
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ৩৩
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মার্চ ৩০, ২০১৮
মায়া জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কে বলল?
যেই বলুক, তুমি ভালো নাচতে পারো কীনা এটা বলো।
হা হা হা... এমন খবর কোথায় পাও?
কবে দেখবো তোমার নাচ?
ধুর, এটাকে নাচ বলে নাকি?
কি বলে?
খ্যামটা নাচন।
হা হা হা... এটা আবার কেমন নাচ?
তুমি যাত্রা দেখছো?
অনেক আগে এলাকার এক যাত্রা প্যান্ডেলের ভেতরে মুখ আড়াল করে ঢুকেছিলাম, আহারে। ওইটা কী নাচ! নারী দেহের অশ্লীল প্রদর্শন ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
এবার বুঝছো? আমার নাচ এমনই।
আমি তো তোমার দিওয়ানা হয়ে গেলাম বন্ধু। বলো কবে দেখব তোমার এমন খুল্লা-খুলুম নাচ? আগে থেকে ডেটটা বলো। একশো এক টাকার নোট জোগাড় করে রাখতে হবে।
এক টাকার নোট দিয়ে কি করবে?
আরে বলো কী! তুমি নাচবে আর আমি তোমার দিকে টাকা ছুড়ে দেব না?
তাই বলে এক টাকার নোট? আমি কি এতই খারাপ নাচি?
আরে বাবা, এখানে খারাপ নাচের প্রসঙ্গ আসবে কেন? তুমি নাচবে এটাই বড় কথা। তোমার দিকে পাঁচশো টাকার নোট ছুড়ে মারার সামর্থ তো আমার নেই। এছাড়া এক টাকার কয়েনও ছুড়ে মারা যাবে না। যদি নরম শরীরে ব্যথা পাও?
হা হা হা... আমার ওই নাচ দেখে ঠিক থাকতে পারবা তো?
তা ঠিক, অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছো। অন্যেরা কি করে?
ওই মিয়া, আমি কি নাচি?
তাহলে কি করো?
আমি তো হুদাই আমার কাপড় আলগা করে শরীর দোলাই। আর তারা ইশ-আশ করে। সারারাত ধরে খদ্দেররা সব ওই গুলোয় করে?
সারারাত ধরে কি শুধু এই? বসে কখন?
আরে, বসার সময় কই? সারারাত ধরে মদ খাওয়া, চিপে ধরাধরি, হুদাই খামটা নাচন করেতেই তো ভোর, বসার সময় কই?
তুমি খ্যামটা নাচ বলছো কেন?
আরে, তখন তো শরীরে পোশাক থাকে খুবই কম। তাই এডারে খ্যামটা নাচ বলতাছি।
ও আচ্ছা। তাহলে তো এই নাচ দেখার রিস্ক না নেয়া ভালো।
তা ঠিক। এতে তোমার আমার বন্ধুত্বের বন্ধনটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ঠিক আছে বন্ধু, নাচ দেখার প্রোগ্রাম বাতিল। আজকে আমি চলে যাচ্ছি।
আমি চলে আসলাম ঢাকা। এর কয়েক সপ্তাহ পর ফের গেলাম দৌলতদিয়া ঘাট নিষিদ্ধ পল্লীতে। রশিদ ভাইকে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম পল্লীর দিকে। পল্লীর মেইন গেটের বাম পাশে অবস্থিত সিনেমা হলের সম্মুখ রাস্তা দিয়ে আমরা হাঁটছি। গ্রামীণ রাস্তার মেঠোপথের অসাধারণ দৃশ্য দু’পাশে। আগে এ রাস্তা দিয়ে আমি পল্লীতে ঢুকিনি। আজই প্রথম। রাস্তার দুপাশের পরিবেশে কোনও নিষিদ্ধ পল্লীর ছাপ দেখা যায় না। এখানে নিষিদ্ধ পল্লীর যৌনকর্মীদের পাশাশাশি কিছু স্থানীয় অধিবাসীদের বাড়িঘর রয়েছে। এই ঘনবসতি জায়গা থেকে মূল পল্লীর জায়গাটি একটি বড় খাল-নালা দ্বারা বিভক্ত। এই খালটি সরাসরি গিয়ে মিশেছে মূল পল্লীর মেইন গেটের ডানপাশ বরাবর। খালের দুপাশেরই কিছু জায়গা দখল করে নির্মিত হয়েছে পল্লীর যৌনকর্মীদের বসবাসের জন্য বাঁশ ও টিনের দ্বারা প্রস্তুতকৃত ছোট ছোট ঘর। আমরা খালটির পানির সীমানা বরাবর গিয়ে দাঁড়ালাম। খালের ধারে বেশ কিছু নতুন-পুরনো ডিঙি নৌকা পড়ে রয়েছে। দুজন কর্মী দায়িত্ব নিয়ে বেশ সূচারুভাবে একটি নতুন ডিঙি নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত। আমি বেশ কিছু দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করলাম। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখছি। এরই মধ্যে একটি ডিঙি নৌকা চলে এলো আমাদেরকে নিয়ে ওপারে পার করে দিতে।
এখানে বেশ কয়েকটি নৌকা চলে এপার-ওপারের মানুষদের চলাচলের জন্য। প্রতিজন দু’টাকা। আমরা পার হলাম। ওপারে গিয়ে নামতেই বেশ কিছু খালি ঘর দেখলাম। এ জায়গাটি মূলত পল্লীর পিছনের অংশ হওয়ায় এখানে খুব পরিচিত মানুষজন ছাড়া কেউ আসতে চায় না বা আসতে পারে না। এ জায়গাটি পল্লীর মূল গেইট থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। এখানে আগত কোনও মিডিয়া কর্মী কিংবা নতুন খদ্দেররা এতদূর ভিতরে আসতে চায় না। এ জায়গাটি অনেক নীরব। ভয়ের কারণ হতে পারে যেকোনও মানুষদের কাছে। এখান থেকে কিছুটা রাস্তা পাড়ি দিলে অনেক বড় জঙ্গল, গাছগাছালি। আমরা জায়গাটি দেখার জন্য জঙ্গলটি পেরিয়ে সামনের দিকে চলে গেলাম। আসলেই খুব ভীতিকর পরিবেশ। গা ছমছম করে। এখানে কেউ আমাদেরকে ধরে মেরে ফেললে কাকপক্ষিও জানতে পারবে না। যদিও মাথার ওপর প্রচুর পাখি কিচিরমিচির করছে। আমরা জঙ্গলটি পার হলাম। সামনে পানি আর পানি। পদ্মার পানি নীরবে কলকল করেরে এগিয়ে চলছে দক্ষিণের পথে। উত্তরের দিকে মুখ ফিরালেই চোখে পড়ে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। অসাধারণ! গা ছমছম করা ঐশ্বরিক দৃশ্য। এখান থেকে আর বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না। অসাধারণ প্রকৃতি। একটি বিধাতার সৃষ্টি অপার মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, অন্যটি মানুষদের দ্বারা সৃষ্ট ঘিঞ্জি লোকালয় নিষিদ্ধ পল্লী। আমরা এবার পিছন ফিরে পল্লীর দিকে হাঁটা দিলাম। আমরা যে স্থানে গিয়েছিলাম সেটি পল্লী থেকে এক মানুষ সমান নিচু। স্বাভাবিকভাবেই আমরা ঢালু অতিক্রম করে ওপরের দিকে উঠছি। ঢাল বেয়ে প্রথমেই উঠলাম এক আপার বাসায়। ওনার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। বাড়িটা বেশ বড়সড় জায়গা নিয়ে তৈরি। বেশ কয়েকটা ঘর। কিছু ঘরে যৌনকর্মী ভাড়া নিয়ে থাকলেও কয়েকটি ঘর এখনও ভাড়া হয়নি। এখানে সাধারণত নতুন কোনও মেয়ে ঘর ভাড়া নিতে চায় না। কারণ এতদূর থাকলে নতুন খদ্দের পাওয়া বেশ কঠিন। তাই বেশির ভাগ নারী যারা এখানে থাকে তাদের প্রত্যেকেরই পার্মানেন্ট কিছু খদ্দের রয়েছে। যারা অনায়াসেই এখানে আসতে সমস্যা অনুভব করে না। আপার বাবু বেশ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির মানুষ। সে মাঝে মধ্যেই এখানে আসে। সে বিভিন্ন খুন-খারাপির সাথে যুক্ত। অনেকেই তাকে ভয় পায়। এরকম অসংখ্য ভয়ংকর মানুষদের প্রতিনিয়ত চলাচলের জায়গা এটি। আমরা আপার রুমে গিয়ে কিছুটা সময় বসলাম। অনেক কথা হলো। রশিদ ভাইয়ের সাথে তার আগের পরিচয় ছিল। রশিদ ভাই কেকেএস এনজিও হয়ে এই পল্লীর দেখাশোনা করার কারণে তার প্রচুর চেনাজানা। সবাই তাকে চেনে এবং সম্মানও করে। রশিদ ভাই প্রচণ্ড সাহসী একজন মানুষ। আমরা আপার ঘরে বসে চা খেলাম, এরপর বিদায় নিয়ে পল্লীর ভিতরের দিকে হাঁটা দিলাম।
চলবে...