অতুলপ্রসাদ সেনের ৭ গান

প্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০১৯

গীতিকার, সুরকার ও গায়ক অতুলপ্রসাদ সেনের আজ প্রয়াণদিবস। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট তিনি মারা যান। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন কাওরাইদ ব্রহ্ম মন্দিরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তার প্রয়াণদিবসে তার রচিত সাতটি গান ছাড়পত্রের শ্রদ্ধার্ঘ্য:

জল বলে চল, মোর সাথে চল

জল বলে চল, মোর সাথে চল
তোর আঁখিজল, হবে না বিফল, কখনো হবে না বিফল।
চেয়ে দেখ মোর নীল জলে শত চাঁদ করে টল মল।
জল বলে চল, মোর সাথে চল।
বধু রে আন তরা করি, বধুরে আন তরা করি,
কূলে এসে মধু হেসে ভরবে গাগরী,
ভরবে প্রেমের হৃদ কলসি, করবে ছল ছল।
জল বলে চল, মোর সাথে চল।
মোরা বাহিরে চঞ্চল, মোরা অন্তরে অতল,
সে অতলে সদা জ্বলে রতন উজল।
এই বুকে, ফোটে সুখে, হাসিমুখে শতদল,
নহে তীরে, এই নীরে, গভীরে শীতল।
জল বলে চল, মোর সাথে চল।

নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন

নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন,
তুই সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন।
মূঢ় মন, সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন।
নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন।
লাগে নি যার পায়ে ধুলি, কি নিবি তার চরণ ধুলি,
নয়রে সোনায়, বনের কাঠেই হয় রে চন্দন।
মূঢ় মন, হয় রে চন্দন।
নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন।
এ মোধন মায়ের মতন, দুঃখীটুতেই অধিক যতন,
এ ধনেতে ধনি যে জন, সেই তো মহাজন।
মূঢ় মন, সেই তো মহাজন।
বৃথা তোর কৃচ্ছসাধন, সেবাই নরের শ্রেষ্ঠ সাধন,
মানবের পরম তীর্থ দীনের শ্রীচরণ।
মূঢ় মন, দীনের শ্রীচরণ।
মতামতের তর্কে মত্ত, আছিস ভুলে পরম সত্য,
সকল ঘরে সকল নরে আছেন নারায়ণ।
মূঢ় মন, আছেন নারায়ণ।
নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন।

ওগো নিঠুর দরদী

ওগো নিঠুর দরদী, ও কি খেলছ অনুক্ষণ।
তোমার কাঁটায় ভরা বন, তোমার প্রেমে ভরা মন,
মিছে খাও কাঁটার ব্যথা, সহিতে না পার তা আমার আঁখিজল,
ওগো আমার আঁখিজল তোমায় করেগো চঞ্চল
তাই নাই বুঝি বিফল আমার অশ্রু বরিশন।
ওগো নিঠুর দরদী।
ডাকিলে কও না কথা, কি নিঠুর নিরবতা।
আবার ফিরে চাও, তুমি আবার ফিরে চাও,
বল ওগো শুনে যাও
তোমার সাথে আছে আমার অনেক কথন।
এ কি খেলছ অনুক্ষণ,
ওগো নিঠুর দরদী।

ভারত-লক্ষ্মী

উঠ গো, ভারত লক্ষ্মী! উঠ আদি জগত-জন-পূজ্যা!
দুঃখ দৈন সব নাশি`, কর দূরিত ভারত লজ্জা।|
       ছাড়গো, ছাড় শোক-শয্যা, কর সজ্জা
       পুনঃ কমল-কনক-ধন-ধান্যে!
জননি গো, লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে ;
কাঁদিছে তব চরণ তলে, ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো।
কাণ্ডারি! নাহিক কমলা, দুখ লাঞ্ছিত ভারতবর্ষে,
শঙ্কিত মোরা সব যাত্রী, কাল-সাগর-কম্পন-দর্শে,
       তোমার অভয়-পদ-স্পর্শে, নব হর্ষে,
       পুনঃ চলিবে তরণী শুভ লক্ষ্যে।
জননি গো, লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে;
কাঁদিছে তব চরণ তলে, ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো।
ভারত-শ্মশান কর পূর্ণ পুনঃ কোকিল-কূজিত কুঞ্জে,
দ্বেষ হিংশা করি চূর্ণ, কর পূরিত প্রেম-অলি-গুঞ্জে
       দূরিত করি পাপ-পুঞ্জে, তপঃ-পুঞ্জে,
       পুনঃ বিমল কর ভারত-পূণ্যে।
জননি গো, লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে;
কাঁদিছে তব চরণ তলে, ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো।

বল, বল, বল সবে

     বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে,
ভারত আবার জগত-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।
     ধর্মে মহান্ হবে, কর্মে মহান্ হবে,
নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পুরবে!
     আজও গিরিরাজ রয়েছে প্রহরী,
     ঘিরি তিনদিক নাচিছে লহরী,
যায়নি শুকায়ে গঙ্গা গোদাবরী, এখনও অমৃতবাহিনী।
     প্রতি প্রান্তর, প্রতি গুহা বন,
প্রতি জনপদ, তীর্থ অগণন, কহিছে গৌরব-কাহিনী।
     বিদুষী মৈত্রেয়ী খনা লীলাবতী,
     সতি সাবিত্রী সীতা অরুন্ধতী,
বহু বীরবালা বীরেন্দ্র-প্রসূতি, আমরা তাঁদেরই সন্ততি।
     ভোলেনি ভারত, ভোলেনি সে কথা,
     অহিংসার বাণী উঠেছিল হেথা,
নানক, নিমাই করেছিল ভাই, সকল ভারত-নন্দনে।
     ভুলি ধর্ম-দ্বেষ জাতি-অভিমান,
ত্রিশকোটি দেহ হবে এক প্রাণ, একজাতি প্রেম-বন্ধনে।
     মোদের এ দেশ নাহি রবে পিছে,
     ঋষি-রাজকুল জন্মেনি মিছে,
দুদিনের তরে হীনতা সহিছে, জাগিবে আবার জাগিবে।
     আসিবে শিল্প-ধন-বাণিজ্য,
আসিবে বিদ্যা-বিনয়-বীর্য, আসিবে আবার আসিবে।
     এস হে কৃষক কুটির-নিবাসী,
     এস অনার্য গিরি-বনবাসী,
এস হে সংসারী, এস হে সন্ন্যাসী, মিল হে মায়ের চরণে।
     এস অবনত, এস হে শিক্ষিত,
পরহিত-ব্রতে হইয়া দীক্ষিত, মিল হে মায়ের চরণে।
     এস হে হিন্দু, এস মুসলমান,
এস হে পারসী, বৌদ্ধ, খৃষ্টিয়ান্, মিল হে মায়ের চরণে।

হও ধরমেতে ধীর

হও ধরমেতে ধীর                        হও করমেতে বীর,
               হও উন্নত শির, নাহি ভয়।
ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান,                    হও সবে আগুয়ান,
               সাথে আছে ভগবান, হবে জয়।
               নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
               বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান্;
দেখিয়া ভারেতে মহা-জাতির উত্থান, জগজন মানিবে বিস্ময়!
               তেত্রিশ কোটি মোরা নহি কভু ক্ষীণ,
               হতে পারি দীন, তবু নহি মোরা হীন!
ভারতে জনম, পুনঃ আসিবে সুদিন, ঐ দেখ প্রভাত-উদয়!
ন্যায় বিরাজিত যাদের করে, বিঘ্ন পরাজিত তাদের শরে;
সাম্য কভু নাহি স্বার্থে ডরে, সত্যের নাহি পরাজয়।

বাংলা ভাষা

মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!
কি যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
         (এমন কোথা আর আছে গো!)
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।
ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
               (মরি হায়, হায়রে!)
আছে কৈ এমন ভাষা এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা।
বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন:
             (আরও কত মধুপ গো!)
ঐ ফুলেরই মধুর রসে বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।
বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগত্ জিনে!
            (গরব কোথায় রাখি গো!)
তোমার চরণ-তীর্থে আজি জগত্ করে যাওয়া-আসা।
ঐ ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে `মা, মা` ব`লে;
ঐ ভাষাতেই বলবো হরি, সাঙ্গ হ`লে কাঁদা হাসা।