রংবাজ

উপন্যাস ৫

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৮

বাবু মন দিয়ে পড়ছে, আর মাত্র চারদিন পর মেট্রিক পরীক্ষা। ওর বাইরের দিকের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ে, ও দরজা খোলে। দাঁড়িয়ে আছে রিপন, ঘামছে দরদর করে। ও প্রশ্ন নিয়ে তাকায় রিপনের দিকে। রিপন বলে ওঠে, কিসমত শেষ, পইড়া আছে বনগ্রামের মাথায়।

বাবু: আমি এখন কি করুম? বাসায় থাকুম, না যামুগা?
রিপন: তুই থাক, তুই গেলেগা একটু সন্দেহ করতে পারে পুলিশ।
এই বলে রিপন আর দেরি করে না, চলে যায়। বাবু আবার মন দেয় পড়ায়। অনেক বাকি এখনও। ঠিক রাত সাড়ে ৯ টার দিকে ওর দরজায় আবারও নক। দরজা খুলে দেয়, হুড়মুড় করে একদল পুলিশ এসে ওর ঘরে ঢোকে। ও ভীষণ চমকে যায়। ওকে জিজ্ঞাসা করে পুলিশরা, তোর নাম কি?
বাবু।
একজন ওর কলার চেপে ধরে, আরেকজন বলে, চল।
কোথায়?
তোর শশুর বাড়ি ।
আমি তো কিছু করি নাই ভাই।
গোয়ায় দুইটা বাড়ি দিলেই দেখবি ক্যামনে বাইরাইয়া যায় ক্যামনে মারছস কিসমতরে।
আমি কিচ্ছু জানি না ভাই।
এবার পুলিশ বলল, তাইলে তো কোনো অসুবিধাই নাই, আগে চল থানায়, তারপর দেখা যাইবো।
বাবু বলল, ঠিক আছে ভাই, আমি একটু প্যান্টটা পইরা নেই।
প্যান্ট লাগবো না, এমনি তোরে হিরো লাগতেছে।

ওরা বাবুর কোনো কথা শোনে না, হিড়হিড় করে টানতে টানতে গলির বাইরে বনগ্রাম রোডে নিয়ে আসে। বাবু লজ্জায় মরে যায়, কোমরে দড়ি বাঁধা, পুলিশ একহাতে কলার ধরে আছে। পরনে লুঙ্গি, সার্টটা অলমোস্ট ছিঁড়ে গিয়েছে। ওকে দেখতে একেবারে রাস্তার ক্রিমিনাল লাগছে। তাড়াহুড়ার ঠ্যালায় ও স্যান্ডেলটা পর্যন্ত পরতে পারেনি। খালি পা, ছেঁড়া সার্ট, পুরান ত্যানা মার্কা নরম লুঙ্গি– উফফ কী যে অসম্মানজনক লাগছে ওর নিজের কাছে, যা বলে বোঝানো সম্ভব না।

পাড়ার আশপাশের দোকান ও বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে লোকজনরা ওর দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে আর কানাঘুসা করছে। ওর মরে যেতে ইচ্ছা করছে। পুলিশ ওকে টানতে টানতে গাড়িতে উঠিয়ে ফেলে, ও নীরবে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি ছেড়ে দেয়। সোজা বেরিয়ে আসে টিপু সুলতান রোডে এবং বাঁয়ে ঘুরে যায়। মিনিট বিশেক পর পৌঁছে যায় সুত্রাপুর থানায়।

