
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ৪০
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০১৮
আমি সাগরকে নিয়ে বিভিন্ন গলিপথ পেরিয়ে তার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাগর বেশ কিছুদিন থেকে বলছিল, মেহেদী ভাই, আম্মা আপনারে খুব দেখতে চায়, কবে যাবেন? তারই ধারাবাহিকতায় আজকে সাগরের বাড়িতে আসা। সাগরের মা ছিলেন এ পল্লীর একজন যৌনকর্মী। এখন তিনি বাড়িঅলা। বাড়িতে ঢুকতেই হাতের ডানপাশে রয়েছে একই লাইনে তিনটা ঘর। দরজার মুখের ঘরেই থাকে রুপালি, তার ৮-৯ বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটি বেশ সুন্দর। তাকে দেখে মনেই হবে না যে, সে এখানে নোংরা পরিবেশে বেড়ে উঠছে। রুপালি সাগরের মাকে খালা ডাকে। সেহেতু রুপালির ছেলে সাগরের মাকে নানি ডাকে। রুপালিকে দেখলে মনে হবে না তার একটি ৮-৯ বছরের সন্তান রয়েছে। সে দেখতে বেশ সুন্দর। সম্ভবত অল্প বয়সেই বাচ্চাটি নিয়ে নিয়েছে। উচ্চতায় একটু খাটো, তাই তাকে দেখলে ছোট মেয়েদের মতো মনে হয়। রুপালির চোখে মুখে যেন উপরঅলা সব সময় একঝলক মিষ্টি হাসি দিয়ে রেখেছে। সে যে কোনও কথাতেই মিষ্টি করে হেসে দেয়। অসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে সে বেশি পছন্দ করে। সে সালোয়ার কামিজ পরার চেয়ে শাড়ি পরতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। সে যেনতেন শাড়ি পরে না। সে সবসময়ই বেশি দামি শাড়ি পরে ঘুরতে পছন্দ করে। তার হাতে সব সময় শোভা পায় দামি মডেলের মোবাইল সেট। ভাগ্য বটে। তার একজন বাবু আছে। বাবুর বয়স সম্ভবত ৫০-৫৫ বছর হবে। বাবু সব সময় তার ও তার সন্তানের খোঁজখবর রাখে। যে কোনও সময়ই প্রয়োজন মাফিক রুপালির কাছে খরচের টাকা পাঠায়। সে অনেকটাই খুশি এরকম বয়ষ্ক একজন বাবু পেয়ে। আমি এ পল্লীর যতগুলি মেয়েদের ঘরে গিয়েছি তাদের সবার তুলনায় রুপালির ঘর সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো। ঘরে রয়েছে দামি খাট। সুন্দর ড্রেসিংটেবিল। কাপড় রাখার সেল্ফ। এত সুন্দর পরিপাটি করে রাখা ঘরে শুয়ে থেকে একটু রেস্ট নেয়ার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। আমি সোজা তার খাটের উপর দুপা তুলে শুয়ে পড়লাম।
রুপালি বলল, ভাই, সাগরের কাছে আপনার অনেক কথা শুনেছি। আপনে অনেক ভালো মানুষ। আপনি সরাসরি আমাদের বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন?
কেন? আমি কি অন্যায় করলাম?
না, আপনি অন্যায় করেননি। আমাদের মতো যৌনকর্মীদের বিছানায় শুইতে অন্যায়ের চেয়ে বড় কথা, রুচিবোধ। সবার তো রুচি হয় না আমাদের বিছানায় এভাবে শুয়ে পড়ার।
সবার সাথে আমি আমাকে মিলাই না। আমি শুধুই আমি। আমি চলি আমার মতো করে। কে কি বলছে, কে কি ভাবছে, ঐটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি কোনও টিভি চ্যানেলের হয়ে এখানে আসিনি। আমি এখানে কোনও এনজিওর হয়ে আসিনি। আমি আমার ব্যক্তিগত টাকা খরচ করে তোমাদের নিয়ে কাজ করতে, তোমাদের জীবন সম্পর্কে জানতে এখানে এসেছি। আশা করি, তুমি বুঝতে পেরেছো?
মেহেদী ভাই, আমি এখানে ছোটবেলা থেকে আছি। জীবনে বহু পুরুষ মানুষ দেখলাম, অনেক মানুষ আমাদেরকে নিয়ে কাজ করেছে, কাউকে আপনার মতো মনে হয় না বা হয়নি। সবাই আপনার প্রশংসা করে।
সবাই প্রশংসা করে মানে?
সবাই মানে, এ পল্লীর যেসব মেয়েই আপনার সাথে মিশেছে, তারাই আপনাকে ভালো বলে। আমার মা আপনার জন্য তো পাগল।
তোমার মা?
সাগর ভাইয়ের মাকে আমি মা বলেই ডাকি।
তুমি না আগে খালা ডাকতে?
প্রথম প্রথম কিছুদিন খালা ডাকছি। খালা ডেকে মন ভরে না, তাই মা বলে ডাকি।
মা বলে কি ডাকতে তোমার ভালো লাগে?
নিজের মা নেই। কতদিন নিজের মাকে দেখি না। মায়ের জন্য বুকটা শুধু কাঁদে। আমার ছেলে যখন আমাকে মা বলে ডাকে, তখন বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। কাকে মা বলে ডাকব? আমার মাকে দেখতে পাই না। তাই সাগরের মাকেই মা বলে ডাকি। তিনিও আমাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।
এতে কি তোমার কষ্ট কিছুটা কমে?
মা তো মা-ই। মায়ের অভাব কি অন্য কাউকে দিয়ে মিটে? তারপরও খালাকে যখন মা বলে ডাকি তখন সারাদিনের কষ্ট, ঘৃণা, অবসাদ পুরাটাই নিমেষেই দূর হয়ে যায়।
বাহ! তুমি সুন্দর কথা বলো। তোমার ছেলেকে তোমার কাছে রেখেছো কেন?
হোমে দিয়েছিলাম। শুধু কান্নাকাটি করে। তাই বাধ্য হয়ে তাকে আমার কাছেই রাখি।
তুমি যদি তোমার বাচ্চাকে তোমার কাছে রাখ তাহলে তার ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে। তাকে নিয়ে বিকল্প কিছু ভেবেছো?
চলবে