অনুপম হীরা মণ্ডল

অনুপম হীরা মণ্ডল

অনুপম হীরা মণ্ডলের ৪ কবিতা

প্রকাশিত : অক্টোবর ২০, ২০২০

ধানের ঘ্রাণ

প্রতিদিন কী এক দুঃসহ বেদনা
ফিরে ফিরে আসে। যেন নিয়ত পরিচিত
আমার অনিদ্রা আর দুঃচিন্তার মধ্যে।
আমি টের পাই তালগাছের মাথিতে গুবরে পোকায় আক্রান্তের মতো
কুরে কুরে খায় আমার মগজ গোপনে গোপনে।
তুমি দিব্যি ঘুমিয়ে যাচ্ছ সঙ্গোপনে নিশ্বাস ফেলে
আমারই শয্যা পাশে নিশ্চিন্ত, নির্লিপ্ত তুমি—
চঞ্চল আমার ঘ্রাণের মায়ায়।

অঘ্রানে পালা করা ধানের গাদায়
তুমি আর আমি শীতের অনুভূতি নিতে থাকি
বাকরুদ্ধ এক সকালের রোদে।
চেয়ে থাকো তুমি আমিও থাকি চেয়ে
যেখানে ঘাসেদের বুক ফুড়ে রোদের নাচন ওঠে
সেইখানে নরম এক ঠাণ্ডা বাতাসে
পালা করা ধানের ঘ্রাণে।

জলোচ্ছ্বাসের জল

মেঘেদের আস্তানায় চোখ পড়েছে এবার
গোপনে গোপনে সব দুরভিসন্ধি দূর করে
বর্ষার পতন ঘটাবো আমরা।

কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে বিধাতা
জলের কণিকারে অভিসারী রাক্ষস হয়ে গণিকার মতো
কৈফিয়ত নেবার সময় বেশি নেই।
খরায় পুড়ছে এখন বরেন্দ্রের পলল ভূমি
ছনের ডগা আর পিঁপড়ে ছানা তৃষ্ণায় কাতর দেখেও
অনন্ত জলধারায় শায়িত তুমি।

কী এক খেয়ালি নেশায় আর্য ঋষির দল
গেয়ে চলে জলধারা মন্থনের সুর।
অথচ শুদ্রের বিপদে এগিয়ে আসেনি কোনো নীল
উল্টো হিমালয়ের স্রোতোস্বিনীকে আটকে ধরেছে
নীলকণ্ঠী রূপকে কোনো এক অসুর।
শুকনো বীজের গর্ভে জন্ম নিয়ে আমরা
হয়ে উঠি জলোচ্ছ্বাসের জল।

ভাটফুলের সমাধি

অবহেলায় বেড়ে ওঠা ভাটফুল
ভোরের বাতাসে আশ্রয় চায়
অফুরন্ত ফসলি মাঠে জোটে না আশ্রয়, উপরন্তু
ক্ষুধার্ত পাখিরা তাকিয়ে থাকে লিবিয়ায়
ডিমভাঙা পাখির শোকের অশ্রুতে
সলিল সামাধি ঘটে ঝরে পড়া পাপড়িদের।
কখনো বা বুনোফুল ভাসতে ভাসতে গিয়ে ওঠে আফ্রিকায়।

আমিতো ভাটফুল হতে চাই তোমাদের মতো
নিদারুণ কষ্টের বোঝা ঝেড়ে ফেলে জ্যৈষ্ঠের বাতাসে
তাকিয়ে থাকবো নিষ্পাপ নিশিথে কুহকী পাখির মতো
যেখানে জোছনারা উড়ে উড়ে পালায় রাতের গহীনে
আর আঁধারের পথধরে বাজপাখি শিকার ধরতে আসে।

কোথায় বসন্তের ফুল কোথায় সে কেতকী কামেনী
সমুদ্রের কিনারে যুবতীর আব্রু নিয়ে হাসছে বসে
শুভ্রকান্তি সে উদ্ধত নাবিক এলিয়ে পড়ে জোছনার ঘ্রাণে
ভাটফুলের পাপড়িদের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে শেষে।

পাহাড়ের কান্না

আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
ভোরের বাতাসে টিলার উপর।
আরো উপর থেকে ভোরের আলো এসে
আমাদের জাগিয়ে দিলো।
তখনো ঘুম জড়িয়ে আছে আমাদের নাগরিক চোখে
ক্লান্তির ছাপ চোখে ও মুখে
কিন্তু ঠিক জেগে ছিলো ছোট্ট সেই সবুজ পাহাড়।
রাঙামাটির বুক ফুঁড়ে ওঠা গাছেরা ঘুমায়নি,
ঘুমায়নি পাহাড়ী কিশোরী, আর সদা সন্ত্রস্ত
গর্ভবতী পাখিদের দল জেগে ছিলো।

গর্ভবতী পাখি আলাপ করে আমলকি বনের লতানো
গাছগুলোর সাথে। রাত জেগে জেগে শোনে তারা
নিরন্তর পাহাড়ের বোবা কান্না।

নিথর নিস্তব্ধ কংক্রিটের মতো আমরা
নাগরিক মন নিয়ে পাহাড়ে এসেছি
আমরা ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে থাকি।
পাহাড়ি জেগে থাকে, জাগ্রত থাকে, সজাগ থাকে
তাদের চোখে ঘুম নেই।
ঘুমায় কেবল জলপাই বনের
নিশাচর পাখি।