মারিয়া সালামের গদ্য ‘স্মরণে ও শ্রদ্ধায় আমানউল্লাহ খান’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৪
আমানউল্লাহ খান স্যার আর নেই। কিছুক্ষণ আগে জানতে পারলাম, স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। স্যারের সাথে পরিচয় ইউএনবিতে। হঠাৎ করেই উনি আমাকে খুব স্নেহ করা শুরু করলেন। সবকিছুতেই মারিয়া। বয়স হয়েছিল বলেই কিনা মাঝে মাঝে শিশুদের মতো জেদ করতেন। একদিন অফিসে গিয়েই হাতে চিঠি পেলাম, আমার নিয়মিত কাজের পাশাপাশি স্যার আমাকে উনার বিশেষ সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টা কেউ পছন্দ করছিল না। আমি নিজেও খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।
কিন্তু স্যার তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। এরকম অনেক সিদ্ধান্ত উনি নিতেন আমাকে অতিরিক্ত কিছু সুবিধা দিতে। সেটার জন্য আমাকেও বিপদে পড়তে হতো। উনি নিজেও নানারকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতেন। উনি বলতেন, এসবে কান দেবে না, মন দিয়ে কাজ করে যাও।
হ্যাঁ, স্যার আমার কাজের ধরন খুব পছন্দ করতেন এবং সেজন্যই সুযোগ পেলেই আমাকে কিছু সুবিধা দিতেন। তার পরিবর্তে আবার কাজের চাপও দিতেন।
এরপর, আন্টিও আমাদের দলে যুক্ত হলেন। ছোটখাটো যেকোন সমস্যায় আন্টি ডেকে পাঠাতেন। সপ্তাহে একদিন অন্তত উনাদের সাথে লাঞ্চ করতে হতো আমার। টেবিলে দুজন দুদিকে বসে আমাকে খাওয়াতেন। মাঝেমধ্যে খুব বিরক্তও হতাম। দেশের বাইরে গেলেই আন্টি আমার পছন্দের শাড়ি নিয়ে আসতেন, জন্মদিনে গয়নাও দিতেন। একবার একটা আন্তর্জাতিক মিটিংয়ে উনারা আমাকে নিয়ে গেলেন বালি। সেখানে আমার প্রতি উনাদের স্নেহ দেখে সবাই ভেবে নিয়েছিল, আমি উনাদের কন্যা। একজন স্যারকে বলেছিল, ইয়োর ডটার ইজ আ মডেল অ্যান্ড ইউ আর আ রোল মডেল।
স্যার কথাটা খুব পছন্দ করলেন, প্রায় বলতেন আমাকে কথাটা। আমার প্রথম বই ‘নীলকণ্ঠী’ বের করার ব্যাপারে সবচেয়ে উৎসাহী ছিলেন স্যার। উনার কবি, সাহিত্যিক, প্রকাশক বন্ধুদের ডেকে আয়োজন করলেন মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। অনেক পড়তেন আর অন্যদেরও পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। উনার বিশাল লাইব্রেরি আছে। সেখান থেকে বই দিতে চাইতেন না। আমি সুযোগ বুঝে বেশ কয়েকটা বই চুরি করেছিলাম। ব্যাপারটা বুঝে উনি বলেছিলেন, তুমি আর লাইব্রেরির দিকে যাবে না। তোমার আন্টির সাথে ড্রয়িংরুমে বসে থাকবে।
শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। আমার ছেলেদের সবসময় এটা-সেটা কিনে দিতেন। প্রায় দিন জেদ করতেন নিসর্গকে নিয়ে যেন বিকেলে উনার ওখানে যাই। উনি নিসুকে নিয়ে ছাদে ঘুরতেন, গল্প করতেন। আমার মা-বাবার বাইরে এই দুজন মানুষ নিজের সন্তানের মতো করে আমাকে ভালোবাসতেন, শর্তহীন ভালোবাসা।
অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করতাম দেখে স্যার বিভিন্নভাবে অর্থ সহায়তা করতেন আমার মাধ্যমে। উনার দানে কত শিশুর যে অন্ন জুটেছে! উনি একবার আমার ভরসায় একজনের মাধ্যমে মোটা একটা টাকা ব্যবসায় লাগালেন। কথা ছিল, সেই লাভের টাকায় আমরা একটা অটিস্টিক শিশুদের হোম চালাবো। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি এবং আমার ব্যক্তিগত কিছু সমস্যায় সেই টাকা উদ্ধার করে আর স্যারকে দিতে পারলাম না। স্বভাবতই আমি খুবই লজ্জিত ছিলাম। যোগাযোগ করতাম কম। শেষ যেদিন কথা হয়েছিল সেদিন স্যার বলেছিলেন, তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই।
কিন্তু, সেই গ্লানি আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। তবে নিজের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে আমি স্যারের নামে এসব বাচ্চাদের সাথে এখনও আছি, থাকব আজীবন।
আমার প্রকাশিত সাহিত্য পোর্টাল ‘ছাড়পত্র’তে উনি নিয়মিতভাবে ভালো একটা টাকা দিতেন। নিজের বাড়ির নিচতলায় অফিস করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেখান থেকে চার-পাঁচজন বেকার ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান করেছিলাম। কোভিডের পরে কোনো কারণে সেই সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপরও আমার পত্রিকাতে স্যারকেই আমরা প্রকাশক হিসেবে রাখতে চেয়েছি। এখনও তিনিই ছাড়পত্রের প্রকাশক।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী