রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ৭

সাজ্জাদ হায়দায়

প্রকাশিত : মে ২০, ২০১৯

ঈশান বলল, এক কাজ করলে হয় না, বিরোধী দল মানে বড়দুটি দলের কাছে গেলে হয় না? আমার সাথে মাঝারি ধরনের দু একজন নেতার পরিচয় আছে। এছাড়া এসব দলের স্টুডেন্ট উইংয়ের অনেকেই আমার পরিচিত। ওদের সাথে সিটিং দেয়া যেতে পারে।
আনা বলল, মজাটা এখানেই, মৌলবাদীদের সরকারেরও দরকার, ওই দুটি বড় দলেরও দরকার। তারপরও তুই কথা বলে দেখো, ওদের মনোভাব তো বোঝা যাবে। আমি অরাজনৈতিক ইয়ুথ ফোর্সের ওপরই বেশি ভারসা রাখি। এই ইয়ুথ ফোর্সটাকে ইউনাইটেট করতে পারলেই মৌলবাদীদের টাইট দেয়া যাবে।
ঈশান বলল, কি ব্যাপার আনা, তুমি দেখি একেবারে তাত্ত্বিক বনে গেলে! সিংগার কাম পলিটিশিয়ান! ভালই হবে ব্যাপারটা, তবে বড় দুই নেত্রী খবর পেলে তোমার কপাল পুড়বে। তখন কিন্তু তোমার খবর আছে।
বাদরামি রাখ, মৌলবাদীদের জ্বালায় ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই মৌলবাদীরা আমার গলা টিপে ধরছে। রাস্তাঘাটে হেনস্তা হচ্ছি, আমি গান গাইতে পারছি না।
তুমি তো দেখছি মৌলবাদিদের ব্যাপারে দারুন সিরিয়াস ফাপড়ে আছ!
তুই একটা আজব! এতহ্মন আমি কি তোদের জোকস্ বলেছি।
তুমি জানো, আমার চেয়ে একটা আজব আছে, ইকবাল ভাই! ঈশান নাটকীয় ঢঙে বলল।
সেই আধ-বুড়োটা, সারাক্ষণ গাঁজা খায় যে লোকটা! তার আবার কি হলো, যে তাকে নুতন করে আজব বললি।
প্রথম কথা হলো এই ইকবাল ভাই তোমার প্রেমে পড়েছে।
ওর কথার ভঙ্গিতে হেসে উঠল সবাই।
এই শয়তান একদম বাজে কথা বলবি না। কান ছিড়ে ফেলবো। আনা ঈশানের দিকে তেড়ে যায়।

দেখ বুড়ো বলে তুমি ইকবাল ভাইকে ফেলে দিতে পারো না। পিকাসো নব্বই বছর বয়সে বিয়ে করেছে। পিকাসোর বান্ধবীর তখন বয়স ছিল ছত্রিশ। নব্বই হতে ইকবাল ভাইয়ের অনেক বাকি। আর দেখো, বলে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ খুলল। কাগজটা আনার চোখের সামনে মেলে ধরে বলল, ‘পড়ে দেখ!’
আনা জোরে জোরে পড়ল, ধর্ম-ব্যবসায়ি, তুমি দোজগ বেহশতের এক আজব কারবারী/ তোমার জন্য গোশত পোলাও আমার পেটখালি।

পুরোটা পড়ে মুগ্ধ গলায় বলল, ‘গ্রেট!’
‘বুঝলে এই হলো ইকবাল আজব। তুমি এবার এটাতে সুর লাগাও তো দেখি! দেখ না, এটাই আমাদের কনসার্টের থিম সং করা যায় কিনা।’
‘আলবৎ! এটই হবে আমাদের থিম সং।’ আনা রুলিং দেয় যেন! একটু আগের টেনশনটা এখন আর আনার মধ্যে নেই।

পাঁচ.
এক্সাম শেষে কলেজ খুলেছে। সবাই খুব রিলাক্সাড। আড্ডার মুডে সবাই। রূপনির জন্মদিনও এগিয়ে আসছে। রুশনি, রুমকি আর ইলার সাথে বসে রূপনি জন্মদিন সেলিব্রেটের বিভিন্ন ডিটেইল প্লানে ব্যস্ত। এ সময় নোভা এগিয়ে এলো। কি রে, তোরা কি নিয়ে গুলতানি পারছিস। রাতে তোদের ঘুম হয়েছে তো?
তোর কি মনে হচ্ছে? রুমকি বলল। রুমকি ওদের মধ্যে মুখরা। আর নোভা সব সময়ই রুমকিকে রাগিয়ে মজা পায়। তবে নোভা পছন্দ করে রুশনিকে। দিন দিন ওরা অ্যাফেয়ারের দিকে যাচ্ছে যেন! রুশনি এখন মুগ্ধ চোখে নোভাকে দেখছে !
নোভা তোর রাতে ঘুম হয়েছে কিনা, সেটা বল! নাকি সব ডাইনিদের তাড়া খেয়েছিস!’ ইলা বলল।
কাল রাতে ঘুম ঠিকই হয়েছিল। চেহারায় চিন্তার ছাপ এনে নোভা ফের বলল, কিন্তু আজ রাতে আর ঘুম আসবে না।
কেন! আজ রাতে ঘুম আসবে না কেন?’ রূপনি জিজ্ঞাস করল।
তোদের জন্য। তোরা আজকাল যে সব ড্রেস লাগাচ্ছিস না। এই দেখ না রুমকির ড্রেস। সব কিছু ফেটে বেরুতে চাচ্ছে। এসব দেখলে বউ ছাড়া কোন শালা ঘুমতে পারে! নোভা বলল।
আজকে চড়িয়ে তোর দাঁত সব ফেলে দেব। বলে রুমকি নোভার দিকে তেড়ে যায়।
এই রুমকি বেশি নাড়া চড়া করবি না, তাহলে সত্যি তোর সব কিছু ফেটে যাবে। একথা বলে নোভা রুশনির আড়ালে লুকানোর ভান করল।

নোভার কথা শুনে সবাই আনন্দে হাততালি দেয়। রুমকি রেগে লাল হয়। আসে পাশের জটলায় যারা ছিল তারাও মজা দেখার জন্য এগিয়ে আসে। ওদের তুমুল আড্ডা জমে উঠে। একে অপরের মধ্যে খুনসুটি চলতে থাকে। এ সময় ছেলেটা এগিয়ে আসে। রূপনিদের ভার্সিটির ভবন লাগোয়া আরেকটা র্ভাসিটি যে টাকে রূপনিরা ‘কিন্ডারগার্টেন’ বলে সেখানেই ছেলেটা পড়ে। ওদের কয়েক বছরের সিনিয়ার। নোভার কাছে মাঝে মধ্যে আসে। রুমকির সাথে খুনসুটি বাদ দিয়ে নোভাও ছেলেটির দিকে এগিয়ে যায়। তারপর রূপনিদের দিকে তাকিয়ে চেহারায় সিরিয়াসভাব এনে বলল,‘এ হলো আমার বন্ধু ঈশান। ব্যান্ড সিঙ্গার।
ব্যান্ড সিঙ্গার! সবাই প্রায় সমস্বরে বলল
হ্যালো- বলে রুশনি হাত বাড়িয়ে দেয়। রূপনি ছেলেটিকে দেখতে থাকে। ফ্যাড জিন্স আর কেডস্ ভীষণ ক্যাজুয়াল ছেলেটি, গায়ের রং রোদে পোড়া। ঘামে লেপ্টে আছে নীল শার্ট। সারাদিন রোদে টো টো করে এখানে এসেছে বোধ হয়! রূপনি নিশ্চিত ছেলেটা দুপুরে লাঞ্চ্ করেনি। এ সব ছেলেরা বাউন্ডেলে টাইপের হয়-ভীষণ কেয়ারলেস, এদের বোঝা খুব শক্ত। এরা না খেয়ে, না ঘুমিয়ে দিন পাড় করে, উল্টা-পাল্টা সব কাজ করে। ছেলেটির জন্য কেন যেন রূপনির মায়া লাগে।
ছেলেটা সবার দিকে তাকিয়ে হাসল তারপর কোন ভূমিকা ছাড়াই বলল, নোভা আমি এসেছি তোদের সাথে একটা সিরিয়াস ব্যাপারে আলাপ করতে।
ছেলেটা সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে ফের শুরু করলো, তোরা কি আমাকে একটু সময় দিবি?

