্রতারিত হয়েছি, হয়েছি যৌনকর্মী। সেহেতু এখন ভালোবাসাকে ঘেন্না করি।
সবাই তো খারাপ নয়। নতুনভাবে ভাবতে পারো।
কাকে নিয়ে ভাবব? বেশ্যা পল্লীতে কি ভাবা যায়?
তোমার বাবু? সে কি ভালোবাসে না?
তার ভালোবাসা আর প্রেমিকের ভালোবাসা এক নয়। বাবুর ভালোবাসার মধ্যে আর্থিক লেনদেন থাকে, কিন্তু প্রকৃত প্রেমিকের ভালোবাসার মধ্যে কোনও প্রকার অর্থ লেনদেনের বিষয় জড়িত থাকে না।
তেমন কাউকে কি পাচ্ছো না?
কোথায় পাব? সবাই এখানে আসে খারাপ উদ্দেশ্যে। সবাই চায় দেহ। কেউ মনের খোঁজ নিতে চায় না। তুমি কেন নিচ্ছ?
কেউ খোঁজ নিচ্ছে না বলেই কি অন্য কেউ খোঁজ নিতে পারবে না?
ওম, তা পারবে।
কিছু খাবে?
এখন কি কিছু খেতে ভালো লাগবে? আচ্ছা, জায়গাটা কেমন লাগছে?
খুব সন্দর।
খুব সুন্দর?
হু, খুব সুন্দর।
বেশ্যা পাড়াতে আবার সুন্দর জায়গা থাকে নাকি?
সাগরের কিনারে তো অনেক পোকামাকড় বাস করে, খারাপ লাগে?
পাটুরিয়া থেকে রাজবাড়ি যাবার পথে হাতের বাম পাশের রেললাইনের কোল ঘেঁষেই অবস্থিত দৌলতদিয়া ঘাট নিষিদ্ধ পল্লীটি। রেলপথের সাথেই যুক্ত লম্বা বিশাল খাল। এখানে প্রায় সব সময়ই পানি আবদ্ধ থাকে। সেই আবদ্ধ খালের অপর প্রান্তের সুবিশাল জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এ পল্লী। আমরা হাঁটছি সূর্য ডোবার আগমুহূর্তে। অনেকটাই নিরিবিলি পরিবেশ। মাঝে মাঝে কিছু ছেলেমেয়ে জোড়ায় জোড়ায় জুটি বেঁধে বসে থেকে গল্প করছে। এরা সবাই এ পল্লীরই ছেলেমেয়ে। এরা প্রায় সবাই মায়াকে চেনে। মায়ার পাশে আমাকে দেখে অনেকের চোখেই কিছুটা অবাক দৃষ্টি। সূর্য তখন অনেকটা গাঢ় লাল রং ধারণ করে পশ্চিম আকাশে ঢেলে পড়ার জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেশ খানিকটা জোরে বাতাস বইছে। খুব ভালো লাগছে। এখানে অনেকটা জোর নিশ্বাসে প্রকৃতির মুক্ত বাতাসের স্বাদ বুক ভরে নেয়া যায়। বাতাসে মায়ার মাথার পরিপাটি চুলের অবাধ্য কিছু বেরিয়ে আসা কেশরাশি কেমন জানি বাতাসের মৃদুল দোলানিতে উড়ে চলছে। এখানকার বেশির ভাগ নারীর চুল বিভিন্ন আঙ্গিকে সাট্ দেয়া। কিন্তু মায়ার ক্ষেত্রে বাতিক্রম। তার বেশ লম্বা কেশ।
নীরবতা ভেঙে মায়া বলল, তোমার হাতটা একটু দেবে?
আমি বললাম, তোমাদের জায়গাটা বেশ সুন্দর।
কোন জায়গা?
যেখানে তুমি আর আমি একসঙ্গে হাঁটছি।
তোমার হাতটা দেবে?
তোমার কেমন লাগছে আজকে আমার সাথে ঘুরতে?
অসম্ভব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, আকাশে উড়ে চলছি। তোমার হাতটা দেবে?
চলবে...