মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৬০

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০১৯

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন ক্ষুদ্র বোহরা সম্প্রদায়ভুক্ত শিয়া গোত্রের মুসলমান। বেশিদিনের নয়। তার পিতা পার্সি থেকে মুসলমান হয়েছিলেন। পরিবারে মুসলিম সংস্কৃতি চালু ছিল না মোটেই। নামাজ-রোজা বা অন্যান্য ইসলামি আচরণ সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিলেন জিন্নাহ। কেউ কোনোদিন তাকে নামাজ পড়তে দেখেনি। আমার দাদার মুখে শুনেছি, সিরাজগঞ্জে মুসলিম লীগের একটি জনসভায় এসেছিলেন জিন্নাহ। আসরের নামাজের সময় হলে উপস্থিত সবাই কাতারবন্দি হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। কেবল একজন নামাজে যোগ দিলেন না। তিনি জিন্নাহ। নামাজের সময়টুকু মঞ্চে বসে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছিলেন তিনি একের পর এক। পরেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ভারতভাগ ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদে তিনি বোম্বাই শহরে তার বাড়িতে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যাহ্নভোজে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অথচ তখন রমজান মাস চলছিল। তিনি হজ করেছেন বলেও শোনা যায়নি। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের স্তম্ভ হিসাবে পরিচিত নামাজ-রোজ-হজ-যাকাত সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। ইসলামি শাস্ত্রে তাত্ত্বিকও ছিলেন না তিনি।

বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি। জ্ঞানীও। ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিয়েই ব্যারিস্টারি পড়তে চলে গিয়েছিলেন ইংলন্ডে। পাশ করে এসে ভালো আইনজীবী হিসাবে সুনামও কুড়িয়েছিলেন। রাজনীতিতে আসেন দাদাভাই নওরোজির হাত ধরে। যোগ দিয়েছিলেন কংগ্রেসে। সেই তিনিই পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতা। তাকে ‘কায়েদে আজম’ উপাধি দিয়েছিলেন গান্ধী। তিনি জিন্নাহকে হিন্দু-মুসলমান মিলনের দূত বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার কারণে সুবিধাভোগী অসংখ্য রাজনীতিবিদদের মধ্যে জিন্নাহও একজন ছিলেন।

তবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে যা আমাদের পড়ানো হয়, দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক হচ্ছেন জিন্নাহ, এই তথ্যটি পুরোপুরি ভুল, অসত্য, এবং সম্ভবত উদ্দেশ্যমূলকও। ক্ষমতার বড় একটি পদ লাভের জন্য জিন্নাহ ভারতের মুসলিম সমাজকে ব্যবহার করছিলেন সত্য। তবে এতবড় মৌলিক এবং ভুল তত্ত্ব আবিষ্কার করার মতো মনোযোগ তার ছিল না।

দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা প্রথম উল্লেখ করেন লালা লাজপৎ রায় তার পত্রিকায় ১৯২৩ সালে লেখা প্রবন্ধে। তিনি দাবি করেন ভারতের হিন্দু এবং মুসলমানরা দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক জাতি। জাতি হিসাবে পৃথকত্ব প্রমাণ করার জন্য যে নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তির দরকার হয়, সেগুলি ছাড়াই লালা লাজপৎ রায় এই দ্বিজাতি তত্ত্বটি ঘোষণা করেন। তিনি মনেও রাখেননি যে হিন্দু বলে যারা নিজেদের পরিচয় দেন, তারাও একজাতির মানুষ নন। তাদের মধ্যেও অনেক জাতি এবং জাতিমিশ্রণ রয়েছে। তারও আগে ১৮৭৫ সালে হিন্দুত্ববাদের মাধ্যমে দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভাবনায় কিছুটা ভূমিকা রাখেন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী।

এই দ্বিজাতি তত্ত্ব শক্তিশালী হয় স্বাধীনতাসংগ্রামী ও পরবর্তীতে হিন্দুত্ববাদী বীর সাভারকরের হাতে। জেলে বসে তিনি ১৯২৩ সালেই লিখলেন একটি গ্রন্থ ‘হিন্দুত্ব: হু ইজ এ হিন্দু’। দাবি করলেন ‘হিন্দুরাই হচ্ছে ভারতীয় জাতি’। এই ১৯২৩ সালেই একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল রাজপুতানায়। সাধারণভাবে অন্য ধর্মের কাউকে হিন্দুধর্মে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু এই বছর প্রায় ৫০ হাজার মুসলমানকে হিন্দুধর্মে দীক্ষা দেওয়া হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়, এদের পূর্বপুরুষ মুসলমান রাজত্বে হিন্দু থেকে মুসলমান হতে বাধ্য হয়েছিল। তাই এদেরকে হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