ওদের ক্যাম্পাসের পাশে এক চিলতে লন। ওখানে গিয়ে বসল সবাই। ছেলেটা একটানা বক বক করে গেল অনেকক্ষণ, রূপনি ওর সব কথা বুঝল না। কেবল এটুকু বুঝল একটু স্ট্যাচু হবে এয়ার পোর্টেও সামনে। সেই স্ট্যাচুটা কারা যেন ভেঙ্গে ফেলতে চাচ্ছে। এ ব্যাপারটা যেন না ঘটে সেই জন্য ছেলেটা ওদের এখানে এসেছে। তবে এ মূর্হুতে ওদের ব্যাপারগুলো যেন ভার্সিটি কতৃপহ্ম কিংবা গার্ডিয়ানরা না জানে এই প্রতিশ্রুতি ছেলেটা চাচ্ছে। ঈশানের কথাবার্তা নুতন ধরনের। ওরা নাকি চাইলেই দেশের অনেক কিছু পাল্টে দিতে পারে। এ দেশের অনেক কিছু পাল্টে দেয়া দরকার। রূপনিও অনেক কিছু পাল্টে দিতে চায়, মনে মনে রূপনি ওকে সায় দিল। দীর্ঘ বকবকানির পর ছেলেটা ওকে সমথর্ন করার জন্য সবাইকে হাত তুলছে বলল। সবার আগে রূপনি হাত তুলল। রূপনি জানে ও হাত তুললে বাকি সবাই হাত তুলবে। রূপনিকে ওর বন্ধুরা কেউ উপেহ্মা করতে পারে না। আজও তাই হলো। রূপনির দেখাদেখি সবাই হাত তুললো। রূপনি ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা তৃপ্ত। যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে! রূপনির আবার মনে হলো ছেলেটা দুপুরে কিছু খায়নি।

রূপনি উঠে দাঁড়ালো, বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, চলো, আমরা সবাই এখন কিছু খাব।
ওর কথায় সবাই হই হই করে উঠল। টাকা খরচের ব্যাপারে রূপনি সবার ওপরে। রূপনির ঘোষণায় খলবলিয়ে উঠে দাড়ালো গোটা দলটা। ঈশান এতটা আশা করেনি। এই ছেলেমেয়েগুলো নন্দ দুলাল। ওদের জগতে বাংলা ভাষা কিংবা সংস্কৃতি কোথায়! এরা সবাই এক পা পশ্চিমা দুনিয়ায় দিয়ে আছে। দু তিন বছরের মধ্যে মোটামুটি সবাই ভিনদেশে চলে যাবে। কালেভদ্রে কেউ হয়ত দেশে আসবে। কেউ আসবে না। কেউ আসবে কোন কর্পোরেটের হর্তাকর্তা হয়ে। মাটি ও মানুষ থেকে যারা থাকবে অনেক দূরে। অথচ ডমিনেট করবে সবকিছু। সাধারন মানুষ কখনোই এদের নাগাল পাবে না।

ঈশান রূপনির দিকে তাকালো। দ্বিধায় পড়ল, ভাবছে মেয়েটার আমন্ত্রনে সাড়া দেবে কিনা! মেয়েটার চেহারায় অদ্ভুত এক সরলতা। মেয়েকে দেখলে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়! এই মেয়ের আমন্ত্রন উপেক্ষা করা যায় না। ঈশান নিশ্চিত মেয়েটা মন থেকেই আমন্ত্রণ করেছে। খুশি মনেই ঈশান এই দলটার সাথে পথ চলতে লাগলো।

রেস্টুরেন্টের পরিবেশটাই ভিন্ন। সবকিছুতেই লালের ছোঁয়া-লাল আলোর আলো-আঁধারি। রেস্টুরান্টে ঢোকার পর ওদের স্বর নিম্নগামী, ফিসফিসিয়ে কথা বলছে সবাই। বুফে কিউতে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। হালকা ঠাট্টা মশকরা চলছে নিজেদের মধ্যে। বন্ধুরা সবাই আনন্দে থাকলে রূপনির ভাল লাগে। ওদের উচ্ছাস রূপনি উপভোগ করে। রূপনি ঈশানকে  দেখতে থাকে। এখানে একটু আনাড়ি মনে হয়। এ জন্য বুফে কিউতে ঈশানের পাশেই থাকে রূপনি। আফটার আল আজকের গেস্ট ঈশান। সারাহ্মন কি যেন ভাবছে ছেলেটা। একটু উদাসিন, এই জন্যই এখানে ব্যাতিক্রম! রূপনি ঈশানের প্লেটে খাবার তুলে দিতে থাকে। ছেলেটা ওকে থ্যাকস্ দেয়।

ঠিক এ সময় রূপনির মোবাইল ফোন বেজে উঠে। ফোনের দিকে তাকাতেই একটা শিরশির্ অনুভূতি রূপনির শিরদাড়ায় কাঁপুনি ধারায়। জকির ফোন। বন্ধুদের এড়াতে রূপনি একপাশে সরে আসে। এবারের জন্ম দিনটা স্পেশাল না হয়ে যায় না! জকি নিশ্চয়ই কোন না কোন সারপ্রাইজ দেবে। রূপনিকে অবাক করে জকি আজ সন্ধ্যায় ওকে ‘ওয়েস্টইন-এ ক্যান্ডাল নাইট ডিনারের আমন্ত্রন জানায়। রূপনি ঘড়ির দিকে তাকায়। আজ আর বন্ধুদের সাথে বেশিক্ষণ আড্ডা দেয়া যাবে না। চলবে