‘লাল মোরগের ঝুঁটি’র একটি দৃশ্য

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’র একটি দৃশ্য

রেজা ঘটকের গদ্য ‘মুক্তিযুদ্ধের মেটাফরিক ছবি লাল মোরগের ঝুঁটি’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৩, ২০২১

দেখলাম নির্মাতা নূরুল আলম আতিকের ছবি ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর সময়কালে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে স্থানীক জনমানুষকে পাকসেনাদের অমানুষিক নির্যাতনের গল্প ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। পর্দায় আতিক কয়েকটি পক্ষকে সেলুলয়েডে বন্দি করেছেন।

প্রথম পক্ষ: মুক্তিযুদ্ধের সময় কৌশলগত কারণে ঢাকা থেকে অনেক দূরে সৈয়দপুরে একটি বিমানবন্দর নির্মাণ করা পাকসেনাদের জন্য প্রয়োজন ছিল। সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণ করার জন্য পাকসেনারা পরিকল্পিত বিমানবন্দরের খুব কাছেই একটি সেনা ছাউনি গড়ে তোলে। সেই ছাউনিতে পাকসেনাদের ছোট্ট একটি সেনাদল দায়িত্ব পালন করে। সেখানে দু্জন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে পাকসেনাদের অমানুষিক নির্যাতনের ছবি দেখানো হয়। সেখানে ক্যাপ্টেনদের একজন হয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের আর হয়তো অন্যজন আর্টিলারির। আর্টিলারির ক্যাপ্টেন এখানে ক্যাম্প প্রধানের দায়িত্ব পালন করে।

দ্বিতীয় পক্ষ: সৈয়দপুর বিমানবন্দরের আশপাশের কিছু গরিব মানুষ। যারা মূলত দিনমজুর ও শ্রমিক শ্রেণির। ছবিতে পাকসেনারা তাদের জোরপূর্বক বিমানবন্দর নির্মাণ কাজে ব্যবহার করে। পাকসেনাদের নির্যাতনের মাত্রা সেখানে এত বেশি যে, এই নির্যাতনকে কেবল দাসপ্রথার সাথেই তুলনা করা যায়। গরিব শ্রমিকদের ঠিকমতো খাবার পর্যন্ত দেয়া হয় না।

তৃতীয় পক্ষ:সৈয়দপুরের কিছু বিহারী মুসলমান পরিবার। যারা গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনাদের স্থানীয় দোসর হিসেবে রাজাকারের চরিত্রে কাজ করে। তারা পাকসেনাদের আদেশ, নির্দেশ-অনুরোধ রক্ষা করে সেনাদের মন জুগিয়ে চলে। পাশাপাশি তারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু পরিবারের ধনসম্পদ ও বাড়িঘর লুটপাট করে। একটি হিন্দু পরিবারের কর্তা ও গিন্নিকে তারা পুড়িয়ে মেরে সেই বাড়িতে নিজেদের ক্যাম্প তৈরি করে।

চতুর্থ পক্ষ: একটি হিন্দু পরিবার। যাদের মেয়েটি গর্ভবতী আর কিশোর ছেলেটি পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। মেয়েটির জামাই ছুটি নিয়ে বেড়ানো শেষে বিহারীদের হাতে খুন হয়। মেয়েটিকে নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য পরিবারটি গোপনে একটি আদিবাসী সাওতাঁল পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। যে পরিবারের সাথে এই পরিবারের কিশোর ছেলেটির সখ্য দেখা যায়।

পঞ্চম পক্ষ: একটি সম্ভান্ত্র মুসলিম পরিবার। যেখানে পরিবারের কর্তা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর রাখার জন্য নিজে রেডিও শোনেন। প্রতিবেশি হিন্দু পরিবারটির সাথে তার অনেক সখ্য। হিন্দু পরিবারটিকে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য দেখার পর তিনি অনেকটা মানসিক রোগী হয়ে যান। যার কিশোরী মেয়েটি বিহারীদের মাধ্যমে পাকিস্তানের ক্যাম্পে সেনাদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়।

