অজিত রায়ের আত্মস্মৃতি ‘যে যৌনতা নিষিদ্ধ তা-ই এসেছে লেখায়’

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০২০

রানীর গুলবাগিচার সঙ্গে আমাদের ত্রিজনের সামিল্য ছিল অপরূপ। আমার, উদয়নদা আর রবিশংকরের। বাগানে ঢুকলেই, সে হোক-না নিঃসীম দুপুর, এক ধরনের অদ্ভুত মায়ামাদল ছেয়ে যেত চাদ্দিক, এমন যে, মেয়েটির প্রতিটি চুমোয় মাটির আভা রক্তনীড় হয়ে যেতে থাকে। তিনজনেই রিভোল্ট করেছি `যৌনতা` শব্দে। আমরা... আমি, উদয়ন ঘোষ ও রবিশংকর বল। শব্দটির সাযুজ্য নাম দিয়েছি, কামকলা। এ নিয়ে রবিশংকরের একটি লেখাও ছেপেছিলাম `শহরে`, (`শহর` ৩১, যৌনতা সংখ্যা,২০০৫, পৃ.২৬)। শিরোনাম ছিল, এসো কামকলা। সেই কত বছর আগেই রবি আত্মিক স্বরে সরাসরিই বলেছিল, আমাদের দেশে যৌনতা এক ক্ষমতাতান্ত্রিক কাঠামো। এখানে সমকামীরা ঘৃণার বস্তু। এখানে পায়ুকামীরা নিগৃহীত। এখানে হস্তমৈথুন নিষিদ্ধ। অর্থাৎ বউয়ের সঙ্গে বিছানায়। এবং তা অন্ধকার ঘরে, সঙ্গম ব্যতীত সব আকাঙ্ক্ষা-কামনা-স্বপ্নকে কাঁটাতারের শাণিত হিংস্রতার ভিতরে আটকে ফেলা।

রবি, উদয়ন আর আমি হামেশা কামকলা শব্দটা ইউজ করেছি। মানে, প্রাধান্য দিয়েছি। আমরা যেমনটা ভাবতাম, যেমনটা ভালো লাগত ভাবতে। কারণ, মানুষ এবং তার স্বপ্ন তো সমাজের জন্য তৈরি হয়নি। আমরা মনে করেছি, শরীর তো এক যন্ত্রসঙ্গীতই। এভাবেই ভাবতে ভাবতে রবিশংকর একদিন লিখে ফেলল, ‘লিঙ্গ প্রবেশের মুহূর্ত এবং বীর্যপাত তো কয়েক সেকেন্ডের প্রক্রিয়া। তার আগের আলো-ছায়াময়তা...  ধ্রুপদী সঙ্গীতে যা আলাপে তাই আমার ভালো লাগে।’ (রবিশংকর, `শহর`, ঐ)। ক্ষমতাতান্ত্রিক পরিকাঠামোর যে ধরনের যৌনতা নিষিদ্ধ তা-ই ধ্রুপদী সঙ্গীতের আলাপের মতো ঘুরেফিরে এসেছে আমাদের লেখায়... আমার, উদয়নের আর রবির লেখায়। আমাদের তিনজনের মধ্যে এ বিষয়ে, কামকলা বিষয়ে রবির ভাবনাটা ছিল অপেক্ষাকৃত করুণ ও যুগপৎ রোম্যান্টিক। ওর `মধ্যরাত্রির জীবনী`তে আছে একাদিক্রমে স্বপ্নদোষ, পায়ুগমন, নারী শরীরের ভয়ংকর জেগে ওঠা ইত্যাদি।

সে অবশ্য আমার `যোজন ভাইরাসেও আছে, নারীর ক্ষুধাতুর জেগে ওঠা, এবং অতঃপর, আলাপ থেকে ঝালা। অরুণেশ ঘোষের `সন্তদের রাত` উপন্যাসের কথক অরুণেশ, অরুণেশও আমার আর রবির মতো ভেবেছিল। আসলে কী জানো তনুময়, আমরা যারা এসব নিয়ে কালাতিপাত করে মরলাম, তারা তো জীবনে নিছক কুহক চায়নি, তারা জীবনই চেয়ে এসেছে মৃত্যুপূর্ব লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যেভাবে বলেছিলেন, আমি তোমাদের জীবনভর বিরক্তই স্রেফ করে এসেছি, কিছুই কাজের কাজ করে যেতে পারিনি। ক্ষমা কোরো। আমি বা রবিশংকর বা উদয়ন বা অরুণেশ, আমরাও আর কিছুই করে যেতে পারিনি। রবিশংকর তো কখনো ভাবেইনি যে, এক একটি মেটাফর শব্দ দিয়ে তৈরি হয়েও, কী ভীষণ পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছিল সে, এবং কিভাবে তার নিজের অস্তিত্বে ক্লানডেস্টাইন চালিয়ে গেছে। বস্তুতপক্ষে, শেষের দিকে সে যে লিখতে পারছিল না, মানে সে `একদা` গল্পকার-ঔপন্যাসিক ছিল, অথচ ইদানীং সে শাদা পৃষ্ঠা ও কলমের মুখোমুখি দাঁড়াতেও ভয় পাচ্ছিল, তা ওই তার মেটাফরের জন্যই তো!

আসলে কী জানো তনুময়, আমরা পুরুষ গদ্যকাররা মৃত্যুপূর্ব একজন পাঠিকা চায় যার ডাহুকের তলপেটের মতো খলবলে ও কোমল স্তনযুগে মুখ গুঁজে লিখে যেতে পারে,... কিন্তু, বস্তুত, উদয়ন আর রবি, এবং আমার গদ্য যাদের পড়ার কথা সেসব স্পার্ম, আগুন আর ধূলিস্যাৎ-প্রিয় স্বচ্ছ, বোল্ড, মসৃণ তথা তুলীন মেয়েরা আজও স্রেফ কবিতার বালিকায় নোঙর বেছায়! থমাস কুক লিমিটেডের সুপারস্পিড বাসে পো ভ্যালির ওপর দিয়ে প্রথমে জেনেভা। তারপর আল্পসের পার্বত্য সুড়ঙ্গ ফুঁড়ে, ফ্রান্স হয়ে ইংলিশ চ্যানেলের তলদেশে ডোভারের সুদীর্ঘ টিউব বেয়ে রাতারাতি পিকাডেলি সার্কাস। সেখান থেকে মেট্রো ধরে গ্যাটউইক এয়ারপোর্ট। কে এল এম রয়্যাল ডাচ এয়ারলাইন্স লন্ডন থেকে আমাদের টিকিট কনফার্ম করেছে। আমাদের ফ্লাইট ছিল কাল সন্ধ্যে ছ`টায়। আমার আর রবির। কাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ যখন উদয়নের গাড়ি ছাড়ল, জীবনানন্দ সরণি হয়ে মানিক এভিনিউ ধরে কমলকুমার বাস-টার্মিনাল অব্দি ছেড়ে দেবে বলে, তখনও আমরা ছিলাম পরস্পর মূক ও বধির, এবং তখনও বেশ রোদ ছিল নৈঋতে।

হাইওয়ে ধরা অব্দি কারো কোনো কথা ছিল না, টানা। টার্মিনাল পর্যন্ত কোথাও না, স্প্যানিশ স্টেপস থেকে ডাইনে বাঁক নিয়ে, কীটস আর শেলীর স্মৃতিভাণ্ডার ছড়িয়ে, উদয়নদার গাড়ি ফোন্তনা দি ত্রৈভির সামনে ক্ষণেক দাঁড়াল। খয়েরি-কপিশ কাচ ফুঁড়ে তখনও কিছু রোদ। আমি দেখলাম, রোদের ফোয়ারা ঝরে উঠছে ত্রৈভির মুখ বেয়ে। উঠে, ঝরে পড়ছে। সেখানে খয়েরি-কালো বোঁটার মতো জলের ধারা। আমি রবিশংকরের মুখের দিকে সপ্রশ্ন চাইলাম। রবি সিগারেট ধারাল, আমাকে দিল। তারপর কাচ নামিয়ে, বলল, এখানে একটা কয়েন ফ্যালো। এই জলে।
আমি ও উদয়ন অবাক ঢেলে তাকালাম।
`রোম আবার তোমায় ডাকবে।` ও বলল।
জিজ্ঞেস করলাম, `তুমি যে মিরাকলে বিশ্বাস করো না, রবি!`
ছলছলে চোখে তাকাল, মৃদু হেসেও, বলল, `ইচ্ছে হয়, করতে।`
তারপর সে নিজেই, কোটের পকেট থেকে কৌটোটা বের করল, আমি বা উদয়ন বাধা দিলাম না। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

উদয়নদার গাড়ি ছেড়ে দিল। আমি আর রবি আশির দশক থেকে একে-অপরের গদ্যকে শ্যেন চোখে দেখে আসছিলাম। কথা হয় নব্বুইয়ে পৌঁছে। প্রথম কথা। খুবই কম কথা হতো আমাদের মধ্যে, কিন্তু যেটুকু হতো স্রেফ একে-অপরের গদ্যের মুগ্ধতা। ওর আকস্মিক চলে যাওয়ার জন্য আমি প্রস্তুতই ছিলাম। প্রায়ই বলত, স্মৃতি সংখ্যার জন্য লেখাটা পাঠাচ্ছি। পারত না। প্রায়ই হাসপাতাল। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত। আজ ভোরবেলা যখন তনুময়ের মেসেজ পড়লাম, রবিশংকর চলে গেছে, না, একদমই বিচলিত হইনি। সে তো কৌটোটা পকেটে নিয়েই ঘুরত।

কান্নার প্রশ্নও ওঠে না। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে। নীরবে জীবনানন্দ সরণি পেরোচ্ছি। এসময়ের আলোয় সূর্য থাকে না। প্লেন উড়ে যাওয়া এয়ারস্ট্রিপের মতো বিশাল অর্থহীন দেখায় জীবনের আয়োজন। শুধু একা এক প্যাঁচে কাটা সবুজ-শাদা ঘুড়ি নেমে নেমে ভেসে ভেসে ঘুরে ঘুরে পড়ছে ২০১৭-র ১০ জানুয়ারি থেকে। দীপঙ্কর, পিনাসী, বারীনের আদ্রিয়াটিক সমুদ্র আমারই পায়ের কাছে, ঘন ঘন ছুঁয়ে যায়, ছুঁয়ে যায়, শুধুই ছুঁয়ে যায়... সে নির্জীব, শুকিয়ে।

লেখক: কথাসাহিত্যক ও সম্পাদক (ছোটকাগজ ‘শহর’)