অতনু সিংহের কবিতাগুচ্ছ
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৯
মায়াপদাবলী
আখ্যানমূলক বাক্যের ভিতর
চাষাবাদ চলেছিল একদিন
তুমি তো জানো
জলের ভিতরে মাছ
আর হাওয়ার ভিতরে
এই নশ্বর জীবন কেমন
গাছের বন্ধুতায় অমরতা পেয়েছিল,
যদি তুমি এই দুপুর-তন্দ্রায়
ব্যথাতাড়িত ঘুমাও এখন
অঙ্গে অঙ্গে ফিরে পাবা
সেই নদীর গল্পে পুনর্জন্মের আখ্যান—
আলো ক্রমে কমে আসিবার পর
গলুই ছুঁয়েছে চাঁদ...
তোমার বিদ্যা আছিল দশটি তন্ত্র
স্বপ্নসম্ভবে নিশ্চই তুমি টের পাবা
তোমার বাদামি পেটের উপর মানুষের
জন্মদাগ আজও এই অবেলায়
ভিতরে ভিতরে খুব রেখাপাত করে—
আদিতে যখন ছিল না সময়
নাদ হতে নাদ হতে
কীভাবে হে আদিম অন্ধকার
আমাদের তুমি নদী দিয়েছিলা
ভাবো আরেকবার, আলো হয়ে উঠে
কত মাঝিরে করতেছ খেয়া পারাপার
আজ জড় ও বুদ্ধির দিনমানে
মানুষের জিন্দেগী স্মৃতি মেরে খায়
বিবৃতিময় কথামালা হতে খসে যায় জবাফুলগুলি!
আলোময় ভালো ভালো মানুষেরা না কি
পেয়ে যায় আকাশের জ্ঞান
অথচ গাছ, মাছ, পাখীমার ফুলেল সকাল,
বীজের ভিতরে ধরা আলোর কবিতা
তারা সব বিলকুল ভুলে গেছে...
দায়বদ্ধতা থেকে দায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে
মানুষেরা খুব মেশিনের সাথে মাস্তি করেছে
এইখানে বাক্যের যতি ভুলে যাও
দ্যাখো সকালের দরজায়
স্থানিক গল্প হতে
কে ফকির বাটি হাতে চেয়েছে
তোমার সময় ভিক্ষা
পুরাণে তো তিনিই তোমার
তারে ধারণ করেছ তুমি
অবজ্ঞায়, কী মহামায়ায়!
সে লোক চাষবাস পারে না তেমন
দেয়ালায় কাঁদে-হাসে.
নেশা করে কতদূর হেঁটে যায়,
দ্যাখো দৃশ্যেরা কেমন তোমার হাতের তালুতে
ফের নতুন জন্ম হয়ে ওঠে
যেন নতুন তাঁতের যন্ত্রে বোনা
লাল কাপড়ের ওপর চাঁদ চিরমায়াময়,
এখানে কাব্যের মঙ্গলধ্বনি আলোমুখে
ভেসেছে আবার
তার পাতায় পাতায়
তুমিই ফের অনন্ত সময়
এ দুনিয়ায় জলের মহিমা
পুরাণ-স্বপ্নে দ্যাখো যুগলে তোমার সাথে
সে তিনি তো আমিই কেবল
আমি তোমারে ধারণ করি বাক্যে
পারি না কিছুই আর
শুধু তোমারেই লিখে ফেলি
লিখে ফেলি চন্দ্রাহত কবিতা একখান
ত্রুটি
দুইটি কৃষ্ণ-বাদামি ফুল
ফুটেছিল তোমার বক্ষদ্বয় জুড়ে
আমি অমাবস্যার বাগানে
স্পর্শের ভিতরে
পাইলাম জন্মনির্দেশনা আমার
তোমারে কুণ্ডলী সঁপেছি যদিও
তবু এই কানুনের সংসার,
বোকা আমি
রীতিনীতি ভেবে
কিছু ভুল করেছি নিশ্চয়
অন্ধের মতো
সেই থেকে অভিশাপে অভিশাপে
বন্দী পাতালে!
উপরে মায়া ও মাংসের শিকড় তোমার
নীচে জল রাতভোর
আমি তার ভিতরে দেয়ালা কাটি
আমি গন্ধে ব্যকুল হয়ে
সারারাত জেগে থাকি পরিত্যক্ত পাতাল স্টেশনে
একদিন সিঁড়ি দিয়ে উঠে পাই যদি
জন্মের আশ্চর্য পূর্ণিমা, কোজাগরী আকাশ
সংসার
মা`র অসুখ সুদীর্ঘকাল
এবার বাবা অসুস্থ হলেন সন্ধ্যায়
আমি আজ সারাদিন
পড়েছি অন্নদামঙ্গল
ধানজমি আর নিজস্ব সরল পানি
ছিল না শহরে
শুধু কারখানা অনর্গল
আছিল নৌকাস্বপ্ন আমাদের।
বাজারে কখনো আসতো নতুন চাল
শীতকাল মানে গুড়
মা পিঠা বানাতো সারাটা বিকেল
বাবার বাইসাইকেল ঝুলে
আমার ইস্কুল ছিল ভোরবেলা
বাবা বাজার করতে ভালোবাসতেন৷
মা সংসারী মা রান্নাঘর
বাবা আমাদের ছাদ
বাবা লুকিয়ে খাওয়া লালজল
সিগারেট আর সিগারেট,
তিনি টইটই
মা না থাকলে বাপ আমার মতোই
কবেই ভ্যাগাবন হয়ে যেতেন!
আমি বখে যাওয়া আধুনিক থেকে
আরও উত্তরে জল টলমল
ডুবলাম আর ডুবলাম
তবু ইদানীং ঘুম ভাঙে তাড়াতাড়ি
শুনি জানলায় আলোর প্রথম স্বর,
মা-বাবা শান্ত হতে বলেছে আমাকে।
আজ ভোরবেলা পড়েছি অন্নদামঙ্গল
আমার বাপ ঈশ্বরী মাঝি; ভোলানাথ।
মা অন্নপূর্ণা অতএব।
সন্তান থাক দুধেভাতে--
আমার মতোই সব বখাটে সন্তান
আজন্ম শুনেছে শিব-পার্বতীর মুখ হতে।
ওগো আখ্যানমালা
(উৎসর্গ- উৎপলকুমার বসু)
সুরমা নদীর পাশে আছিল
একদা একটি সহস্র বৎসর পুরাতন বটগাছ—
এহেন আখ্যানমূলক আলাপের পাশে
একটি নির্বাক পাথর আজও জেগে আছে
যেন স্মৃতিচিহ্ন জন্মের!
সুপ্ত লিপির উপরে
তাকে স্পর্শ করো
তার কথামালা সারাৎসার
তুমি কি পাঠোদ্ধার জানো?
অথবা ভাষার প্রয়োজন থেমে গেলে
প্রাচীন বৃক্ষ হতে
কোনো এক অমাবস্যার রাতে
তুমি কি শুনতে পাও ধ্বনির প্রবাহ?
সেই প্রস্তরখন্ডের উপর
কত ঋতু পারাপার, কত ছায়া হারমোনি
নক্ষত্রের আলো হতে কত ফুল
ঝরে পড়ে আলেয়ায়!
আর শীতকাল এলে ছায়ামানুষের শিস,
শীৎকার অবিরাম, কত কত চন্দ্রগ্রহণ!
এই রেখাপাত ভিতরে তাহার
জমাট হয়েছে, একদিন ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেলে
তোমরা শেষবার সমবেত স্নানে যাবে যবে
কারো খোঁপায় বুনোফুল পুণরায় শোভা পাবে
তখন গানের দিন আয়নায়,
জলে ভাসা পদ্মপাতায়...
আমরা বলব ফের গল্পের ছলে
একদা সুরমা নদীর তীরে বৃদ্ধ মহাদ্রুম তলে
নির্বাণ পাথরের সুর যেন অলীক মহিমা
আমাদের বস্তুনগরে, আমাদের শেষের নৌকায়...