রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ৫

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : মে ১৮, ২০১৯

তিন.
জকির বাবা ঝানু ব্যবসায়ী। এখন শুরু করেছেন জাহাজ ব্যবসা। জকির চোখে ওর বাবা পৃথিবীর সেরা মানুষ। বাবা জকিকে ব্যবসার অনেক কিছু শিখিয়েছেন। এই বয়সেই জকি নিজেকে ঝানু ব্যবসায়ী মনে করে। একটা ইংরেজি স্কুলে চলনসই ইংরেজি শিখেই জকি স্কুল ছেড়ে দেয়। পড়াশুনার ইতি ঘটিয়ে বয়স পনের হতেই ব্যবসা শুরু করার ফন্দি ফিকির শুরু করে। ভাল ব্যবসায়ী হতে হলে চলনসই ইংরেজি জানলেই চলে। জকি ভাল ইংরেজি বলতে পারে, ই-মেইলে চিঠি চালাচালি করতে পারে, এর বেশি পড়াশুনার পেছনে সময় নষ্ট করে কি লাভ?

জকিকে যদি কেউ জিজ্ঞাস করে পৃথিবীর কাকে ও সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, তবে সবচেয়ে সৎ উত্তর হবে, নিজেকে। এ কারণে রোজ কয়েক ঘণ্টা জকি ব্যয় করে গোল্ড জিমে। নিজের দেহটা আসল। দেহ ঠিক থাকলে সব ঠিক। জকি মনে করে, সব কিছুর মতো দেহচর্চা একটা ইনভেস্ট। শুধু জানা দরকার ইনভেস্টমেন্ট ওঠার টেকনিক। ওর সুন্দর দেহের প্রশংসা শুধুমাত্র যে পুঁচকে মেয়েরা করে তা নয়, অনেক আন্টিরা করে থাকেন। এদের কাছ থেকে জকি পুরো সুবিধা আদায় করে নেয়। তেইশ বছরের জীবনে কত আন্টিই না ওকে ধরা দিয়েছে। ধরতে গেলে এদের পার্সের টাকায় গুলশানে জকি একটা রেঁস্তোরা খুলে বসেছে। ফ্রাইড চিকেন বিক্রি হয়। ওই ধারের টাকা ফেরত দিতে হয়নি। আন্টিদের চাহিদা কেবল একদুই ঘণ্টার একান্ত সান্নিধ্য। জকি এ ব্যাপারে অকৃপণ। সুতরাং আন্টিরা টাকা ফেরত চাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যায়।

শুধু এই সামান্য ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকার পাত্র জকি না। ব্যবসা বাড়ানোর ধান্দা করে। বাবার টাকায় হাত না দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো চ্যালেঞ্জিং বটে। এই চ্যালেঞ্জে জকি জিতেছে। এই বয়সেই গুলশানের এক বিলাসবহুল এপার্টমেন্টে একা থাকে। নিজে হতে চায় দেশের সবচেয়ে এলিজিবল ব্যাচেলার। ওর অ্যাপার্টমেন্টে পেশাদার জুয়াড়িদের আড্ডা বসে। জকি কখনো জুয়া খেলে না। তবে প্রতি জুয়ার বোর্ড থেকে ‘কিট্টি’র টাকা তোলে। এ টাকায় বাড়িভাড়া উঠার পরও ওর পকেটে মোটা টাকা থাকে। এখন কয়েক বছর এদিক-সেদিক করে এক সময় বাবার মূল ব্যবসার হাল ধরবে জকি। বাবার ব্যবসাটাকে বাড়িয়ে একটা হোটেল চেইন করার ইচ্ছে আছে জকির। প্রথমে কক্সবাজার, তারপর দুবাই, পাতোয়া, তারপর নিউইর্য়ক, এভাবে এগুতে হবে। বিয়ে করার জন্য প্রচুর সময় পরে আছে। পঁয়ত্রিশের আগে তো নয়ই, চল্লিশও লেগে যেতে পারে।

জকির বন্ধু তালিকায় সব বয়সিই আছে। জুনিয়র বন্ধুদেরও জকি উপেক্ষা করে না। জুনিয়র গ্রুপটা ডোমিনেট করা সহজ। বেশ কিছুদিন ধরে জকি ওর জুনিয়র বন্ধুদের কাজে লাগানোর কথা ভাবছে। জকি জানে ওর এসব বন্ধুদের বাবারা প্রচুর টাকার মালিক। প্রতিদিন ওরা প্রচুর টাকা খরচ করে। এই খরচটাকে কাজে লাগানোর জন্য একটা সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। সুতরাং জকি কাজে নেমে পড়ে। একটা ডিজে পার্টির আয়োজন করে এই গ্রুপটা থেকে টাকা কামানোর পরিকল্পনা আঁটে জকি। একশো পেয়ার ওর দরকার। পেয়ার প্রতি খরচ পাঁচ হাজার টাকা হলে পাঁচ লাখের মামলা। খরচ তিন লাখ হলে নিট প্রফিট দুই লাখ। এক রাতের ব্যাপার মাত্র। তবে এ সব কাজে একটু ঝামেলাও আছে। থানা পুলিশ ম্যানেজ করতে হয়। এই এলাকার এক মাফিয়া ডন আছে, তাকে লাভের হিস্যা দিতে হবে। ওই ডনকে এড়িয়ে কিছু করতে গেলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে। নয়তো প্রশাসনের ঝামেলা পোহাতে হবে। অন্যদিকে ডনের সহযোগিতা পেলে ডনের লোকেরাই উটকো ঝামেলা সামলাবে।

এই ডনের হদিস পাওয়া খুবই মুসকিল। ভদ্রলোক একটি গ্রুপ অব ইন্ডাট্রিজ’এর মালিক। গুলশানে এই লোকের ঝা চকচক্ কর্পোরেট অফিস ভবন। জকির মতো এক নবীনের পক্ষে এই লোকের পাত্তা পাওয়া দুঃসাধ্য বটে। জকি অনেকদিন ধরেই এই লোকের ব্লেসিং চাচ্ছে। ব্যাপারটা জলের মতো সহজ হয়ে গেল জিনিয়া আন্টির জন্য। আন্টির বয়স কমপহ্মে পঞ্চাশ। নিয়মিত জিম করে বয়সটা পনের বছর কমিয়ে রাখেন। আন্টি সময় অসময়ে জকির এপার্টমেন্টে আসেন। একান্তে পেলে জকিকে পিশে ফেলতে চান। একদিন এ হেন আন্টিকে ঐ লোকের কথা বলতেই তিনি লাফিয়ে উঠলেন। জকিকে আদর করতে করতে বললেন, ‘কালই তুমি ঐ লোকের সাথে সিটিং দেবে।’

জকি স্বপ্নেও ভাবেনি এত সহজে ঐ মাফিয়া ডনের দেখা পাবে। সত্যি আন্টি ম্যাজিক জানে। এই সোসাইটির সব রাঘব বোয়ালই যেন জিনিয়া আান্টির ভ্যানিটি ব্যাগে। গাড়িতে যেতে যেতে জিনিয়া আন্টি বলেছিলেন খান নামের ঐ ডনের সাথে কোন এক সময় লন্ডনে মাস ছয়েক সময় কাটিয়েছেন। এমন কি বিভিন্ন ব্যবসায় সাহায্যও করেছেন। খানের অফিসটা একটা বিশাল মাল্টি-ন্যাশনাল কর্পোরেট অফিসের অনুরূপ। ইমপোর্টেট ফার্নিচার আর দামি অফিস গ্যাজেটে সাজানো। খানের চেম্বার যাওয়ার আগে অনেকগুলো সিকিউরিকি দরজা পেরুতে হয়। প্রতিটি দরজায় অটো-লক, পাস-ওয়ার্ড দিয়ে লক খুলতে হয়। এছাড়া প্রতি দরজায় একজন করে সিকিউরিটি গার্ড। এছাড়া আছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। কেন্দ্রীয় ভাবে কেউ একজন গোটা ফ্লোরের সিকিউরিটি দেখছে। খানের অফিসে সুন্দরী মেয়েদের প্রাধান্য। এত সব ঝুট ঝামেলা পেরিয়ে ওরা পৌঁছল খানের নিজস্ব কম্পাউন্ডে। এখানে মেটাল ডিভাইস নিয়ে ওদের গোটা দেহ তল্লাসি করল একজন পুরুষ ও একজন নারী গার্ড। এ সব ঝামেলা শেষে ওরা এলো খানের ব্যক্তিগত সচিবের বিলাসবহুল রুমে। এ রুমের সাজ-সজ্জা এদেশের মন্ত্রী-সচিবদের রুমের সাজ-সজ্জাকে হার মানায়। জকি দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের একটি নিজস্ব অফিসের স্বপ্ন দেখে আসছে। জকির চেহারার মুগ্ধতা দেখে জিনিয়া হাসল। সচিবের রুমে মিনিট বিশেক অপেক্ষা করার পর ওদের খানের সাথে দেখা করার অনুমতি আসে।

খানের বিশাল চেম্বারে সাদা রংয়ের প্রাধান্য। রুমের বিশালতার সাথে মননসই ফার্নিচার। খানের বয়স নাকি ষাট পেরিয়েছে কবে, অথচ বোঝার উপায় নেই। মুখাবয়ব কিংবা গলার নিচে বয়সের বলিরেখা নেই। ধুতনিতে ঝুলে থাকা সাদা ফ্রেন্সকাট দাড়িই কেবল তার বয়সকে জানানি দিচ্ছে। এতদিন জিম করেও জকি খানের মতো চওড়া বুকের অধিকারি হতে পারেনি। খানের চওড়া বুকে যে জিনিয়া আন্টির মতো মেয়েরা পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে! শোনা যায়, দেশের এক নামি টিভি তারকা এখন খানের সাথে লিভিং টুগেদার করছে। খানের বর্তমান স্ত্রী তার এক বন্ধুর ষোড়শি কন্যা। খানকে নিয়ে কত ধরনের স্ক্যান্ডালই লেখা হয় পত্র-পত্রিকায়। এত সবের পরও খান কূটনৈতিক পাড়া মাতিয়ে রাখেন। বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সাথে খানের দারুণ সখ্য। খানের দেয়া বিভিন্ন ধরনের পার্টিতে কূটনৈতিকদের অবাধ যাতায়াত। মন্ত্রী-সচিবরাও বাদ যায় না। এ কারণে খানের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে যেতে প্রশাসন বারবার চিন্তা করে। খানের মতো বর্ণাঢ্য জীবনই জকির কাম্য।

জকিকে দেখে খান একটু হতাশই হলেন যেন! তারপর ওর বয়স তেইশ জেনে আরেকটা ধ্বাক্কা খেলেন। ভদ্রলোকের উপেক্ষার চোখ দেখে ভেতরে ভেতরে জকি দমে গেল। মনের জোর একত্র করে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করল। জিনিয়া আন্টি সাথে আছে, এটাই এখন বড় ভরসা। কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই খান বললেন, ‘এসব কাজের পক্ষে তোমার বয়সটা বড় কম। যাই হোক বয়স ব্যাপার না। জিনিয়া সবই বলেছে। হেল্প নয়, আমি তোমার পার্টনার হবো।’
‘আপনি এই সামান্য ব্যবসায় পার্টনার হবেন?’ বিস্মিত গলায় জকি বলল।
বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে খান অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার মালিক। এই লোক দু-পাঁচ লাখ টাকার ব্যবসা করবে! জকির মতো এক চুনোপুঁটিকে পার্টনার করবে! জকি ভুল শোনেনি তো? খান যেন জকির মনের কথা টের পেলেন।
‘শোনো ছোকরা, আমরা ব্যবসায়ী। আমাদের প্রতি ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডের হিসাব করা চাই। ঘড়ির কাটা ঘুরবে আর টাকা আসবে। তোমার এই প্রজেক্ট প্রফিট আর্নি-আমি কেন ইনভেস্ট করবো না! আমার দরকার টাকা, যেখান থেকে হোক। টাকা বানানো চাই। যাই হোক আমার একলোক আগামী সপ্তাহের মধ্যে তোমার সাথে দেখা করবে, তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। এখন তবে একটু বাইরে অপেক্ষা  করো। জিনিয়ার সাথে আমার মিটিংটা সারি।’
লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে জকি ওয়েটিং রুমে আপেহ্মা করতে থাকে। জকি ঘড়ির দিকে তাকায়। খানের সাথে মিটিং হয়েছে ঠিক দশমিনিট। খান দশমিনিট সময়ই মিটিং এর জন্য বরাদ্দ করেছিল। খানের সময় জ্ঞানে জকি মুগ্ধ। টাকা বানাতে গেলে সময়জ্ঞান নিখুঁত হওয়া চাই। জকি পকেট থেকে একটা ডাইরি বের করে এই পয়েন্ট টুকে নিল। দিনে যাই করুক কোন বিষয় গুরুত্বপূর্ন মনে হলে জকি ওর নোট বুকে টুকে নেয়। পরে এই ডাইরি দেখলে সিদ্বান্ত নিতে সুবিধা হয়। রাতে বাসায় ফিরে খান সর্ম্পকে একটা অ্যানালইসিস ডাইরীতে লিখে রাখবে। এতে করে লোকটাকে হ্যান্ডেল করা সহজ হবে।

ওয়েটিং রুমে জকিকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, পাঁচ মিনিটের মধ্যে জিনিয়া আন্টি খানের রুম থেকে বাইরে চলে এলো। জিনিয়া আন্টির চেহারার চাপা খুশির ছাপ দেখে জকি নিশ্চিত খান তাকে নুতন কোন এসাইনমেন্ট দিয়েছে। আর খানের কোন এসাইনসেন্ট মানে জীবনে একধাপ আগে বাড়া। জিনিয়ার এই নুতন এসাইনমেন্ট সময়-সুযোগ মত জেনে নিতে হবে।

চলবে