সৈয়দ শামসুল হকের গল্প ‘গন্তব্য, অশোক’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৭, ২০২০

কথাসাহিত্যিক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের আজ ৮৫তম জন্মদিন। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে তার জন্ম। সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও হালিমা খাতুন দম্পতির আট সন্তানের প্রথম সন্তান তিনি। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার রচিত ‘গন্তব্য, অশোক’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

ধরো, আমার কোনো বন্ধু তোমার দিকে তাকালে আর তোমার মনে হলো, তুমি উলঙ্গ হয়ে যাচ্ছো, আঁচল পড়ে যাচ্ছে, বোতাম ছিঁড়ে যাচ্ছে, তখন তুমি কি করবে?

এখনো বিশ্বাস হতে চায় না যে বিয়ের রাতেই সামাদ, তার স্বামী, এ ভয়াবহ প্রশ্নটা করেছিল। বলল, তুমি কি করবে?

সোনালী ফোঁটায় সজ্জিত শিরিনের মুখ জোর করে তুলে ধরে, তার চিবুক সাঁড়াশির মতো ঠেসে ধরে হিস হিস করে সামাদ জানতে চেয়েছিল। ব্যথায় টনটন করে উঠেছিল চিবুক, আর প্রশ্নটা তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

তখনো স্বামীকে সে ভালো করে দেখেনি। শুধু নামটা শোনা ছিল, আর একটা ফটো দেখেছিল। শুধু জানতো যে তার স্বামী কালীগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক, যে কালীগঞ্জে যেতে হয় লঞ্চে করে।

বলো, কি করবে?’ সামাদ তাকে সজোরে পেছনে ঠেলে দিয়ে একরোখার মতো জানতে চেয়েছিল। কি করবে তুমি শিরিন?

বিয়ের সন্ধে থেকে শিরিনের ভিতরটা অবিরাম দপ দপ করছিল তার স্বামী, একটি পুরুষের স্পর্শ প্রতীক্ষা করে, কোনদিন লঞ্চে সে চড়েনি, সেই লঞ্চে যাত্রা করবার কল্পনা করে। সে ছিল এক ধরনের ভয়, যে ভয়, ভয় দেখায় না, যে ভয়ের। খুব কাছে যেতে কেবলি ইচ্ছা হয়।

বলো, উত্তর দাও।

স্বামীর হাতে ধাক্কা খেয়ে বালিশের ওপর, বালিশে ছড়ানো ফুলের পাপড়ির ওপর পড়ে যেতে যেতে সেই প্রথম তাকে ভালো করে দেখেছিল শিরিন।

কিন্তু ভালো করে কি দেখা গিয়েছিল? বাসরঘরে জ্বলছিল লণ্ঠন। সে লণ্ঠন সামাদ নিজেই স্তিমিত করে দিয়েছিল খাটে উঠে আসবার সময়। ভালোই করেছিল। শিরিন জানতো, তার বোনেরা, তার সইয়েরা আড়ি পেতে থাকবে, টিনের বেড়ার ফোকর দিয়ে চোখ চালাতে চাইবে।

হ্যাঁ, সেই অস্পষ্ট আলোতেও সামাদকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। আর তৎক্ষণাৎ শিরিন মর্মে মর্মে টের পেয়েছিল যে, সামাদ পরিহাস করছে না প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত প্রশ্নটা সে করতেই থাকবে।

বলো, কি করবে? তখন সেই বন্ধুর সম্মুখ থেকে তুমি সরে যাবে? না, তার গালে একটা প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দেবে?

সামাদের মুখ তখন নেমে এসেছিল শিরিনের ওপর; এত কাছে যে, তার নিঃশ্বাসের হলকা শিরিনের মুখের ওপর অদৃশ সরীসৃপের মতো খেলা করতে শুরু করেছিলো।

নিঃশ্বাসের হলকা ওড়াতেই শিরিন চোখ বুজে সেই প্রথম বলেছিল, এমন বন্ধু আপনার কেউ আছে বুঝি?

ঐ সামান্য ক’টা শব্দ উচ্চারণ করতে যে এতখানি শক্তির দরকার হতে পারে শিরিন সেটা বুঝেছিল পরমুহূর্তেই। কথাগুলো বলে সে হাঁপিয়ে উঠেছিল যেন একমাইল দৌড়ে গেছে।

সেই কি দূরত্ব সৃষ্টির শুরু। কেবল মাইলের পর মাইল দূরে সরে যাবার শুরু।

বাহ, এইতো কথা বলতে পারো দেখছি। বোবা নও, কালাও নয়। তাহলে এতক্ষণ দেরি করছিলে কেন উত্তর দিতে?

সামাদ তাকে কঠিন দুহাতে ঠেসে ধরে কানের কাছে চাপা চিৎকার করে উঠেছিল, বলো, এতক্ষণ উত্তর না দিয়ে কি ভাবছিলে? ভাবছিলে, দেখুক তোমাকে? ভাবছিলে, ভালোই তো কেউ যদি দেখে? না। তুমি আমার, শুধু আমার। বুঝেছ? আমার।

একটানে বুকের কাপড় সরিয়ে হঠাৎ কামড় বসিয়ে দাঁতের ভেতরে মাংস রেখে সামাদ তখন অবিশ্রান্ত বলে চলেছিল, তুমি আমার, তুমি আমার।

তারপর কালীগঞ্জ। সেই চারদিকে খাল-বিল আর নদীর মাঝখান, বারো মাসের প্লাবনের মাঝখানে ছোট্ট এক শহরে কলেজের প্রান্তে সেই বাসায় আসা। বাসাতে শুধু তারা দুজন। আর মাথায় লম্বা, বুদ্ধিতে খাটো এক কাজের ছেলে। বিয়ের আগে থেকেই সে আছে। এতকাল সেই রান্না করেছে, ঘর দেখেছে, সেবা করেছে সামাদের।

সামাদের হাত ধরে শিরিন যখন এ বাসায় পা দিয়েছিল, তাকে ঘরে তুলতে এসেছিল জনা তিনেক অধ্যাপকের স্ত্রী। তারা কোনমতে শিরিনকে শোবার ঘর পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে, একটুখানি বসেই বলেছিল, যাই ভাই। আমাদের সংসার পড়ে আছে।

শিরিন চোখ তুলে দেখতে পেয়েছিল, দরোজার বাইরে, বারান্দার খাটের খামে ঠেস দিয়ে, অন্ধকারে নিঃশব্দে সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসছে আলী—সেই কাজের ছেলেটি। একটা শেয়ালের ডাক কত যোজন পেরিয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম হয়ে কানের ভেতর দিয়ে, হৃদয়ের সেই কুঠুরিতে যেখানে ভয় থাকে বাসা করে, সেখানে আছড়ে পড়ছিল অবিরাম।

সে রাতে শিরিন ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেছিল, আপনার কোনো বন্ধুকে দেখলাম।

দেখতে চাও?

না।

হঠাৎ শিরিনের মনে পড়ে গিয়েছিল, এ প্রশ্নটার পেছনে অন্য কোন কিছু দেখতে পারে সামাদ।

দেখতে চাও আমার বন্ধুদের? দেখতে ইচ্ছে করে? দেখবে তাদের?

না। না।

কেন দেখবে না? কেন দেখতে চাও না? ভয় করে? লোভ হয়? বলো, লোভ হয় কিনা?

একটানে শিরিনকে বুকের কাছে টেনে সামাদ আবার সেই চাপা চিৎকার করে জানতে চায়, বলো, আমাকে বলো, বলো।

তারপর আবার সেই কামড়। সেই তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে দেয়া—এবার শিরিনের কাঁধে। আর মুখের ভেতরে কাপড় আর মাংস নিয়ে বোবার মতো আবার সেই গোঙ্গানি।

না, কেউ না; কোনদিন না, কক্ষনো না।

দরোজার কাছে আলী যখন ডাক দিয়েছিল, সাহেব, তখনো কাঁধ থেকে মুখ সরায়নি সামাদ। শিরিনই তাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সামাদ যেন আগুনের মতো দপ করে উঠেছিল, মুহূর্তে হাত উঠিয়েছিল মাথার ওপরে, যেন প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আঘাত করতে এক্ষুণি নেমে আসবে সে হাত।

ঘরের ভেতর আলী তখন এসে পড়ায় বেঁচে গিয়েছিল শিরিন। আলী জানতে এসেছিল, রান্না শেষ। গরম গরম খেয়ে নিলেই ভালো।

আলী চলে যেতেই শিরিন বলেছিল, আলী দেখে ফেলল। কি ভাবল?

কিছু ভাবেনি। বয়স হলেও আলীর বুদ্ধিটা বাচ্চা ছেলের মতো। সেই জন্যেই ওকে রেখেছি।

মাত্রা কয়েকদিনের ভেতরেই শিরিন টের পেয়ে গিয়েছিল যে সামাদ যা করে। তা ভেবে চিন্তেই করে। তার সমস্ত কিছুরই পেছনে আছে গাঢ় ভাবনা, গভীর সিদ্ধান্ত। সে ভাবনার হদিশ পায় না শিরিন। সে সিদ্ধান্ত বিকট নিষ্ঠুর মনে হয় তার।

মানুষটা দিনের বেলায় যেন ভিন্ন রকম মনে হয়। রাতের অন্ধকারে চারদিক থেকে যে দেয়াল গড়ে ওঠে দ্রুত, দিনের আলোয় তা যেন খসে যায়। খুব ভোরে উঠে খালের পাড় ধরে হাঁটতে বেরোয় সামাদ। মাথা উঁচু করে কাধ সোজা করে, বড় বড় করে পা ফেলে সামাদ রোজ সকলে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়। রোজ সকালে শিরিন এই দৃশ্যটা জানালা দিয়ে চুপি চুপি দেখে, যেন প্রতিদিনই এই তর্কের মীমাংসা খুঁজতে যে, লোকটি একটি লোক কিনা। তারপর সামাদ যখন ফিরে আসে শিরিনের গোসল সাড়া হয়েছে। রোজ সকালে গোসল করে শিরিন; কারণ, সামাদ তাকে কোনো রাতেই রেহাই দেয় না। প্রতি রাতে তাকে সে অধিকার করে নেয় ভয়াবহ দ্রুততার সঙ্গে, ক্রোধের সঙ্গে, অন্তহীন সন্দেহের রশিতে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে।

স্বামীর দ্বিতীয় কোনো অনুভূতির সংবাদ পায় না শিরিন। এমন কি সে কি খেতে ভালোবাসে, কলেজে কি পড়ায়, কত মাইনে পায়, তার আত্মীয় কে কি করে বা তারা কোথায় আছে—এইসব সাধারণ প্রশ্নগুলোরও স্পষ্ট কোনো উত্তর শিরিন সংগ্রহ করতে পারেনি।

বিয়েটা নিতাই তাড়াহুড়ো করে দিয়েছিলেন শিরিনের বাবা-মা। ঘরে যাদের সাত মেয়ে, তাদের অতো বেছে চলতে নেই।

খাল পার থেকে ফিরে এসেই সামাদ নাস্তার জন্যে হাঁক পাড়ে। নাশতা এগিয়ে দেয় আলী। শিরিনের দায়িত্ব শুধু পেছনে দাঁড়িয়ে স্বামীকে হাতপাখার বাতাস করা।

সামাদ কথা বলে আলীর সঙ্গে।

আলী, এতগুলো নৌকা হঠাৎ কোত্থেকে এলোরে? কিংবা দেখে এলাম, বড় বড় মাছ নিয়ে জেলেরা যাচ্ছে, বাজারে দেখিস তো সস্তায় একটা রুই মাছে ল্যাজ পাওয়া যায় কিনা অথবা পরীক্ষার ফল বেরুবার সময় এখন। কোনা ছাত্রটা যেন বাড়ির কাছে না ভেড়ে।

মনিবে-চাকরে কথা হয়। শিরিনের মনে হয়, গোপনেও তাদের শলা-পরামর্শ চলে। কতদিন শিরিন দেখেছে বাসা থেকে বেরুবার মুখে যে জামগাছ, তার তলায় সতর্ক গলায় সামাদ কি যেন বলছে আলীকে।

কিন্তু সে খবর নেবার মতো সাহস পায় না শিরিন। আসলে, এ বাড়িতে আসবার পর থেকে নিজের ভেতরে একটি জিনিসের ক্ষয় সে অসহায় চোখে দেখছে, তা তার বুকের ভেতরকার সাহস।

সারাদিন কলেজে পড়ে থাকে সামাদ। ঠিক সন্ধের সময় প্রতিদিন যখন সে ফিরে আসে, তখন দুয়ারে পা দেবার মুহূর্ত থেকেই সামাদের চোখে সেইপ্রথম রাত্রে মর্মভেদি শীতল দৃষ্টি দেখতে পায় শিরিন। সে দৃষ্টি তাকে সর্বত্র অনুসরণ করে; এমন কি দৃষ্টির আড়ালে গেলেও মনে হয় সে দৃষ্টি তার পিঠে বিধে আছে সেফটিপিনের তীক্ষ্ণ ডগার মতো।

দিনের বেলায় যে মানুষটিকে মনে হয় স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে কৃতসংকল্প, অধ্যাপনার দায়িত্বে একনিষ্ঠ, বইয়ের পাতায় তন্ময়, প্রকৃতির ঋতুবদলের উৎসাহী সংবাদ। সংগ্রাহক, গ্রামে যে কোনো নতুন ঘটনায় কৌতূহলী, সেই মানুষটিকে লণ্ঠন জ্বালা অন্ধকারে, শেয়ালের যোজন পেরুনো অন্ধকারে মনে হয় একখণ্ড জ্বলন্ত সহিংস উলকার মতো ধাবমান পাথর।

রাতের আহার সব সময়েই নিঃশব্দে শেষ করে সামাদ। এমনভাবে থালার ওপরে ঝুঁকে পড়ে ভাত খায়, মনে হয় যেন শতাব্দীপ্রাচীন কোনো গ্রন্থ পাঠ করছে। আলী রাতের বেলায় চোখে দেখতে পায় না বলে, রাতের আহার পরিবেশন করে শিরিন। বারান্দার শেষ প্রান্তে খেজুরের পাটিতে ঘুমিয়ে থাকে আলী। অখণ্ড নীরবতার ভেতরে আহার শেষ করে সামাদ চোখ বুজে রেডিও শুনতে বসে। দাঁড়িয়ে শিরিন ঘুমে ঢুলতে থাকে। বিছনায় যেতে না বলা পর্যন্ত শুতে যাবার সাহস হয় না তার।

তারপর হঠাৎ এক সময়ে চোখ তুলে হয়ত তাকাল সামাদ। কৃত্রিম একটা ঝিলিক নিজের দু’চোখে এনে সহাস্য কন্ঠে কোনোদিন জিগ্যেস করে, খুব সাজগোজ করা হয়েছে যে।

সাজগোজ কোথায়? নতুন শাড়িটা পরেছে মাত্র। কোনো না কোনোদিন থেকেই তো নতুন একটা শাড়ি পরা শুরু হয়, তারপর সেটা পুরোনো হয়ে যায়। কিন্তু এটাকেই কোনো প্রকারে অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে সামাদ।

ব্যাপার কি?

কই, কিছুনা।

কেউ এসেছিল? না, কোথাও গিয়েছিলে?

আপনাকে না জিগ্যেস করে কোথাওতো যাই না।

সামাদ হঠাৎ রেডিও বন্ধ করে দেয়। হঠাৎ যেন বলবান এক নিস্তব্ধতা শিরিনের দুকাধ চেপে ধরে। পরক্ষণেই শিরিন টের পায়, সামাদ তাকে বাধ্বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে।

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সামাদ বলে, জিগ্যেস না করেও যাওয়া যায়। আমি তো আর সারাক্ষণ তোমাকে পাহারা দিয়ে রাখি না।

তারপর হঠাৎ শিরিনকে কোলপাজা করে নিয়ে যায় শোবার ঘরে। দড়াম করে খাটের ওপর শুইয়ে দিয়ে, শিরিনের মুখের ওপর মুখ এনে প্রশ্ন করে, আমাকে তুমি এখনো আপনি বলো কেন?

কি জবাব দেবে এ প্রশ্নের? শিরিন দেখে এসেছে তার মা ও বাবাকে আপনি বলে ডেকেছেন সারাজীবন। সেটাই নিয়ম বলে জেনে এসেছে সে। গল্প উপন্যাসে স্বামী স্ত্রী যে পরস্পরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে থাকে, সেটা শিরিনের কাছে সব সময়ই ভিন্ন কোনো জগতের বলে মনে হয়েছে।

কেন আমাকে আপনি বলো?

জানি না।

কাউকে তুমি বলতে ইচ্ছে হয় না তোমার?

সামাদ চাপা গর্জন করে ওঠে।

বলল, ইচ্ছে হয় কি–না। কোনো পুরুষকে? আমার চেয়ে সুন্দর, আমার চেয়ে বিদ্বান, আমার চেয়ে স্বচ্ছ কোনো পুরুষকে?

না–না, না।

চিৎকার করে ওঠে শিরিন।

চুপ। চেঁচিও না। বেশ্যার মতো চেঁচিও না।

লুও কণ্ঠ নামায় না শিরিন। আগের মতই চিৎকার করে বলে, আমি কাউকে চিনি না, কাউকে জানি না, আমাকে আপনি মেরে ফেলুন, আমাকে আপনি মারুন।

বলতে বলতে প্রথমে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শিরিন। তারপর মুচ্ছা যায়। অনেকক্ষণ পর বুকের ওপর প্রচণ্ড একটা ভার টের পেয়ে চিৎকার করে উঠতে গিয়েই শিরিন জেনে যায়, সামাদ তার শরীর ভেতর প্রবিষ্ট হয়ে উল্লাসের মতো আছড়াচ্ছে। বাইরে অবিরাম নদীর পাড় ভাঙ্গার শব্দ শোনা যাচ্ছে, ঠিক যেখানে খাল এসে নদীতে মিলেছে।

এতদিন ছিল একরকম, এখন হলো আরেকরকম। এতদিন সামাদের প্রশ্নগুলোতে বিশেষ কোন ব্যক্তির উল্লেখ ছিল না। একদিন হঠাৎ একজনের নাম এসে গেল। ইতিহাসের অধ্যাপক করিম সাহেব একদিন রাতে এসে হাজির হয়েছিলেন। না, গল্প করতে আসেননি তিনি। বিয়ের পর থেকে শিরিন দেখে এসেছে সামাদের কাছে কেউ কোনোদিন গল্প করতে আসে না। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। আর সেটা সামাদের তন্ময় গভীর স্বভাবের জন্যে বলেই মনে করে এসেছে শিরিন।

করিম সাহেব এসেছিলেন বিপদে পড়ে। নিকট প্রতিবেশী তিনি। তার স্ত্রীর হঠাৎ ব্যথা উঠেছে। গর্ভের সাড়ে ছমাসের মাথায় ও রকম ব্যথা উঠবার কথা নয়।

আপনার মিসেস একবার আসতে পারবেন?

ঘটনা আড়াল থেকে শুনে দরোজার ওপারে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো শিরিন। করিম সাহেব টের পান না, সামাদ টের পেয়েছিল তার উপস্থিতি।

সামাদ বলেছিল, আমার স্ত্রীর এ সবের কি বুঝবে করিম সাহেব? তার তো বাচ্চা হবার অভিজ্ঞতা নেই। আপনি বরং প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের বাসায় যান।

হ্যাঁ, তা বটে। সেই ভালো। আমি ভেবেছিলাম–বলতে বলতে করিম সাহেব দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন, সম্ভবত প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের বাসার দিকেই।

আর সামাদ উঠে দাঁড়িয়ে দরোজার আড়াল থেকে খপ করে টেনে সামনে এনেছিল শিরিনকে।

কি, যেতে চেয়েছিলে? করিম সাহেবের বাসায়?

ওর বৌ কষ্ট পাচ্ছে।

তুমি গিয়ে কষ্ট কমাতে পারতে? তুমি ডাক্তার? না, নার্স? না, দাই? যে তুমি ওসব বোঝো?

তবু একটা লোক থাকলে, কাছে থাকলে—

কথাটা শিরিন শেষ করতে পারেনি।

সামাদ তার হাত প্রায় মুচড়ে ধরে বলেছিল, কাছে থাকলে। কার কাছে? করিম সাহেবের কাছে তুমি থাকলে? বৌ তো ব্যথায় কারাচ্ছে। সেই অবসরে করিম সাহেবের কাছে থাকার সুন্দর একটা সুযোগ, কি বলো?

ছিঃ। বলে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল শিরিন।

মনে যা ভাবছ, আমি মুখে বললেই ছিঃ।

হাতটা মুচড়ে ব্যথা করে দিয়েছিল সামাদ। অনেকদিন পরে সে রাতে স্পর্শ করে নি সামাদ, যেমন সে প্রতিদিন করত, বিছানার একপাশে সন্তর্পণে গা বাঁচিয়ে চিৎ হয়ে শুয়েছিল।

এতে অবাকই হয়েছিল শিরিন। লোকটাকে এই এক বছরেও সে এতটুকু বুঝতে পারে নি।

এর, কয়েকদিন পরে, বাটনা বাটছিল শিরিন আর সমুখে বসে আনাজ কাটছিল আলী। এমন সময় সামাদ কলেজ থেকে ফিরে আসে। খুব কমই এমন সময়ে সে ফেরে। তাই উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েছিল শিরিন; ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বুক থেকে আঁচল খসে পড়েছিল। আর অন্যদিকে, সাহেবকে ফিরতে দেখে আলী তার ঝকঝকে সব কটা দাঁত বের করে নিঃশব্দে একবার হেসেছিল।

ঘটনা এই। কিন্তু বিচ্ছিন্ন সম্পর্কহীন কতগুলো অংশ জোড়া দিলে যে সম্পূর্ণ একটা বৃত্ত আঁকা যায়, শিরিন সেটা বুঝেছিল একটু পরেই।

ঘরে এসো। সামাদের শীতল কঠিন স্বর।

ঘরে এসে দাঁড়াতেই সামাদ বলেছিল, ভাবোনি এখন আমি আসব। ভেবেছ, আসবো সেই সন্ধ্যের পর। না?

হ্যাঁ। আপনি তো সন্ধ্যের আগে আসেন না।

আর তাই বুকের কাপড় ফেলে হলুদবাটছিলে আলীর সামনে?

স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল শিরিন।

বলো বাটছিলে কি–না?

হ্যাঁ, বাটছিলাম।

বুকের কাপড় পরে গিয়েছিল?

শিরিন কোনো উত্তর দেয়নি।

গিয়েছিল কি–না? বলল, গিয়েছিলো কি-না?

লক্ষ্য করিনি।

হঠাৎ মনের মধ্যে দুঃসাহস জেগে উঠে শিরিনের। এই প্রথম। পায়ের নিচে নরম কাদার বদলে শুকনো খটখটে মাটি যেন টের পায় সে।

লক্ষ্য করো নি?

না, করি নি।

কেন, করো নি?

আপনার মতো ছোটো মন আমার নেই বলে।

কথাটা বলেই চলে যাচ্ছিল শিরিন, খপ করে তার হাত ধরে টেনে এনে সামাদ ফেলে দিয়েছিল তাকে খাটের ওপর। খাটের একটা কোণে শিরিনের মাথাটা ঠুকে গিয়েছিল। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল তপ্ত পাথরের মতো একখণ্ড ভয়াবহ ব্যথা।

আমার ছোটো মন? আর তোমার মন উদার? লজ্জা করে না, একটা বাচ্চা ছেলেকে শরীর দেখাতে?

মূর্চ্ছিত হয়ে গিয়েছিল বলেই স্বামীর বাকি কথাগুলো শুনতে পায়নি শিরিন।

জেগে উঠে দেখে ঘরের এককোণে লণ্ঠন জ্বলছে। কেউ মরে যাবার মতো করুণ একটা রাত নেমেছে।

চোখ মেলে তাকাতেই সামাদ বলেছিল, নাও, ওঠো রান্না করো, খিদে পেয়েছে। আলীকে বের করে দিয়েছি। সে চলে গেছে।

সেদিন রাতেও সামাদ তাকে স্পর্শ করেনি। সেই আরেকদিনের মতো সে বিছানার একপাশে সরে গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থেকেছে।

হঠাৎ একটা কথা মনে হয়েছিল শিরিনের। যখনই কোনো ব্যক্তির উল্লেখ হয়, সামাদ আর তাকে স্পর্শ করে না।

আরো অবাক হয়ে যায় শিরিন তার নিজের মনের দিকেই তাকিয়ে। সামাদ তাকে যত আঘাতই দিক, প্রতি রাতে যে তাকে সে গ্রহণ করত, অধিকার করত, সে এতটা পর্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, যে, এখন তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লোকটার একপাশে শুয়ে থাকতে সে নিজেকে ভয়াবহ রকমে নিঃস্ব বোধ করছে।

সাহস করে অনেকক্ষণ পরে কাছে সরে এসেছিল শিরিন। অনেকক্ষণ পরে, আরো খানিক সাহস সঞ্চয় করে একটা হাত রেখেছিল আমাদের ওপর। ফিস ফিস করে জিগ্যেস করেছিল, আপনি আমাকে সন্দেহ করেন কেন?

কোন উত্তর দেয়নি সামাদ। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন না?

সামাদ নিশ্চুপ।

আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই, কেউ ছিল না।

সামাদ তবু নিরুত্তর। তার চোখ দুটো আগের মতোই বোঁজা।

শিরিন তখন বলেছিল, কেন আপনি এ রকম করেন? আমাকে বলতে পারেন না?

তখন পাশ ফিরে শুয়েছিল সামাদ, শিরিনের দিকে পিঠ দিয়ে। শিরিন তখন সামাদের পিঠে হাত রেখেছিল।

আমাকে ঘৃণা করেন?

যেন একটা পাথরের সঙ্গে কথা বলছে শিরিন।

বৌকে ভালোবাসতে হয়, জানেন না বুঝি? আপনি এত লেখাপড়া করেছে, এত বোঝেন, এটা বোঝেন না?

সামাদ তখন উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। শিরিন ভেবেছিল, হয়ত সে এখনি ফিরে আসবে। কিন্তু অনেকক্ষণ বয়ে যাবার পরেও যখন সামাদ এলো, তখন সে নিজেই উঠেছিল।

ঘরের দরোজা খুলে দেখে, পাশে পড়ার ধরে, চেয়ারে বসে আছে সামাদ, সুমুখে ছোট চৌকির ওপর দু পা তুলে দিয়ে।

এখানে বসে আছেন?

একতরফা কতক্ষণ কথা বলতে পারে মানুষ। বাইরে প্রবল প্রবাহিত রাত, নদীর শব্দ, শেয়ালের ডাক। শিরিন হঠাৎ অদ্ভুত এক সাহস পেয়ে যায়। তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের স্মিত হাসি। সে চৌকির ওপর বসে পড়ে। তারপর বলে, আমিও তো বলতে পারি, কোনো মেয়ের দিকে তাকাবেন না। আপনার কলেজে তো কত ছাত্রী আছে?

তারা আমার ছাত্রী। আমি অধ্যাপক।

এই এতক্ষণে একটা উত্তর দেয় সামাদ। কিন্তু সে উত্তর যেন বর্শার মতো তীক্ষ্ণ।

তা হোক। শিরিন ভয় কাটিয়ে উঠেছে।

ছাত্রীদের দেখে আপনার কোনো ইচ্ছে হয় না?

না।

কেউ একা আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসে না?

না।

তাদের কাউকে আপনার পছন্দ হয় না?

না।

কেন হয় না? তারা সুন্দরী না? আমার মতো বুক তাদের নেই? আমার মতো হাত-পা? আমার মতো চুল? আমার মতো শরীর?

শিরিন নিজেই বুঝতে পারেনি যে, প্রতিটি প্রশ্নে তার গলার পর্দা চড়ে যাচ্ছিল, চিৎকার করছিল সে। বুঝলো তখন, যখন প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল সামাদ তার গালে।

সমস্ত মুখটাতে যেন আগুন ধরে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে সামাদ শুধু বলল, শরীর দিয়ে আমাকে কেউ ভোলাতে পারে —এই কথাটা জেনে রেখো।

পরদিন, সারাদিন বিছানায় শুয়ে রইল শিরিন। রান্না করল না, খেল না; সামাদকেও না খেয়ে থাকতে হতো, কিন্তু সে বেরিয়ে গিয়ে সন্দেশ, পরোটা, দুধ বাজার থেকে কিনে এনে পড়ার টেবিলে বসে বসে খেল। এত নিরুদ্বেগভাবে সে খেল, যেন বাড়িতে দ্বিতীয় কেউ না খেয়ে নেই। অনেক রাত পর্যন্ত রেডিও শুনলে সে তারপর বিছানায় এসে শীতল কঠিন গলায় আদেশ করল, গোসল করে এসো।

গা কেঁপে উঠল শিরিনের। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল, কেউ মরে গেলে তাকে গোসল করিয়ে মাটি দিতে হয়।

সামাদ কি তাকে খুন করে মাটির তলায় আজ কবর দিতে চায়?

যাও বলছি।

সম্মোহিতের মতো শিরিন উঠে বসলো। একবার ভয়ার্ত চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।

গোসল করতে যাও।

রান্নাঘরের পাশে কুলগাছের নিচে পাতকুয়ো। অন্ধকার কুলগাছটা কংকালের হাতের মতো ডালপালা ছড়িয়ে আছে। তারই তলায় ঝপ ঝপ করে গোসল করল শিরিন। আতংক যখন মানুষকে সম্পূর্ণ অধিকার করে নেয়, আতংকের বোধ তখন থাকে না। গোসল সেরে বারান্দায় উঠে এলো শিরিন। সমস্ত গায়ে ভিজে কাপড় সপ সপ করছে তার।

সেই কাপড়েই ভেতরে এলো সে। শুকনো কাপড়ের জন্যে আলনায় হাত বাড়াতে যাবে, বিছানা থেকে সামাদের কণ্ঠ, যেন রেডিওর মতো ধাতবকণ্ঠ শোনা গেল।

টেবিলে দুধ আছে। খেয়ে নাও।

এক মুহূর্ত ইতঃস্তত করল শিরিন। ভিজে কাপড়েই দুধ খাবে, না, কাপড়টা ছেড়ে নেবে আগে?

খেয়ে নাও।

বিষের মতো ঠাণ্ডা দুধ, সমস্ত গেলাশ নিঃশেষ করে পান করল শিরিন। তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মাঝখানে। যেন সে নিজে নয়, অন্য কেউ এই মাঝরাতে গোসল করেছে, দুধ খেয়েছে, দাঁড়িয়ে আছে—আর সে নিজে বহুদূর থেকে স্মিতমুখে এ সবই প্রত্যক্ষ করছে।

কাছে এসো।

ভিজে কাপড়েই একবার বিছানার দিকে পা বাড়ায় শিরিন। কিন্তু কাপড়ে সপ করে একটা আওয়াজ উঠতেই সে থামে। আস্তে আস্তে ছেড়ে ফেলে শাড়ি। স্বামীর সুমুখে কোনোদিন সে যে শাড়ি পাল্টায়নি, সে রকম ভাবতেও পারে না, সেটা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে আজ শিরিন। শাড়ি ছাড়ল, জামা ছাড়ল, সায়া ছাড়ল, সমস্ত শরীরে সিক্ততা নিয়ে আলনায় কাপড়ের দিকে হাত বাড়াতে যাবে এমন সময় সামাদ ডাক দিল, তার নাম ধরে ডাক দিল, দিনের মধ্যে এই প্রথম।

শিরিন।

লণ্ঠনের স্তিমিত আলোয় এই প্রথম সে নিজের নগ্নতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল বিদ্যুতের মতো তীব্র দ্রুতগতিতে। তাড়াতাড়ি হাত বাড়াল শাড়ির দিকে, আর ঠিক তক্ষুণি বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সামাদ। শিরিনের বুকের কাছে দলা করে চেপে ধরা শাড়িটাকে প্রবল শক্তিতে টেনে ছুঁড়ে ফেলে সামাদ তাকে নিজের বুকে ঠেসে ধরল মরণপণ মত্ততার সঙ্গে।

তারপর কঠিন সেই মেঝের ওপর শিরিনকে ঠাস করে ফেলে দিয়ে, প্রাচীন অশ্বারোহীর মতো সামাদ তাকে অধিকার করে নিল তীব্র একটা যন্ত্রণার জন্ম দিয়ে।

ঠিক তখনই সিদ্ধান্তটা নেয় শিরিন। চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত। কাল সকালে উঠেই রুবিকে সে চিঠি লিখবে।

রুবির কথা মনে হতেই শিরিনের কাছে সহনীয় মনে হয় এই রাক্ষসের মতো সহবাস। এমনকি সে প্রত্যুত্তরও দিতে থাকে স্বামীর এই ভালোবাসার। কঠিন মেঝেতে নিজের শরীর ক্ষতবিক্ষত করেও সে রাতে শিরিন তার স্বামীকে পৌঁছে দেয় পর্বতের শিখরে।

.

প্রথমে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল সামাদ।

এখানে কোথায় থাকবে? ঘর কোথায়? শোবে কোথায়?

শিরিন নিঃশব্দে পড়ার ঘরে বিছানা করে দিয়েছিল রুবির জন্যে। রুবি তার খালাতো বোন। প্রায় সমবয়সী। মানুষ হয়েছে শিরিনদের বাড়িতেই। বিয়ে হয়েছিল দুবছর আগে। তারপর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সে ফিরে আসে আবার শিরিনের বাবা-মায়ের কাছে। রুবির বাবাও একদিন রুবির মাকে অমনি করে ফেলে গিয়েছিলেন। মেয়েকে সঙ্গে করে বোনের বাড়িতে উঠে এসেছিলেন তার মা।

সারা শরীরে বেসামাল ঢেউ তুলে অবিরাম খসে পড়া শাড়ি টানতে টানতে ধল খল করে হাসতে হাসতে রুবি মুহূর্তেই ভরে দেয় সামাদের সংসার।

শিরিনকে সামাদ বলে, তোমার এই বোনটির একটা বাচ্চা থাকা উচিত ছিল। তাহলে লাগাম পরতো।

সত্যি, লাগাম নেই রুবির।

যখন তখন ঘরের মধ্যে ঢোকে, যখন তখন হাত ধরে টানে, যখন তখন ঠাট্টা করে। তার সে ঠাট্টায় গাম্ভীর্য বজায় রাখা এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সামাদের জন্যে।

আজকাল সামাদ তাই যতটা পারে বাইরে থাকে। সন্ধ্যের পরে, খালপাড়ে গিয়ে বসে থাকে।

হয়ত বসে আছে, হঠাৎ জামার কলারে টান অনুভব করে সামাদ। পেছন ফিরে দেখে রুবি।

এখানে বসে কি হচ্ছে? বাড়িতে বৌ একা নেই বুঝি? তুমি তো আছে? আমি ওর বর নাকি?

বলেই হেসে প্রায় গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ে রুবি। সামাদ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। খালপাড়ে তার ছাত্ররা প্রায়ই আসে আড্ডা দিতে। তারা কেউ ধারেকাছে নেই তো?

চলুন, শিগগির চলুন বাসায়।

হাত ধরে একটানে সামাদকে দাঁড় করিয়ে দেয় রুবি। পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়বার পরও হাত ছাড়ে না। এক হ্যাচকা টান দিয়ে রুবি পথ চলতে শুরু করে। ছড়ার মতো সুর করে বলতে থাকে, এই হেট হেট, সামনে ঘোড়া, তফাত যাও।

হাত ছাড়, রুবি।

ছাড়ছি বাবা ছাড়ছি। তবু তো হাতটাই নিয়েছি। অন্য কিছু নিলে বুঝি গলা টিপেই মারনে।

একি কথা বলার ঢং? গম্ভীর মুখে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে সামাদ। হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে রুবি বলে, কি দুলাভাই, কথাটা বুঝি মনে ধরলো? প্ল্যান করছে?

সামাদ তাকে পেছনে ফেলে লম্বা লম্বা পায়ে বাড়ি ফিরে আসে একবারও পেছনে তাকায় না।

ঘরে পা দিয়েই সামাদ শিরিনকে বলে, তোমার বোন দেখছি মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসেছে।

থাক না কিছুদিন। একমাস হলো তো এসেছে।

রান্না করতে করতে জবাব দেয় শিরিন। ভেতরের হাসিটাকে জোর করে চেপে রাখে। স্বামীর বুকে অস্বস্তির কাটা খচ খচ করছে টের পেয়ে এক ধরনের তৃপ্তি হয় তার। সে বলে, বিজয়িনীর মতো গলায়, আপনার অসুবিধা হলে না হয় ওকে বলে দেব চলে যাবার জন্যে।

তাই দিও। কালকেও যেন সে চলে যায়।

সামাদ গিয়ে রেডিওর কাঁটা ঘোরাতে থাকে অস্থির আঙুলে। অনেকক্ষণ। কি জানি কেন, কোন স্টেশনই তার মনে ধরে না। বক্তৃতা ফেলে গান ধরে, গান ফেলে আবার বক্তৃতা, তারপর দুর্বোধ্য ভাষায় কোনো বেতার প্রচার শোনে কিছুক্ষণ, আবার ফিরে যায় গানে।

শিরিন ঘরে এসে জিগ্যেস করে, রুবি কই?

আমি কি জানি? আমি কি করে জানব?

সামাদ তেতো গলায় উত্তর দেয় প্রায় চিৎকার করে। আজকাল শিরিন উপভোগ করতে শিখেছে সামাদের দুর্ব্যবহারগুলো। শিরিন তাই আহত হয় না। স্বাভাবিক কণ্ঠেই শিরিনি জানায়, বাহ, আপনাকেই তো খুঁজতে গেল তখন।

রেডিওর নবে হাত থেমে যায় সামাদের। এক পলকের জন্যে। তারপর সজোরে কাটা ঘুরিয়ে চীনা ভাষার এক বেতার প্রচারে পৌঁছে, বক্তৃতার সেই উচ্চগ্রামের ভেতরে প্রায় লুপ্ত কণ্ঠে সামাদ জিগ্যেস করে, এখনো ফেরেনি?

কই, না। খুঁজে দ্যাখো।

আমাকে তো আপনি বাড়ি থেকে বেরুতে দেন না।

যাও খুঁজে দ্যাখো।

রাতে আমি বেরুতে পারব না।

শিরিন চৌকাঠের ওপর দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে।

খট করে রেডিও বন্ধ করে দেয় সামাদ। শিরিনের একবার মনে হয় এখনি তাকে আঘাত করবে সামাদ। সেই আঘাতের অপেক্ষায় চিবুক সুমুখে ঠেলে দিয়ে উদ্যত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে শিরিন।

সামাদ কিন্তু আঘাত করে না। কথা যখন বলে উঁচু গলাতেও বলে না। প্রায় কোমল, প্রায় চিন্তিত ইতস্তত গলায় সামাদ বলে, গেল কোথায়? ডোবাবে। মান সম্মান সব ডোবাবে।

সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে উপচে পড়া জলধারার মতো খিল খিল একটা হাসি শোনা যায়। চমকে পেছন ফিরে সামাদ দেখে জানালার বাইরে জুইফুলের ডাল সরিয়ে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুবি। তার সেই সকৌতুক হাসির কাঁপন লেগেছে হাতের মুঠিতে ধরা গাছের ডালে। থির থির করে কাঁপছে পাতাপত্র আর শাদা শাদা ফুলগুলো।

তারপর সড়াৎ করে ডাল ছেড়ে দিল রুবি। মুহূর্তে পাতাপত্তরে আবার ঢেকে গেল জানালা। বুঝি এক ঝলক সুবাস সঙ্গে করেই ঘরে এসে দাঁড়াল রুবি। তর্জনী তুলে বলল, তবে যে আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন বড়?

তার মানে শিরিনকে রান্নাঘরে যা বলেছিল সামাদ, তার সবটুকুই আড়াল থেকে শুনেছে সে।

চলে যেতেই যদি বলছেন, তো আমাকে নিয়ে এত ভয় কিসের সাহেব?

আবার সেই উন্মত্ত খিলখিল হাসি। সে হাসিতে ফুলগাছের ডাল নয়, শরীরের ভেতরে শিরা উপশিরায় এবার কাঁপন লাগে।

তখন জোর করে কঠিন হবার চেষ্টা করে সামাদ। তার শরীরের কোথায় কি একটা তার অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘটে যাচ্ছে সেটা বাইরে থেকে কেউ না বুঝুক, মর্মে মর্মে সে নিজে টের পায়। তখন একই সঙ্গে কণ্ঠস্বর কঠিন এবং মুখ বিকৃত করে বলে, আমি তোমাকে এখানে আসতে বলিনি।

তাই আপনি আমাকে যেতেও বলতে পারেন না, বলেই ঘূর্ণির মতো পাক দিয়ে, বিনা দরকারে বুকের কাপড় টানতে টানতে, হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে চলে যায় রুবি।

একবার স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই এক পলকের জন্যে সন্দেহ হয় যে, রুবির হয়ত মাথার দোষ আছে। নইলে এমন করে কেউ হাসতে পারে?

রুবিকে যে শিরিন স্বামীর কাছে না জিগ্যেস করেই আসতে বলেছে, চিঠিতে তাকে বলেছিল—খবরদার তুই ওকে বলবি না, আমি আসতে লিখেছি, বলবি তুই নিজেই এসেছিল— সেই মিথ্যেটা কি সামাদ ধরতে পেরেছে?

স্বামীর দিকে তাকিয়ে, নিজের আশংকার চেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে স্বামীর জন্যে ক্ষীণ একটা সহানুভূতি। শিরিন যেন হঠাৎ বুকের ভেতরে কি করে টের পেয়ে যায়, সামাদ যে প্রবল হাতে এই সংসার ইচ্ছে মতো ঘোরাতে ফেরাতো, এখন সেই হারে ওপর আরেকটি হাত এসে পড়েছে। সে হাত রুবির। সামাদের পক্ষে কিছুতেই যেন আর সে হাতের চাপ না মেনে উপায় নেই।

মমতার ক্ষীণ একটা ধারা অপ্রতিভভাবে বইতে থাকে শিরিনের ভেতরে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে কঠিন করে তোলে শিরিন।

এই তো সে চেয়েছিল। রুবিকে দিয়ে এভাবেই জব্দ করতে চেয়েছিল সামাদকে। নিজের হাতে যা পারেনি, অন্যের হাতে সেই শাস্তিই তো দিতে চেয়েছিল তার স্বামীকে।

মুখ ফিরিয়ে শিরিন চলে যায় স্বামীর সমুখ থেকে। সামাদ আবার ঝুঁকে পড়ে রেডিওর ওপর। আবার সে অস্থির আঙুলে কাটা ঘোরাতে তাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের সেই নিবিষ্টতা তার ভেতরে আর লক্ষ্য করা যায় না।

শিরিন রান্নাঘরে গিয়ে দ্যাখে রান্নার যেটুকু বাকি ছিল রুবি তা নিজেই সেরে নিচ্ছে।

উনোনের লাল আগুনের আভায় রুবিকে ভারী রূপসী দেখাচ্ছে যেন সে এই পৃথিবীর নয়, স্বর্গের, স্বর্গ থেকে নির্বাসিতা।

শিরিনের মনের ভেতরে সমস্ত অনুভূতি পলকে স্থান করে দিল নতুন এক অনুভূতিকে। সে অনুভূতি করুণার সে করুণা তাকে ফেলে অন্য মেয়ের কাছে রুবির স্বামীর চলে যাবার জন্যে।

হঠাৎ মর্মের ভেতরে শিউরে উঠল শিরিন। ঈর্ষা তাকে ছোবল দিয়েছে। একেবারে হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে। যেন ঘর থেকে পা বাড়াতেই গোখরো সাপের মাথায় পা পড়েছে তার।

রুবি যে সামাদকে নিয়ে পরিহাস করে, তাতে নাস্তানাবুদ করে খিল খিল হাসিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেকি শুধু নির্দোষ মজা করবার জন্যে? না, অন্য কিছু? সে কি আমোদ করবার জন্যে পরিহাস? না, আকর্ষণ করবার জন্যে ও জাল ছোড়া?

বুকের মধ্যে টান পড়ে শিরিনের। অন্তঃস্থলের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। মাথার ভেতরে ঝিঝি পোকা ডাকে।

দূরে সেই শেয়ালটা একবার ডেকে উঠেই হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। কোথায় যেন মরমর করে ওঠে গাছের ডাল।

না, অতটা নিচ নিশ্চয়ই রুবি নয়। তার স্বামী একদিন তাকে ছেড়ে গেছে। সে তো জানেই স্বামী হারাবার শোক কত ভীষণ। জানে না? বিয়ের পর লঞ্চে তুলে দেবার সময় ঘাটে দাঁড়িয়ে শিরিনকে সে কি বলেনি, দেখিস, পালিয়ে যায় না যেন। পাখির মতো পোষ মানিয়ে রাখবি। শেকল দিয়ে রাখবি।

সেই রুবি নিশ্চয়ই শিরিনের বুকে ছোবল দেবে না।

এসব কি ভাবছে সে অবেলায়? ভর সন্ধ্যায়?

 কিরে? মুখের দিকে তখন থেকে তাকিয়ে আছিস কেন?

রুবির কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙ্গে শিরিনের। স্বলিত একটা হাসি টেনে কোনোমতে বলে, কিছু না।

পর মুহূর্তে রুবিকে একবার বাজিয়ে দেখবার লোভ সামলাতে পারে না শিরিন। সে বলে ওঠে, তোকে হঠাৎ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল।

না, কই কেঁপে উঠলো না তো রুবি। কেমন সহজ গলায় বলল, আমি তো সুন্দরই। সবাই বলে। তাই বলে আমার মুখ দেখলে তো আর কারো পেট ভরে না। যা বরকে খেতে দে। জায়গা করে দে। নিজের হাতে মুখে তুলে দেগে, যা।

বলেই আবার সেই অকস্মাৎ বারণহীন নিৰ্বরের মতো হেসে ওঠে রুবি।

যা, দাঁড়িয়ে থাকিস নালো। যা।

রাতে বিছানায় এসে দেখে সামাদ আগে থেকেই শুয়ে আছে, অন্ধকারে। আজ সে নিত্যদিনের মতো রেডিও নিয়ে বসেনি। সোজা শুতে এসেছে দেখে, অবাক হয় শিরিন। একটু খুশি, একটু ভয়, তার মনের ভেতরে ঝড়ের দোলায় দুটি পাতা আছাড় খেতে থাকে।

পাশের ঘরেই রুবি। তাই সে না শুনতে পায় এমন নিচু গলায় শিরিন বলে, রুরি ওপর রাগ করেছেন?

প্রথমে উত্তর দেয় না সামাদ। প্রশ্নটা আবার করে শিরিন। সেই সঙ্গে যোগ করে, ওকে চলে যেতে বলি?

বলবে?

আপনি যদি বলেন।

আচ্ছা, পরে ভেবে দেখব।

সামাদের কণ্ঠস্বরে এতটুকু উত্তাপ নেই, উচ্চতা নেই। এমন স্বর বিয়ের পর এই প্রথম শুনল শিরিন। এই স্বাভাবিকতার জন্যে কতদিন কতরাত মাথা খুঁড়েছে সে।

আরো কাছে ঘেঁষে এলো শিরিন। আলতো করে একটা হাত রাখলো স্বামীর বুকের ওপর।

শুনছেন?

বলো, ঘুমোইনি।

স্বামীর জন্যে বারণহীন হয়ে ওঠে শিরিনের মমতা। এইতো সেই মানুষ যাকে সে বিয়ের পর প্রতিটি দিন প্রার্থনা করেছে, কিন্তু যার দেখা কোনদিনই সে পায়নি।

সামাদের সমস্ত ব্যবহার, তার সমস্ত রূঢ়তা এখন যেন অন্যজনের বলে মনে হতে লাগল শিরিনের। স্বামীর কাছে সোহাগ করাও সম্ভব বলে মনে হলো তার।

শিরিন বলল, রুবির কপালটা দেখেছেন? এমন সুন্দরীকে ছেড়ে বর চলে গেল।

কেন গেল?

কে বলবে? পুরুষেরা ব পারে?

পারে বুঝি?

সামাদ একটু হাসলো মনে হলো। তখন আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো শিরিন।

পুরুষেরা সব পারে। বিশ্বাস কি?

তারপরই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসল শিরিন।

রুবি খুব সুন্দরী, না?

হুঁ।

আমার চেয়েও?

পাশ ফিরল সামাদ শিরিনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে।

বললেন না? আমার চেয়েও সুন্দরী?

সামাদ কোনো জবাব দিল না।

রুবিকে নিয়ে খারাপ কিছু মনে হয় না আপনার?

রুবিকে নিয়ে?

সামাদ এবার উপুড় হয়ে বালিশের ভেতরে মুখ গুঁজে দিল। আধো উঠে বসে শিরিন তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে জানতে চাইল, মনে হয় না আপনার?

না।

সত্যি না? কেন? ওতো অনেক সুন্দরী? কি সুন্দর ওর মুখ, ওর চুল, ওর শরীর, কি সুন্দর হাসে, কথা বলে।

সামাদ নিঃশব্দে মুখ ঘষে বালিশে।

শিরিন এবার উঠে বসে বিছানায়।

আচ্ছা রুবি যখন আপনার হাত ধরে টানে, আপনার ভালো লাগে না? গায়ের ভেতরে কেমন করে না? মনে হয় না, আমি না থাকলে ওর সঙ্গে থাকতে পারতেন? মনে হয় না? ওর গায়ে হাত দিতে ইচ্ছে করে না? করে না? করে না?

ঠাস করে চড় এসে পড়ে শিরিনের গালে। হিস হিস করে সামাদ উচ্চারণ করে, বাজারে বেশ্যা হলেই পারতে।

পাশের ঘরে রুবি তখনো জেগেই আছে, সেটা দুজনেই বুঝতে পারে যখন হঠাৎ নড়াচড়ার শব্দ শোনা যায়। জোর করে উদ্গত কান্না চেপে রাখতে চায় শিরিন। কিন্তু কণ্ঠ নামিয়ে রাখার কোনো দায়িত্ব বোধ করে না সামাদ। গলা তুলে সে বলে, সন্দেহ করলে সন্দেহই সত্যি করে দেব তখন বুঝবে।

একি করল শিরিন? নিজেই যে কথার সুত্রপাত করেছিল তা যদি এমন খাদেই গড়িয়ে যায়, তাহলে সে দোষ দেবে কাকে?

নিজেকে?

কিন্তু সামাদ ও কথা বলল কেন? সন্দেহ সত্যি করে দেবার ধমক দিল কেন? তাহলে কি সন্ধ্যেবেলায় যে কথা মনে হয়েছিল, তা তার মুহূর্তের নষ্ট কল্পনা নয়। তার অবচে মনই কি তখন সাবধান করে দিয়েছিল তাকে?

পরদিন, সারা সকাল শিরিন রুবির মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাহর করবার চেষ্টা করল গত রাতের কথাগুলো সে শুনতে পেয়েছিল কিনা।

কিছুই বোঝা গেল না।

রুবি সেই অন্যান্য দিনের মতই দিন শুরু করল সামাদের উদ্দেশে তীর ছুঁড়ে। নাস্তা করতে বসেছিল সামাদ। কোথা থেকে তার সমুখে হাজির হয়ে রুবি জানিয়ে গেল যে, সামাদের উচিত মুখখানা আরো গম্ভীর করে তোলা। আজ একটু হালকা দেখাচ্ছে।

কলেজের ছাত্ররা নইলে মানবে কেন?

এ কথা শুনে সামাদ যে একটুখানি হেসেছিল সেটাই খচ খচ করতে লাগল শিরিনের বুকে।

হাসল কেন সামাদ? কই, শিরিনের কোনো কথায় তো এমন করে কখনো সে হাসেনি?

সামাদ বেরুবার সময় শিরিন ছিল কুয়ো তলায়। সেখানে থেকে সদর দরজা দেখা যায় না। হঠাৎ রুবির খিল খিল হাসি উড়ে এলো, যে এক ঝাক পায়রা ছেড়ে দিয়েছে সে হঠাৎ। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল শিরিনের।

তাহলে, আগে থেকেই কি দুজনের ভেতরে একটা কিছু চলছিল, সিরিন যা বুঝতে পারেনি?

বিকেলে রুবি পাটরাণীর মতো বসলো বারান্দায় আয়না কঁকই তেল নিয়ে। রোজই সে এই সময়ে চুল বাঁধে, নিজেকে গুছিয়ে তোলে দুপুরে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে। আজ যখন টান টান করে চুল পেছনে টেনে দুহাত দিয়ে খোঁপা রচনায় ব্যস্ত রুবি, তখন হাতের ঐ তুলে ধরায়, তার ভরা দুটো বুক ঠেলে জেগে ওঠায় অবসন্ন হয়ে গেল শিরিন।

মনে হলো, সামাদকে ভোলাতেই সাজ করছে রুবি। আবার দ্যাখো, কপালে একটা টিপ দিচ্ছে। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়নায় দেখছে বারবার।

তারপর রাতেও সেই কৌতুক, সেই হাসি, সেই চাহনি, ঘূর্ণির মতো সেই চলাচল শুরু হলো রুবির। সন্ধে বেলায় খালপাড় থেকে হাত ধরে টেনে আনল সে সামাদকে। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটের বদলে দিল এক মুঠো জুই ফুল রেকাবিতে করে ঢাকনা ঢেকে। সামাদ যখন অবাক হয়ে গেল, সে কি নাচন রুবির। শুধু নিজের নয়, সিরিনকেও টেনে নিয়ে এলো সে রান্নাঘর থেকে।

দ্যাখ, দ্যাখ, তোর বরকে দ্যাখ।

এ কি ধরনের রসিকতা?

কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না শিরিন। সে-ই তো ডেকে এনেছে রুবিকে। সেই তো চেয়েছে রুবি এসে দাঁড়াক একবার সামাদের সামনে। তখন দেখা যাবে, শিরিনকে যে প্রশ্নগুলো করে, সে প্রশ্নগুলো তাকেই করা যায় কি না।

এখন কি সে আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে? তার স্বামী? তার সংসার? তার অবলম্বন? তার অস্তিত্ব।

নিজেকে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করল শিরিনের যখন সে রুবিকে দেশে ফিরে যেতে বলল আর তার উত্তরে রুবি বলল যেই তো সবে এলাম। এখনি যাবো কিরে?

তবে কি, শিরিনকে নিঃস্ব করেই চলে যাবার পণ করেছে সে?

সামাদও আর বলে না যে, ওকে এবার যেতে বললো। সেও কি গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে রুবির সঙ্গে। নাকি, নতুন কোনো পরীক্ষা করে দেখছে শিরিনকে?

রুবি একদিন শিরিনকে বলল, হারে, তুই যে চিঠিতে লিখেছিলি, তুই আমাকে আসতে বলেছিস, সামাদের কাছে তা গোপন রাখতে। ব্যাপার কি? আর কি গোপন রাখিস বরের কাছ থেকে? ধর, তোর বরও যদি কোনো কিছু গোন করে তোর কাছ থেকে, তখন কি করবি? নাকি দুজনই কাটাকুটি হয়ে যাক, সেই ভালো? কিরে, কিছু বলছিস না যে।

শিরিন কোনো উত্তর দেয়নি তার এতগুলো প্রশ্নের। তখন রুবি নিজেই গা মটমট করে মুচড়ে, হাই তুলে বলল, তুই ও বাপু, আজকাল কেমন হয়ে যাচ্ছিস। রকে বলি রাতে আরো একটু বেশি আদর করতে। তাহলে সারাদিন মেজাজ ভালো থাকবে। আজকাল আর আদর করে না বুঝি? পুরনো হয়ে গেছিস? নতুন খুঁজছে। নাকি?

বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠল শিরিনের। কিন্তু একি অলক্ষুণে সন্দেহ পেয়ে বসেছে শিরিনকে? সে রাতের পর থেকে সর্বক্ষণ চোখ মেলে আছে সে, একটা দিনও তো এমন কিছু চোখে পড়েনি, যাতে সন্দেহটা সত্য হয়ে যেতে পারে। তাহলে?

বুকের ভেতরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে শিরিনের। একদিন সামাদকে সে বলেই ফেলে, রুবিকে আপনি চলে যেতে বলেন।

না।

এক মুহূর্তের জন্যে কি তখন মরে গিয়েছিল শিরিন? সামাদ স্পষ্ট গলায় বলতে পারল–না?

না, সে যাবে না। আমি তাকে যেতে দেব না।

শিরিন প্রাণপণে চেষ্টা করল কেন? এই কথাটা একটিবার উচ্চারণ করতে, কিন্তু কিছুতেই পারল না। সমস্ত দেহ যেন তার হাতছাড়া হয়ে গেছে।

উত্তরটা নিজেই দিল সামাদ। পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, তুমিই তো বলেছিলে, তোমার বোন সুন্দরী, তার গায়ে হাত দিতে আমার ইচ্ছে করে কিনা, তুমিই তো জানতে চেয়েছিলে? চাওনি? তাহলে থাকুক, সারা জীবন থাকুক তোমার বোন-আর তুমি দ্যাখো, চোখ ভরে দ্যাখো। তুমি দেখতে না চাইলেও, দেখবে। দেখতে তোমাকে হবে।

সামাদের পায়ের ওপর মাথা খুঁড়তে পারত শিরিন; কিন্তু সে শক্তিটুকু তার আর অবশিষ্ট নেই।

সামাদ সব পারে, এতদিনে এটা বুঝে গেছে শিরিন। এমনকি কাল থেকে রুবির সঙ্গে শুতে গেলেও অবাক হবে না সে। কিন্তু রুবি কি করবে? সেও কি শিরিনের চোখের সমুখে, শিরিনের সংসারের বয়েসেই সামাদকে নিয়ে দুয়োরে খিল দেবে? দিতে পারবে?

হয় তো পারবে। রুবিকেও অচেনা মনে হয় শিরিনের। যে রুবির সঙ্গে কৈশোর থেকে সে বড় হয়েছে, সে রুবি এ নয় বারবার এটাই শুধু মনে হয় শিরিনের।

আর দাউ দাউ করে বুকের ভেতরে আগুন জ্বলে।

দিন সাতেক পরে শিরিন হঠাৎ লক্ষ করে রুবি আর সেই আগের রুবির মতো হাসে না, যখন তখন উচ্ছল গলায় রসিকতা করে ওঠে না, সামাদের হাত ধরে টানাটানি করে না।

শিরিন লক্ষ করে, সামাদ সেই আগের মতই মাথা নিচু করে খায়, চোখ বুজে রেডিও শোনে, সেই আগের মতই ঘুমোতে যাবার আগে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে একবার অধিকার করে নেয় শিরিনকে।

যেন এ বাড়িতে রুবি নেই। রুবি কখনো আসেনি। যেন আগের সব আবার চলছে।

দুপুরে একদিন রুবি তার হাত ধরে বলে, শিরিন, এবার যেতে হয়, কবে যাবো বল?
তখন অকস্মাৎ এক পরম ঔদার্য পেয়ে বসে শিরিনকে। রুবির চিবুক ধরে সে বলে, কটা দিন যাক না। আর কি আসা হবে?

কেন, ওকথা বলছিস কেন? আবার ডাকলেই আসব। নাকি আর ডাকবি না কোনোদিন? বল কেন বলছিস?
কিছু না। এমনিই নিশ্চয়ই কিছু। বল তুই আমাকে।
না। কিছু না। কিছু না।
জোর করে হাত ছাড়িয়ে উঠে যায় শিরিন। পেছনে পেছন এসে দাঁড়ায় রুবি।

শিরিনের কাঁধে হাত রেখে রুবি বলে, হটাৎ সেই উদ্দাম খিল খিল হেসে উঠে, ভেবেছিস তোর র আমি চুরি করে নিয়েছি, বোকা, তুই একটা বোকা। আর কিছু না তুই মস্তবড় বোকা।

দপ করে আবার সেই আগুন জ্বলে উঠল শিরিনের বুকের ভেতর। মূচ্ছিত হয়ে পড়ে গেল সে।

সেদিন সকাল থেকেই মেঘ করেছিল। বিকেল নাগাদ সারা আকাশ ছেয়ে গেল ঘন কালো মেঘে। সন্ধ্যের আগেই নামল অকাল সন্ধ্যে। তারপর মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজেই ফিরে এলো সামাদ তার কলেজ থেকে। এসে দেখল বিছানায় ঝরে পড়া একটা বিবর্ণ পাতার মতো শুয়ে আছে শিরিন। চোখ তার বোঁজা।

ঘরে পা দিয়ে শিরিনকে দেখেই রুবির দিকে তাকিয়েছিল সামাদ। রুবি এসে খাটের বাজু ধরে বলল, শিরিনের অসুখ, আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন, আমি চা দিচ্ছি।

শিরিন চোখ খুলতে চেয়েছিল, শক্তি হয়নি চোখ খুলবার। বলতে চেয়েছিল, আমার কোনো অসুখ হয়নি, শক্তি পায়নি উচ্চারণ করবার। যেন সে প্রবল একটা নেশা করেছে, সব বুঝতে পারছে কিন্তু সাড়া দিতে পারছে না।

অনেক রাতে তার মনে হলো সামাদ এসে পাশে শুয়েছে। তখন অনেক কষ্টে চোখ খুলল শিরিন। তাকিয়ে দেখল, লণ্ঠনের আলোয় ঘরের ভেতরে অকিায় ব ছায়া পড়েছে, বাইরে তুমুল শব্দ তুলে অব্রিাম বৃষ্টি পড়ছে, কোথাও একটা ভোলা জানালা অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়ছে। তখন আবার চোখ বুজলো শিরিন। বুকের আগুন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়েছে তার। দেহটা সত্যি এবার জ্বলছে। মাংসের প্রতিটি কোষ একে একে পুড়ে যাচ্ছে। কত কোটি কোষ আছে মানুষের দেহে? পুড়ে ছাই হতে কত অযুত বছর লাগে?

কপালে হারে স্পর্শ টের পায় শিরিন। সামাদের হাত। সমস্ত জ্বর যেন নিমেষে থেমে যায়। বাইরে বৃষ্টির মতই শীতল হয়ে আসে সারা শরীর।

সামাদ যদি এখন তাকে একবার বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরত-এর তাকে দুহাত দিয়ে ঘিরে ধরত।

হঠাৎ কপাল থেকে হাতটা সরে যায়। শিরিন চোখ মেলে অতিকষ্টে। দ্যাখে, বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে সামাদ। তখন শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে শিরিন আঁকড়ে ধরে সামাদের হাত।

যেন বহুদুর থেকে সামাদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
পাশের ঘরে পানি পড়ে বেশি বৃষ্টি হলে একবার দেখে আসি।
হাতটা প্রাণপণে চেপে ধরে শিরিন। সমস্ত শক্তি জড়ো করে উচ্চারণ করে, না।
ঘর ভেসে যাবে।
না।
পানি ও ঘরে এসে পড়বে।
না।
নিঃশব্দে মুচড়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় সামাদ। একবার শিরিন চোখ মেলে দ্যাখে, সামাদের মুখে তার নিজের কপালের ছায়া। সে ছায়ায় মুখটাকে দেখাচ্ছে মরা মানুষের খুলির মতো।
আবার সে চোখ মুখে দেখে সামাদ নেই।

শিরিন তখন উঠে দাঁড়ায়। পড়ে যেতে যেতে সামলে নেয় নিজেকে। তারপর ছেলেবেলায় প্রথম হাঁটার মতো টলমল পায়ে খাট ধরে, টেবিল ধরে, বেড়ার খুঁটি ধরে এগিয়ে যায় পাশের ঘরের দরোজার কাছে।

বিস্ফারিত দুচোখ মেলে শিরিন দ্যাখে, চৌকির ওপর হাঁটু জড়ো করে শুয়ে আছে রুবি। পাশে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে তার কোমরের দুপাশে কাতুকুতু দিচ্ছে সামাদ। মুখের ওপর বালিশ টেনে অদম্য হাসিটাকে চাপ দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে রুবি।

হঠাৎ তারা দুজনেই দ্যাখে শিরিনকে। সামাদ কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে, আবার ঝুঁকে পড়ে কাতুকুতু দেয় রুবি। রুবি মুখের ওপর থেকে বালিশ পেলে বাধাবন্ধনহীন ঝর্ণার মতো হেসে ওঠে এবার।

তারপর আঙুল দিয়ে রুবি সামাদকে দেখায় দরোজার দিকে? দরোজা খোলা। শিরিন সেখানে নেই। শিরিন বিছানাতেও ফিরে যায়নি।

জানালা খুলে, হাত বাড়িয়ে জুই গাছের ডাল সরিয়ে বৃষ্টির ঘন একটা চাদর দেখা যায় শুধু। আর কিছু না।

যদি তারা দেখতে পেত, তাহলে দেখত, শিরিন সেই সন্ধ্যে থেকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ভেতরে খাল পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে বুকের ভেতরে আগুন নিয়ে এখন এমন একটা গ্রামের দিকে যাচ্ছে যেখানে আর কোনো শোক নেই।