সাহিত্যিক শেখ ওয়াজেদ আলীর আজ জন্মদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২৫

সাহিত্যিক শেখ ওয়াজেদ আলীর আজ জন্মদিন। ১৮৯০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার বারতাজপুর গ্রামে তার জন্ম। এস ওয়াজেদ আলী নামেই তিনি বেশি পরিচিত।

তার নানা মুংগের (বর্তমান বিহার রাজ্য) থেকে এসে নবাবপুর গ্রামে জায়গির নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। স্থানীয় বাঙালি মুসলিম পরিবারে বিবাহ করেন। ওয়াজেদ আলীর তিন মামা ছিলেন হাফেজে কোরআন।

তার নানার বাড়ির পরিবেশ ছিল ধর্মীয় অনুশাসনে পূর্ণ। তবে নবাবপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। যার উল্লেখ পাওয়া যায় তার স্মৃতিচারণায়।

ওয়াজেদের প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হয় গ্রামের মাদ্রাসায়। ১৮৯৭ সালে ৭ বছর বয়সে তার প্রথম বিয়ে হয় তার ৬ মাস বয়সী চাচাতো বোন আয়েশার সঙ্গে (চাচা শেখ গোলাম রহমানের কন্যা)।

১৮৯৮ সালে ৮ বছর বয়সে ওয়াজেদ আলী শিলং শহরে যান এবং তার পিতা শেখ বিলায়েত আলীর অধীনে লেখাপড়া শুরু করেন। পরে তিনি শিলংয়ের ইংরেজি মাধ্যম ‘মোখার স্কুল’-এ ভর্তি হন এবং সেখান থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় স্বর্ণপদক লাভ করেন।

শিলংয়ে কাটানো এই সময় তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি আলিগড়ের মায়ো কলেজে ভর্তি হন। সেখানেও মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত হন। এরপর তিনি আলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০৮ সালে আই.এ. এবং ১৯১০ সালে বি.এ. পাস করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে তিনি নিজ গ্রামের বারতাজপুর ফিরে যান এবং গ্রামীণ পরিবেশে সুখি পারিবারিক জীবনযাপন করেন। এই সময়ে তার প্রথম কন্যা লুৎফুন্নিসার জন্ম হয়। এরই মাঝে তিনি পরিবারের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যান যাতে ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে পারেন।

দ্বিতীয় মামার উৎসাহ ও সুপারিশে অবশেষে তিনি অনুমতি পান এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক বছর আগেই লন্ডন যাত্রা করেন। ১৯১১ সালে ওয়াজেদ আলী ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্টস কলেজ-এ ভর্তি হন এবং ১৯১৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি (বি.এ.) লাভ করেন।

এরপর ১৯১৫ সালে তিনি লন্ডনের মিডল টেম্পল থেকে ‘বার অ্যাট ল’ পাশ করেন। ক্যামব্রিজে থাকাকালীন তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ব্রিস্টল থেকে এলেনর স্যাক্সবি নামক এক নারী তার সেবা করতে এগিয়ে আসেন। যার কারণে তার দ্রুত সুস্থতা হয়।

এই ঘটনা থেকেই তাদের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা তার দ্বিতীয় বিয়ে এবং আয়েশা বেগমের সাথে তার বিবাহবিচ্ছেদে পরিণত হয়, যা তার পরিবারের সদস্যদের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। এটি ছিল ১৯১৫ সাল, যখন বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপে তুমুলভাবে চলছিল।

এ সময়েই তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন চর্চা শুরু করেন, যা ১৯২২ সাল পর্যন্ত চলেছিল। এই সময়কালটি তিনি এলেনরের সাথে কলকাতার মট লেন, রিপন লেন, রিপন স্ট্রিট ইত্যাদিতে বসবাস করেন। কিন্তু ভাগ্য তাকে বিধ্বস্ত করে, যখন পারিবারিক ব্যবসার ব্যর্থতা, শারীরিক অসুস্থতা ও বিলাসী জীবনযাপনের কারণে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান।

তখন তিনি সমসাময়িক সমাজ নিয়ে গভীর গবেষণা শুরু করেন এবং সাহিত্যিক সমাজে নিজেকে জড়িত করেন। তার বন্ধু প্রমথ চৌধুরী (সাপ্তাহিক ‘সবুজ পত্র’-এর সম্পাদক) এর পরামর্শে তিনি বাংলা ভাষায় লেখা শুরু করেন এবং একটি অসাধারণ সাহিত্যিক জীবন শুরু করেন।

১৯২৩ সালে তিনি কলকাতার তৃতীয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান এবং কিছুদিন পর তার পরিবারকে নিয়ে কলকাতার নং ১ ক্যানাল রোডে বাস শুরু করেন। এই সময় তিনি সাহিত্যচর্চায় নিজেকে নিবেদিত করেন। তিনি কথাসাহিত্য, প্রতীকি সাহিত্য, অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদির মতো ক্ষেত্রে অত্যন্ত সৃজনশীলতার সাথে আত্মপ্রকাশ করেন।

১৯৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে ওয়াজেদ আলী `গুলিস্তান` নামক একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। এই পত্রিকা একটি সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক পরিসর গড়ে তোলে যেখানে সমসাময়িক বাঙালি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যুক্ত হন। `গুলিস্তান` পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাঙালি মুসলিম-হিন্দু ঐক্যের প্রচার করেন।

কবি নজরুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, সজনীকান্ত দাস প্রমুখ বিখ্যাত লেখকরা এখানে লিখতেন।

১৯৪৫ সালের ৩১ অক্টোবর ওয়াজেদ আলী তৃতীয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন এবং নিজের আইনপেশা শুরু করেন। এই সময় তিনি তার ৪৮, ঝাউতলা রোডের বাসায় বসবাস করতে থাকেন।

তার লেখা বইগুলো হচ্ছে: গুলদাস্তা (১৯২৭, গল্প), মাশুকের দরবার (১৯৩০, গল্প), জীবনের শিল্প (১৯৪১, প্রবন্ধ), প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৯৪৩, প্রবন্ধ), ভবিষ্যতের বাঙালী (১৯৪৩, প্রবন্ধ), গ্রানাডার শেষ বীর (১৯৪০, ঐতিহাসিক উপন্যাস), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪, গল্প), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪), পশ্চিম ভারত (১৯৪৮, ভ্রমণকাহিনি), আকবরের রাষ্ট্র সাধনা (১৯৪৯, প্রবন্ধ), মোটর যোগে রাঁচী সফর (১৯৪৯, ভ্রমণকাহিনি), মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ (প্রবন্ধ)।