আজ থানায় প্রচুর ভিড়। থানায় ঢুকে সিঁড়ি ৫/৬ কদম উপরে উঠেই বারান্দাটা। বারান্দা পেরিয়েই অফিস রুমটা। জনাচারেক ইন্সপেক্টর ও সাব ইন্সপেক্টর ওখানে বসে। ঐ অফিস পেরিয়ে বাঁয়ে ঘুরলেই একটা ছোট গলির মতো জায়গা। ঐ গলি ধরে ২০ ফিট এগোলেই হাতের বাঁয়ে পড়ে থানার হাজত। অনেক পুরোনো হাজত, মেঝেটা দেখে মনে হয় লোম উঠে যাওয়া কুকুরের মতো, ভীষণ এবড়ো থেবড়ো। ভিতরটা ভীষণ অন্ধকার। একটা দেয়ালের বেশ উপরের দিকে একটা ছোট্ট জানালা। সিনেমায় দেখানো হাজতের জানালা দিয়ে গলে বেরিয়ে যাওয়া দেখালেও বাস্তবের এই জানালা দিয়ে কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব নয়। ছাদটা অনেক উঁচু যেহেতু বেশ পুরোনো বাড়ি। অনেক উপরে একটা বাতি ঝুলছে ইলেকট্রিক তারে। বাতিটা জ্বলে আছে কিন্তু খুবই কম পাওয়ার, কেমন যেন হলদেটে একটা আবহ সৃষ্টি করে রেখেছে। ঐ বাতির আলো আঁধারিতে দেখা যাচ্ছে দাগি আসামীদের ঘর্মাক্ত কঠিন চেহারাগুলো। ১০ ফিট বাই ১২ ফিটের ঐ ঘরের এক কোনায় হাউজের মতো, তিনদিকে ছোট্ট দেয়াল তোলা, দুই আড়াই ফিট উঁচু হবে দেয়ালটা। ওটা হলো আসামীদের শৌচাগার। ওপেন কনসেপ্ট শৌচাগার অর্থাৎ শুধু তিনদিকে ঐ দুই ফিটের দেয়ালটাই আছে, আর কোনো দরজা বা প্রাইভেসির জন্য কোনো ব্যবস্থা নাই। যার যখন লাগছে, ওখানে যেয়ে বসে পড়ছে, সারছে, আবার ফিরে আসছে। বাকিরা ওদিকে তাকাচ্ছে না, তবে দুর্গন্ধ ভাগাভাগি করছে। কিচ্ছু করার নাই, জীবন যেখানে যেমন।

বাবুকে ওরা ঐ হাজতের সামনে এনে লোহার শিকের দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। বাবু নিঃশব্দে একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মাটিতে বসে থাকা একজন আসামি বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, এই তুমি বনগ্রাম থাকো না?
বাবু জবাব দিল, জি। বাবু চিনে ফেলে লোকটাকে, বনগ্রামের নামকরা রংবাজ, নাম গোপাল। গোপাল ওর দিকে তাকিয়ে একরাশ আশ্চর্য নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুমিতো ভালো পোলা, তোমারে এইখানে নিয়া আইছে কেন? কি কেসে আইছো?
বাবু: আমি এখনও জানি না আমার বিরদ্ধে কি ইলিগেশন। তবে আমাদের বাড়ির উপরে থাকতো কিসমত, ও আজ সন্ধ্যায় গুলি খাইছে টিপুসুলতান রোডের মাথায়, মরে গেছে। পুলিশ আমাকে সন্দেহ করে ধরে নিয়ে আসছে।

গোপাল: কও কি! মার্ডার কেসে আইসো?
বাবু: আমি আসলে জানি না কোন কেস।
গোপাল চুপ হয়ে যায়। বাবু মাথা নিচু করে মাটিতে বসে থাকে। একেকটা মিনিট ওর কাছে একযুগের মতো মনে হয়, সময় কাটতে চায় না। ছবিতে দেখা হাজতের চাইতে এই হাজত অনেক বেশি অসহনীয় নোংরা। ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, ভীষণ কান্না পায়, মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এভাবে কাটতে থাকে সময়। দেখতে দেখতে কখন যেন রাত ১২টা বেজে যায়। ছোট্ট একটা ঘর, বেশ কিছু মানুষ, প্রায় ঠাসাঠাসি অবস্থা। আশপাশের আসামীরা কখন যেন ঘুমে ঢলে পড়ে যে যেখানে যেভাবে পারে। বাবুর চোখে ঘুম নেই, আছে শুধু একরাশ টেনশন, খুব ভয় লাগছে ওর।

চলবে