অক্সফোর্ড, মডার্না ও ফাইজার: কোন ভ্যাকসিন কেমন

ড. অপূর্ব চৌধুরী

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৭, ২০২০

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ১৭২টি দেশের দুশোর বেশি প্রতিষ্ঠান করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যস্ত। এর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পাঁচটি দেশের সরকার নয়টি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি সাহায্য করেছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, চীন এবং অস্ট্রেলিয়া। ৮০টি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের ফান্ড থেকে অর্থ যোগান দিয়ে গবেষণা করছে।

এই ভ্যাকসিন প্রতিযোগিতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আট বিলিয়নের মতো ফান্ড যোগান দিয়েছে, আমেরিকা একাই তার গবেষণার কাজে দিচ্ছে ৯ বিলিয়ন, জার্মানি ২ বিলিয়ন, ইংল্যান্ড ১ বিলিয়নের মতো। বাকি ১৬৮টি দেশের দুশোর বেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ পঞ্চাশ বিলিয়নের মতো। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ভ্যাকসিন মার্কেট ছিল ৬০ বিলিয়ন ডলারের । আগামী দুই থেকে তিন বছরে এর পরিমান গিয়ে দাঁড়াবে ৯ ট্রিলিয়ন ডলারে।

কিন্তু এই মুহূর্তে মাত্র তিনটি ভ্যাকসিন সবার মুখে মুখে। অক্সফোর্ড, মডার্না ও ফাইজার। আসলে ফাইজার না বলে বলা উচিত, বায়োএনটেক BionTech। কারণ, গবেষণার মূল কাজটি করছে তিনটি মূল প্রতিষ্ঠান। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সাইন্স ডিপার্টমেন্টের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ।

আমেরিকার ব্যক্তি মালিকানাধীন বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান মডার্না, যা ২০১০ সালে Timothy Springer এবং Robert Langerসহ পাঁচজনের ইনভেস্টমেন্টে ওষুধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবে শুরু করে। জার্মানির বায়োএনটেক হলো Uğur Şahin এবং Özlem Türeci নামের তুরস্কের বংশোদ্ভূত জার্মান মুসলিম চিকিৎসক দম্পতির ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ২০০৮ সালে গড়ে ওঠা বায়োটেকনোলজির একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

এই তিনটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মূল ভ্যাকসিনটি তৈরি করছে। কিন্তু তা উৎপাদনের মতো বিশাল কাজটি করবে বাকি তিনটি ওষুধ তৈরির কোম্পানি। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি বাজারজাত করবে ওষুধ কোম্পানি AstraZeneca, মডার্নার ভ্যাকসিনটি করবে আমেরিকান একটি ওষুধ কোম্পানি Lonza, আর বায়োএনটেকেরটি করবে Pfizer।

ওষুধ বিক্রির দিক থেকে বিশ্বে এক নাম্বার সুজারল্যান্ডের Roche, দ্বিতীয় একই দেশের Novartis, তৃতীয় আমেরিকান  Pfizer। বিভিন্ন প্রকার ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন তৈরির মূল কাজ ছোট এবং অচেনা প্রতিষ্ঠানগুলো করলেও আসল দাও মারে বড় বড় ওধুধ কোম্পানিগুলো। তারা আদতে ওষুদের ফ্যাক্টরি ছাড়া কিছুই না। কাম করে একজন, নাম কামায় আরেকজন।

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি নাম ChAdOx1। এটিতে ব্যবহৃত উপাদানটি adenoviral vector। শিম্পাঞ্জির দেহে সর্দি কাশির জন্য Adenovirus নামের একধরনের ভাইরাস দায়ী। এটি দুর্বল ধরনের ভাইরাস। জেনেটিক্যালি ভাইরাসটির জেনেটিক কোড আংশিকভাবে নিয়ে একটি উপাদান তৈরি করা হয়, যাকে ভ্যাকসিন ভেক্টর বলে। তারপর তা শরীরে ঢুকালে শরীর ভাবে যে, রক্তে করোনা ভাইরাস ঢুকেছে। কারণ, করোনা ভাইরাসের মধ্যে থাকা প্রোটিনগুলোর জেনেটিক কোড আর ল্যাবে বানানো এডেনো ভেক্টরের কোড একই। তখন শরীর ভুল করে করোনা ভাইরাস ভেবে এন্টিবডি তৈরি করে। এন্টিবডির কাজ হলো, করোনা ভাইরাস শরীরে ঢুকলে তাকে মেরে ফেলা।

Ch নেয়া হলো chimpanzee থেকে, Ad নেয়া হলো Adenovirus থেকে, Ox নেয়া হলো Oxford থেকে। নাম করা হলো ChAdOx1। শুরুতে নাম দেখতে কঠিন লাগলেও জেনে ফেললে মজা লাগে এবং কখনো ভুলে যায় না। মডার্নার ভ্যাকসিনের নাম mRNA-1273। ভ্যাকসিনটিতে কোনো ভাইরাস সরাসরি নেই। সচরাচর ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় কোনো ভাইরাসকে দুর্বল করে অথবা তার আংশিক নিয়ে। যেমনটা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনে এডেনো ভাইরাস থেকে নেয়া জেনেটিক কোড ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মডার্নার ভ্যাকসিন প্রস্তুতির উপায়টি ভ্যাকসিন জগতে নতুন। সহজ করে বলছি ব্যাপারটি।

mRNA মানে হলো মেসেঞ্জার RNA। নতুন করোনা ভাইরাসটি একধরনের RNA ভাইরাস। ভাইরাসটির দেহে RNA নামক একটি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন তৈরির কিছু কোড লেখা থাকে। করোনা ভাইরাস যখন শরীরের কোষকে আক্রমণ করে, তখন ভাইরাস থেকে RNAটি কোষের ভেতর ঢুকে যায়। এই RNA নিজে কিছু করতে পারে না। কোষের ভেতর থাকা mRNA ভাইরাসের RNA এর একটা ডুপ্লিকেট কপি নিজের ভেতর নেয়। কোষের ভেতর থাকা রাইবোজোম সেই mRNA এর ভেতর থাকা কপি কোডকে নিজের কোষের কোড ভেবে প্রোটিন তৈরি করে, সেই প্রোটিন ধীরে ধীরে নতুন ভাইরাস তৈরী করে। মডার্না নিউ টেকনোলজিতে এই কোডসহ mRNA এর কিছু অংশ কৃত্রিমভাবে ল্যাবে তৈরি করে ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে।

