
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ৩৯
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০১৮
এরকম মুখমণ্ডল এভাবে দেখবো, বুঝে উঠতে পারিনি। আমার চোখের অনুভূতি কিছুটা হলেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাই সঙ্গে সঙ্গে ওনার ঘাড়ের ওপর থেকে ওড়নাটি টেনে নিজের মুখমণ্ডল ঢেকে ফেলেছিলেন। মর্জিনা আপার ছোট বোনটি ছিল অসম্ভব সুন্দরী। তিনি যেমন ছিলেন সুন্দরী, তেমনি ছিলেন সাহসী। সম্ভবত ২০০০ সালের দিকে রাজবাড়ি জেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন জায়গাতে যাওয়ার জন্য নিষিদ্ধ পল্লীর নারীদের খালি পায়ে হেঁটে যেতে হতো। বাজার কিংবা মার্কেটে যেখানেই তাদের প্রয়োজন থাকুক না কেন, যৌনকর্মীরা তাদের পায়ে সান্ডেল পরে বাইরে যাবার অধিকার ছিল না। এই পল্লীর মানুষেরা মারা গেলে তাদের জানাজা করার কিংবা বিভিন্ন ধর্মমতে সৎকার করার সুযোগও ছিল না। তাই তারা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মৃত দেহ হয় পুড়িয়ে দিতেন, না হয় পদ্মার পানিতে ভাসিয়ে দিতেন। মাটিতে পুতে রাখার সামান্য পরিমানের জায়গাও ছিল না। সেই ধরেনের অসংখ্য অন্যায়ের প্রতিবাদ মুখর নেত্রী ছিলেন মর্জিনা আপার ছোট বোন। তাদের বহু আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে অর্জন হয় নিজেদের মৃতদেহের মাটি দেয়ার সামান্য পরিমান স্থান, যা স্থানীয় প্রশাসন এই পল্লীর নামে বরাদ্দ দিয়েছে।
অনেক ত্যাগের পরে তারা ফিরে পেয়েছে জুতা-সান্ডেল পরে বাইরে বেরোনোর অধিকার। সেই রকম এক আন্দোলনের সময় মর্জিনা আপার ছোট বোন বাইরের মানুষদের দ্বারা এসিড নিক্ষেপের মতো ভয়ানক আক্রমণের শিকার হন। এ কারণে তার মুখমণ্ডলসহ প্রায় সমস্ত শরীর একেবারেই পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। বেঁচে থাকে তার এসিডে পোড়া অভিশপ্ত দেহ। রাতের আঁধারে দূরের কথা, দিনের আলোতেও তার মুখমণ্ডল দেখলে যে কোনও বিবেকবান মানুষ আঁতকে উঠবে। যেমন আঁতকে উঠেছিলাম আমি। তিনি আমার দিকে মুখ তুলেই প্রথমে বেশ কড়া মেজাজে সাংবাদিকের তুলোধোনা করে ছাড়লেন। আমি তেমন কেউ নয়, আমি আপনাদেরই একজন বলতেও তার বিশ্বাস হয় না। তিনি আমার সাথে কথা বলতেই রাজি হচ্ছেন না, এর মধ্যে মর্জিনা আপা এসে তার বোনকে আমার কাজের বিভিন্ন বিষয়ে বর্ণনা করলেন। উনি আমাকে বুঝার চেষ্টা করলেন। মর্জিনা আপা বললেন, মেহেদী ভাই আমাদের লোক, তিনি কোনও এনজিওর নয়, একেবারেই নিজ উদ্যোগে আমাদের জন্য ডকুমেন্টরি তৈরি করে দিচ্ছেন। তিনি এবার অনেকটা সহজ হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন, বললেন তার জীবনের বহু কাহিনি। তার কষ্ট যে মানুষটি আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করলো, যাকে নিয়ে আমি ভালো হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, যারা প্রতিনিয়ত আমার নোংরা শরীরের উপর অবলীলায় সাঁতার কেটেছে দিনরাত, তারাই আমার শরীরের উপর নিক্ষেপ করেছে এসিড। এলোপাথারি কুপিয়েছে, চেষ্টা করেছে হত্যা করার। কিন্তু আল্লাহ আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। আজকে আমি হারিয়েছি আমার স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সকল ক্ষমতা। হারিয়েছি সকল সৌন্দর্য। বেঁচে আছি অন্যের সহানুভূতির উপর। এখন এখানে থেকে দেহ ব্যবসা করারও সুযোগ নেই আবার আমার। এ চেহারা নিয়ে বাইরের জগতে গিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকারও সুযোগ নেই। আছে শুধু বুকফাটা কান্নার আহাজারি।
তার সাথে কথা বলতে বলতে আমরা চা খেলাম। চা পান শেষে আমরা আপার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। সন্ধ্যার আগমনের বার্তা যেন আসি আসি করছে। আমি রশিদ ভাইকে নিয়ে পল্লীর বাহিরে বের হয়ে আসলাম। বিদায় নিলাম সেদিনের জন্য পল্লীর সেই অব্যক্ত বেদনাযুক্ত আবহাওয়া থেকে। পরের সপ্তাহে দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছলে প্রথমেই আনোয়ারকে ডেকে নিলাম কেকেএস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আনোয়ার ও সাগর দুজনই উপস্থিত হলো আমার সামনে। দুজনই বেশ স্মার্ট, আনোয়ার বেশ লম্বা কিন্তু সাগর কিছুটা খাটো। দুজনই একসঙ্গে রাজবাড়ি কারিগরি কলেজ থেকে ডিপ্লোমা করছে, দুজনই বেশ মেধাবী। আনোয়ার আমার ডকুড্রামার প্রধান নায়কের চরিত্রে অভিনয় করবে। আনোয়ারের মা ছিলেন এই পল্লীর একজন যৌনকর্মী। তিনি মারা গেছেন। আনোয়ার তার নানীর সাথেই বসবাস করে। সে পড়ালেখার পাশাশাশি একটি বাসের কন্ট্রাক্টরির চাকরি করে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে। এজন্যই সে বেশির ভাগ সময় রাজবাড়ীতে কাটায়। মাঝে মধ্যে এসে নানীর সাথে দেখা করে যায়। আমরা গল্প করতে করতে পল্লীর দিকে পা বাড়ালাম। আনোয়ার তার নানির সাথে দেখা করবে বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি ও সাগর রওনা দিলাম তার বাড়ির দিকে। উদ্দেশ্য, তার পরিবারের সাথে আমি পরিচিত হবো। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সাগরের বাড়ির দিকে...
চলবে