১৯১৫ সালে গঠিত হয়েছিল ‘হিন্দু মহাসভা’। এরা গান্ধীর অহিংস এবং হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়বাদী চিন্তার বিরোধী ছিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে অবস্থান করেও পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য ও লালা লাজপৎ রায় এই চরম হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৯৩৭ সালে এটি পরিণত হয় সর্বভারতীয় হিন্দু মহাসভায়। এবং সভাপতি নির্বাচিত হন সাভারকর।

আরো কট্টর হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী সংগঠনের জন্ম হতে থাকে। ১৯২৫ সালে ডা. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠা করেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, আরএসএস নামে পরিচিত। ১৯৪০ সালে হেডগেওয়ারের মৃত্যুর পরে সভাপতি হন সদাশিব গোলওয়ালকার। তিনি আরএসএস-কে এক লক্ষ সদস্যের হাফপ্যান্ট এবং খাকিশার্ট পরা একটি আধাসামরিক বাহিনীতে পরিণত করেন। (এই গোলওয়ালকারের উদ্যোগেই ১৯৬৪ সালে আরএসএস-এর পাশাপাশি গঠিত হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ)। ভারতের স্বাধীনতার পরে গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে এইধরনের কট্টর হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনেরই সদস্য।

বলা হচ্ছিল বীর সাভারকরের কথা। হিন্দু মহাসভার সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৩৭ সালের ৩০ নভেম্বর এক প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেন, হিন্দু ও মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি। কাজেই জিন্নাহকে ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা’ বলে চলা মানে হচ্ছে ইতিহাসের ধারাবাহিক মিথ্যাচারকে সমর্থন করা।

ভারতের পাঠ্যপুস্তকে কী লেখা আছে জানি না। জানি না পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকের কথা। হয়তো তারা এটিকে তাদের জাতির জনকের জন্য গর্বের ব্যাপার মনে করে লিখেই রেখেছে। কিন্তু আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তকগুলিকে এই ভুল থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া উচিত। বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-বক্তাদের উচিত ইতিহাসের সত্যকে পুনস্থাপিত করা।

আরেকটি সম্ভাবনার কথা মনে এলো। ভারতে মুসলমান জনগোষ্ঠী ছিল হিন্দুর তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ মুসলিমরা ছিল সংখ্যালঘু। তদুপরি শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে। সরকারের উচ্চপদে তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যা কম। হিন্দুদের আরএসএস-এর মতো তাদের কোনো রেজিমেন্টেড সংগঠনও ছিল না। আবার ১৯৩৭ সালের ভোট পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে মুসলিম লীগ তেমন সংগঠিত শক্তি নয়। ভারতের কোনো প্রদেশেই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। যদিও সেই ভোটটি ছিল হিন্দু এবং মুসলমানদের জন্য আলাদা আলাদা। মুসলমানরা মুসলিম প্রার্থীকে ভোট দেবে, হিন্দুরা হিন্দু প্রার্থীকে ভোট দেবে। সেখানেও বাংলায় মুসলিম লীগ পরাজিত হয়েছিল শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির কাছে। অর্থাৎ সকল প্রদেশেই সরকার ছিল হয় কংগ্রেসের অথবা কংগ্রেস সমর্থিত। বাংলায় কংগ্রেস সমর্থন না দেওয়ায় পরবর্তীতে ফজলুল হককে মুসলিম লীগের সাথে জোট বাঁধতে হয়েছিল অবশ্য। মুখ্যমন্ত্রী (তখন সব প্রদেশেই বলা হতো প্রধানমন্ত্রী) পদের লোভে তিনি শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগেই যোগ দিয়েছিলেন।

প্রশ্নটা হচ্ছে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যায় এত কম, যাদের কোনো দৃঢ়ভিত্তিক সংগঠন ছিল না, যাদের হাতে সরকারের প্রভাব ছিল না, তারা কোন সাহসে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালাতে যাবে? কোন সাহসে দাঙ্গা বাধাবে? এ তো নিতান্ত সাধারণ জ্ঞানের কথা যে সংখ্যালঘুরা, বিত্তহীনরা, প্রভাবহীনরাই বেশি মরবে, মার খাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে তারা দাঙ্গা বাঁধাতে অগ্রণী ভূমিকা নেবে কোন যুক্তিতে?

দাঙ্গার ইতিহাসগুলোতে মুসলমানদেরই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়েছে। অথচ সেটি কেমন যেন শোনায়? এখন বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী দাঙ্গা বাধাচ্ছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে, এমন কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হবে কারো কাছে?

সেই সময়ে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান পাইনি কোনো বইতে। তবে একটা পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে শ্যামল চক্রবর্তীর ‘তিন প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে। দেখা যাচ্ছে ১৯০০ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছে ১৬টি। কিন্তু ১৯২৩ সালে বীর সাভারকরের দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার, রাজপুতানায় ৫০ হাজার মুসলিমকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা, ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার পর থেকে দাঙ্গার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ১৯২৩ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে দাঙ্গার সংখ্যা ৭২টি।

চিন্তাশীলদের জন্য নতুন ভাবনা এবং গবেষণার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক