
হাসিনাসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সুখরঞ্জন বালির অভিযোগ
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০২৫
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বরাবর অভিযোগ দাখিল করেছেন ২০১২ সালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী দিতে আসা ও পরে অপহরণ করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি।
আজ বৃহস্পতিবার তিনি অভিযোগ দাখিল করেন। গুম, অপহরণ ও নির্যাতনসহ প্রায় ৫ বছর ভারতে অবৈধভাবে কারাবন্দি করে রাখার অভিযোগ করেছেন সুখরঞ্জন বালি।
তিনি অভিযোগে করেন, “দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় ও সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে আসায় আমাকে গুম করার উদ্দেশ্যে অপহরণ করে নির্যাতন করা হয়। প্রায় ৫ বছর ভারতে অবৈধভাবে আমাকে কারাবন্দি করেও রাখা হয়।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলাম, সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম আউয়াল, ট্রাইব্যুনালের সাবেক চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সাবেক প্রধান মো. সানাউল হক, তদন্তকারী কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনসহ অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন সুখরঞ্জন বালি। এছাড়া অপহরণে যেসব পুলিশ সদস্য জড়িত ছিল তাদের নামও উল্লেখ করেছেন সুখরঞ্জন বালি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, দুই মাস ১৩ দিন অন্ধকার কক্ষে তাকে আটক রাখা হয়। এরপর ভারতের কলকাতায় বিএসএফের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে তিনি ৫ বছর জেল খাটেন। এরপর দেশে ফিরে আসেন।
২০১২ সালে ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন সুখরঞ্জন বালি। আগে তিনি প্রসিকিউশনের পক্ষের সাক্ষী ছিলেন। তাই সেদিন তাকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহরণ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের প্রয়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসে তিনি ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে নিখোঁজ হন।
সুখরঞ্জন বালি অভিযোগে বলেন, “আমার ভাই বিশাবালিকে (বিশেশ্বর বালী) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন আমাকে পিরোজপুরের পাড়েরহাটের রাজলক্ষ্মী স্কুলে ডেকে ৭১-এ আমার ভাই বিশাবালির হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চায়। আমি তাকে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলি। কিন্তু হেলাল উদ্দিন আমাকে আমার ভাইয়ের হত্যাকারী হিসাবে প্রকৃত হত্যাকারীদের নামের সঙ্গে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নামও বলতে বলেন এবং তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমি হেলাল সাহেবকে (মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা) তখনই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেই যে, সাঈদী হুজুর আমার ভাই বিশাবালি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। সুতরাং, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল সাহেব আমাকে জোরপূর্বক রাজি করাতে সেখানেই আমাকে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকেন।”
সুখরঞ্জন বালি বলেন, “এরপর হেলাল উদ্দিন আমাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি করাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি এ কে এম আব্দুল আউয়াল ও পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেককে ডেকে আনেন। তারা আখতারুজ্জামান ফুলু ও কানাই লালা বিশ্বাসের নেতৃত্বে সাইদুল্লাহ লিটন, রেজাউল করিম শিকদার মন্টু, মিজানুর রহমান তালুকদার, সুমন সিকদার, দিলীপ মাঝি, রাজ্জাক খান বাদশা, মতিউর রহমান, মৃধা, শাহজাহান খান তালুকদার, মাসুদ আহম্মেদ রানা, শেখ ফিরোজ আহম্মেদ, গোলাম মাওলা নকিব, আমিনুল ইসলাম মিরন, ইরতিজা হাসান রাজু, খায়রুল ইসলাম মিঠু, মজনু তালুকদার, মৃধা মো. মনিরুজ্জামান, কে এম মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব ও রাসেল পারভেজ রাজাসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আরও কিছু লোককে রাজলক্ষ্মী স্কুলে হাজির করান।”
তিনি আরও বলেন, “তারা সেখানে উপস্থিত হয়েই আমাকে নানা রকম চাপ ও হুমকি দিতে থাকেন। আমি সাক্ষ্য দিতে রাজি না হলে, আউয়াল ও মালেক সাহেব আমাকে হত্যার হুমকি দেন। তাদের নির্দেশে রেজাউল করিম শিকদার মন্টু, সুমন সিকদার, দিলীপ মাঝি, রাজ্জাক খান বাদশা, শাহজাহান খান তালুকদার, মৃধা মো. মনিরুজ্জামান, মাসুদ আহম্মেদ রানা, মজনু তালুকদার ও মিজানুর রহমান তালুকদার মিলে আমাকে নির্দয়ভাবে পিটাতে থাকেন। তাদের নির্যাতন শেষ হলে সাইদুল্লাহ লিটন, শেখ ফিরোজ আহম্মেদ, গোলাম মাওলা নকিব, আমিনুল ইসলাম মিরন, মতিউর রহমান, ইরতিজা হাসান রাজু, খায়রুল ইসলাম মিঠু ও মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লবরা আমাকে চর, থাপ্পড় ও ঘুসি মারতে থাকে ও লাঠি দিয়ে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করতে থাকেন।”
সুখরঞ্জন বালি বলেন, “এরপরও আমি হুজুরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা আগামীকাল তাদের কথামতো সাক্ষ্য দিতে রাজি না হলে, সেদিনই আমার জীবনের শেষ দিন বলে শাসিয়ে চলে যান। আমি তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে চলে যাই। দীর্ঘদিন আমি বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে থাকি। হেলাল উদ্দিন, এ কে এম আব্দুল আউয়াল, হাবিবুর রহমান মালেক, আখতারুজ্জামান ফুলু, কানাই লালা বিশ্বাস, মিজানুর রহমান তালুকদারের নেতৃত্বে আমাকে করা নির্যাতনের অনেক দিন পর একদিন সাঈদী হুজুরের ছেলে জনাব মাসুদ সাঈদী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমার ভাই বিশাবালি হত্যার প্রকৃত ঘটনা জানতে চান। আমি তাকে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলি। তখন মাসুদ সাঈদী জানতে চান, এই সত্য ঘটনা আমি ট্রাইবুনালে এসে বলতে রাজি আছি কি না? জবাবে আমি সম্মতি প্রকাশ করলে, জনাব মাসুদ সাঈদী আমার ভাইয়ের হত্যার প্রকৃত ঘটনা ট্রাইব্যুনালে এসে বলার জন্য অনুরোধ জানান।”