শরীরে ভ্যাকসিনটি ঢুকালে mRNA এর ভেতর থাকা করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরির একই কোডের মতো হওয়ার কারণে  শরীর মনে করে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং এন্টিবডি তৈরি করে সেই ভাইরাসকে মারতে। এমন করে কোনো ভাইরাস কিংবা আংশিক ভাইরাস না ঢুকিয়ে শরীরকে এন্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে।

বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনটি নাম BNT162b2। এটিও মডার্নার মতো mRNA টেকনোলজি ব্যবহার করে ভ্যাকসিনটি প্রস্তুত করেছে। দুটোর কাজের পদ্ধতি একই। তিনটি ভ্যাকসিনের মধ্যে একটি সংখ্যার লড়াই চলছে। Catch phrase এর মতো Number phrase এখন চোখে পড়ানো হচ্ছে। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার দাবির আড়ালে সংখ্যা যুদ্ধ এখন বাজারের প্রধান গল্প।

সাধারণ মানুষ এমন সংখ্যাতে বিভ্রান্ত হয় সহজে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের হিসেব অন্য। একটি ভ্যাকসিন ৬০% কার্যকরী হলে যে ফলাফল দেবে, ৯০% হলেও একই ফলাফল দেবে। যেমন ওধুধের ক্ষেত্রে একটা মিনিমাম ডোজ নির্ধারণ করা হয়। এটাকে বলে Optimal dose। যে ডোজে ওষুধটি তার টার্গেট ফলাফল দেবে কিন্তু মিনিমাম সাইড ইফেক্ট হবে। তাই চিকিৎসকরা যখন বলে ওষুধটি প্রেস্ক্রিপশাসন অনুযায়ী খাবেন, বেশিও খাবেন না, কম খাবেন না। কম খেলে ইফেক্ট হবে না, বেশি খেলে ক্ষতি হবে।

PR প্রোপাগান্ডা অনুযায়ী, মডার্নার ৯৪.৫% কার্যকরী দাবি, বায়োএনটেকের দাবি শুরুতে ৯০% থাকলেও মডার্নার পরে হিসাব সাইজ করে ৯৫% দাবি করলো। অক্সফোর্ড এক্ষেত্রে সত্যটুকু বলার চেষ্টা করেছে। বয়সভেদে তাদের ভ্যাকসিন ৬২% থেকে ৯০% কার্যকরী। এখানে ফাইজার বা বায়োএনটেক এগিয়ে।  সংখ্যার যুদ্ধ বাদ দিয়ে অন্য দিকে যাই। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত মজুদ রাখা যায়। মডার্নার ভ্যাকসিন রাখা যায় এক মাস। ফাইজার বা বায়োএনটেকেরটি রাখা যায় মাত্র পাঁচদিন। এক্ষেত্রে অক্সফোর্ড এগিয়ে। সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচার অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের বেশি দেশগুলোর আছে। এক্ষেত্রে বায়োএনটেকেরটি কম টেকসই।

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি সংরক্ষণ করতে ৩৬ থেকে ৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট যথেষ্ট। মডার্নারটি রাখতে দরকার হয় মাইনাস ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন রাখতে মাইনাস ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এমন সংরক্ষণ ব্যবস্থা পৃথিবীর অনেক দেশেরই তেমন নেই। থাকলেও সীমিত। এক্ষেত্রেও অক্সফোর্ড এগিয়ে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের প্রতি ডোজের দাম পড়বে তিন থেকে চার ডলার। বায়োএনটেকেরটি প্রতি ডোজের মূল্য ১৯ থেকে ২১ ডলার। মডার্নার খরচ ৩২ থেকে ৩৭ ডলার। এক্ষেত্রেও অক্সফোর্ড সাশ্রয়ী। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর জন্যে।

এই মুহূর্তে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি মজুদ আছে দুশো মিলিয়ন ডোজ, ২০২১ সালে তারা ১.৫ বিলিয়ন ডোজ সাপ্লাই দিতে সক্ষম। ফাইজারের আছে ৫০ মিলিয়ন মজুদ, আগামী বছর দিতে পারবে পাঁচশো মিলিয়নের মতো। মডার্নার আছে ২০ মিলিয়নের মতো, আগামী বছর তারা এক বিলিয়ন ডোজ তৈরিতে সক্ষম। এ হিসেবে ফাইজার বা বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে ইফেক্টিভ হলেও সরবরাহ, সংরক্ষণ, মূল্য, সাপ্লাই, মার্কেটের বিচারে সবচেয়ে পিছিয়ে। মডার্নার অবস্থান মাঝামাঝি সবকিছুতে। লড়াইটা তাই তার অক্সফোর্ডের সাথে।

কার্যকরী সংখ্যায় অক্সফোর্ড বাকি দুটো থেকে পিছিয়ে থাকলেও দাম, সংরক্ষণ, সরবরাহ, ট্রাডিশনাল ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতি, মার্কেট ডিমান্ড সবকিছুর বিচারে সবচেয়ে এগিয়ে।