ষষ্ঠ পক্ষ: একটি সাঁওতাল পরিবার। পরিবারের মেয়েটি চোলাই মদ বিক্রি করে। যার শখের একটি মোরগ আছে, যার নাম বাঘা। মেয়েটির বাবা (হয়তো) একজন ডোম। লাশকাটা, আনা-নেয়া আর মদ খাওয়ার মধ্যেই যার সময় কাটে। যিনি পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে মুসলিম পরিবারের কিশোরীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই পাক ক্যাপ্টেনের গুলিতে প্রাণ হারায়। আর সাঁওতাল মেয়েটি নিজের প্রাণপ্রিয় বাঘাকে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে পাক ক্যাপ্টেনের হাতে তার বাবা মারা গেছে, আর বাঘাও তখন সেই পাক ক্যাপ্টনের হাতে বন্দি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে দিকবিগিকশূন্য হয়ে নিজের কোমরে থাকা দা দিয়ে পাক ক্যাপ্টেনকে কুড়িয়ে হত্যা করে।

সপ্তম পক্ষ: পাকিস্তানি ক্যাম্পে আটক কিছু নারী, যুবতী, কিশোরীও কিছু গরিব মানুষ, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনা ও স্থানীয় বিহারী রাজাকারদের দ্বারা নির্যাতিত ও ক্যাম্পে বন্দি হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়।

একাত্তরের গোটা মুক্তিযুদ্ধের একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রেক্ষিত নিয়ে মেটাফরিক ছবি ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। সাদাকালো ক্যানভাসে আতিক ছবিতে বেশ কিছু মন্তাজ করেছেন। মেটাফোর হিসেবে দারুণ! গল্পের বুনট নন-লিনিয়ার পদ্ধতিতে। যদিও সংলাপে বাংলার চেয়ে উর্দুর আধিক্য!

ছবিতে শুরুতে মনে হয়েছিল প্রোটাগনিস্ট সাহেব আলী (আহমেদ রুবেল) যার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট হলেও অভিনয় দুর্দান্ত। কন্যা রেবার (দিলরুবা হোসেন দোয়েল) সাথে তার চেহারার দারুণ সাদৃশ্য। পরে মনে হলো সাঁওতাল পরিবারটির পদ্ম (আশনা হাবিব ভাবনা) চরিত্রটি কী আদতে মূল প্রোটাগোনিস্ট! কারণ পদ্ম একজন চোলাই মদ বিক্রেতা। স্থানীয়ভাবে সাঁওতালরা বলেন হাঁড়িয়া। পদ্ম একটি মোরগ লালন পালন করে। আর সেই মোরগের (এখানে মেটাফোর) নানান ঘটনাক্রমে শেষপর্যন্ত পদ্ম পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে খুন করে।

যেহেতু প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন (শাহজাহান সম্রাট) পদ্মের হাতেই খুন হয়, ফলে পদ্ম হয়তো এই ছবির মূল প্রোটাগোনিস্ট। পদ্মর পরিবারের সদস্য (বাবা কী) বুদ্ধ (আশীষ খন্দকার) একজন ডোম। সারাদিন লাশ নিয়ে যার কারবার আর রাতে চোলাই খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকেন। বুদ্ধ চরিত্রে আশীষ খন্দকার দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। যিনি পাকসেনাদের ফরমাইসি লাশ টানার কাজ করলেও ক্যাম্প থেকে রেবাকে (দোয়েল) বাঁচাতে গিয়ে নিজেই প্রাণ দেয়।

বাঙালি হিন্দু পরিবারের কন্যা জ্যোতিকা জ্যোতি বিবাহিত ও গর্ভবতী, যার বাবা-মাকে পুড়িয়ে মেরে তাদের বাড়িটাকেই বিহারী রাজাকাররা নতুন ক্যাম্প বানায়। সাঁওতাল নারী পদ্মর (আশনা হাবিব ভাবনা) মাধ্যমে জ্যোতির পালিয়ে যাবার সময় বিহারী রাজাকারদের হাতে ধরা পরা এবং শেষমুহূর্তে পদ্মর হাতেই পাক ক্যাপ্টেনের মৃত্যু নিয়ে আমার মনে যদিও কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

পদ্ম তার প্রিয় মোরগ বাঘাকে খুঁজতে গিয়ে দুটি ঘটনার মুখোমুখি হয়। এক. পাক ক্যাপ্টেনের হাতে পরিবারের সদস্য বুদ্ধর (আশীষ খন্দকার) খুন হওয়া এবং দুই. পাক ক্যাপ্টেনের হাতেই বাঘাকে আবিষ্কার করা। এই দুই ঘটনার আকস্মিকতায় পদ্ম হয়তো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাক ক্যাপ্টেনকে খুন করে।

এখানে মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাও রাজাকারদের নির্যাতনের বিরোধিতার চেয়ে বরং সাঁওতাল নারীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াকেই বেশি যৌক্তিক মনে হয়েছে। কারণ, পদ্মকে দেখা যায় নানান কিসিমের সুবিধা নিয়ে যুদ্ধের ভেতরে মানব পাচার করতে অথবা গোপনে তাদের আশ্রয় দিতে, কিন্তু তার সেই মানব পাচার বা আশ্রয় প্রদান আদতে ব্যর্থ হয়, সবাই শেষপর্যন্ত রাজাকারদের মাধ্যমে একসময় পাকক্যাম্পে বন্দি হয়।

ছবিতে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বীরত্ব গাঁথার কোনো নিদর্শন না থাকলেও কেবল নির্যাতিত হবার দৃশ্য ঠাঁই পেয়েছে। ছবিতে বাঙালিদের কেবল ঠায় অপেক্ষা করতে দেখা যায় কখন তারা পাকসেনা ও তাদের রাজাকার দোসরদের হাতে নির্যাতিত হবে সেই প্রত্যাশায়। বাঙালিরা এখানে প্রতিরোধ না গড়ে কেবল রেডিও থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর শুনে নিজেদের শান্ত রাখে!

জ্যোতির ভাইটা যে কিনা পালিয়ে যুদ্ধে যায় তার পরবর্তী কার্যক্রমও ছবিতে অনুপস্থিত। এখানে পাকসেনা ও বিহারী রাজাকারদের বাঙালি নির্যাতনকেই কেবল একপাক্ষিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর পাক ক্যাপ্টেন তার কৃতকর্মের জন্য চরম শাস্তি হিসেবে যে প্রতিশোধের শিকার হয়, সেটাও বাঙালিদের হাতে নয় বরং একজন সাঁওতাল নারী পদ্মর হাতে। ফলে এখানে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয়গাঁথার পরিবর্তে সাঁওতাল নারীর বিজয় চিন্থিত হয়।

ফলে ছবির শেষটা দর্শকের কাছে পাকিস্তান সেনাদের বিপক্ষে বাঙালিদের পরিবর্তে সাঁওতালদের বিজয় গাঁথা হিসেবে ভুল বিভ্রম তৈরি করতে পারে! লাল মোরগ বাঘার চিৎকারের মেটাফরিক ব্যবহার বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়ের নির্দেশ করলেও, মোরগটি একজন সাঁওতাল নারীর হওয়ায়, বিভ্রান্তিটা এখানে আরো জোড়ালো হয়! অভিনয়ে সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। যদিও পাকসেনাদের বাচনভঙ্গিতে ও বডি ল্যাংগুয়েজে প্রশিক্ষিত সুদক্ষ সেনার ছাপে যথেষ্ট ঘাটতি ঠেকেছে।

আহমেদ রুবেল, আশনা হাবিব ভাবনা, আশীষ খন্দকার, দিলরুবা দোয়েল, জ্যোতিকা জ্যোতি, স্বাগতা, জয়রাজ ও শাহজাহান সম্রাটের অভিনয় ভালো লেগেছে। ক্যাম্পে নাচের দৃশ্য এবং নদী থেকে ব্রিজের শটটা দুর্দান্ত। একদম শুরুতে রেবার (দোয়েল) স্কার্ট পরা কস্টিউম সৈয়দপুরের মতো একটি মফস্বল শহরে বেমানান ঠেকেছে।

মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে মেটাফরিক উপস্থাপনের জন্য আতিককে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। যুদ্ধ না দেখিয়েও এই ছবি ভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্লেষণের জন্য চলচ্চিত্রের একটি নতুন পাঠ হতে পারে। ১০৬ মিনিটের `লাল মোরগের ঝুঁটি` চলচ্চিত্রটি নিঃসন্দেহে আতিকের একটি নতুন এক্সপারিমেন্ট ও ভিন্ন আঙ্গিকের উপস্থাপনা। যা বাংলা ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের নতুন স্বাদ দেবে। ছবির প্রযোজক মতিয়া বানু শুকুকেও আমার অভিনন্দন। কিত্তনখোলা, চতুর্থমাত্রা, সাইকেলের ডানা ও ডুবসাঁতারের দীর্ঘদিন পর আতিকের নির্মিত `লাল মোরগের ঝুঁটি` ছবি নিঃসন্দেহে নান্দনিক উপস্থাপনা।

আমি আতিকের `পেয়ারার সুবাস` ও `মানুষের বাগান` ছবি দেখার জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করব। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি` টিমের সবাইকে শুভেচ্ছা এবং আতিকের জন্য ভালোবাসা ও শুভকামনা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা