অবরোহী

উপন্যাস ৩

আশাজ যুবায়ের

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০১৯

টোটন বলল, তাইলে আধঘণ্টা?
অবরোহী বলল, আরে নাহ। মারামারি না। বলেই শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে, ঠোঁট কাটতে থাকে। আর তর্জনিটা বারবার নাড়াচাড়া করতে থাকে।

ঠিক এই মুহূর্তে জগতের সমস্ত চিন্তা ওর মাথয় সওয়ার হয়েছে। উম, তুড়ি বাজিয়ে, চোখ গুলিয়ে সফলতার ভঙ্গিতে ও বলে উঠল, পাইছি।

ওর বিস্ময়কর আবিষ্কারের দরুণ নয়ন-টোটোনের চেহারা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, কি কি?
অবরোহী ওদের কৌতূহল মেটাতে বলল, বুড়ি মরার পর ওকে আমি তেঁতুলগাছের মাথায় রেখে আসবো। রোদে শুকিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজিয়ে শাস্তি দেব আর কাউকে যেন অমনভাবে না বকে।

টোটনরা বড়বড় চোখ নিয়ে সাগ্রহে কথাগুলো গিলতে থাকে। চেহারায় কিছুটা ভয়ও আছে। অবরোহীর বলা শেষ হলে নয়ন বলল, ওরেব্বাস। এত কঠিন শাস্তি?
অবরোহী বলল, হু, তো আবার কী? তেঁতুল গাছে কেন রাখব জানিস তো?
ওরা পুরা মাথা লেফট-রাইট করে, না।
অবরোহী বলল, তেঁতুল গাছে পেতনি থাকে। ওকে পেতনিরা কাজের বেটি বানিয়ে রাখবে। কাপড় ধোয়াবে, উঠান ঝাড়ু দেয়াবে। আমার সাথে লাগতে আসে বুড়ি!

টোটন বলল, কিন্তু বুড়ির মরদেহ আমরা কীভাবে পাব? শুনেছি মানুষ নাকি অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেলে মরার পরে ভূত হয়ে যায়? আমি না ভূতে খুব ভয় পাই। এমনিতেই রাতে পেশাব করি জানালা দিয়ে।

কথা শুনে ওরা দুজনেই হো হো করে উঠল। েটোটনের কিছুই যায় আসে না এতে। ভূত বলে কথা! সামান্য ঠাট্টার দরুণ যদি এই দূরুহ কাজটা থেকে ছাড় পাওয়া যায় সেটাই আপাতত বড় পাওয়া।

অবরোহী হাসি থামাতে পারছে না। বারবার দম ফুরিয়ে যাচ্ছে, পেটে হাত দিয়ে ও হ ও হ করে অবিরত হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে ঢুলে নয়নের গায়ে পড়ছে। নয়নও হেসে কুটিকুটি। ওদের হাসিতে টোটন মুখ বেজার করে বলে, উম, হাসো হাসো। হাসবাই তো।

আঁচলে চোখ মুছে অবরোহী বলল, অ্যাই শালা, যাহ তোরে লাগবে না। বলে হাসিটা থামানোর চেষ্টায় আবারও বলেন, ওহ ওহ করে নিজের মাথায় হাত চাপড়াচ্ছে। কথা শেষ হতেই অদৃশ্য হেসে বলে, তোমার মাথায় এসব উদ্ভট বুদ্ধি কোত্থেকে আসতো?

অবরোহী বলল, আপনাকে কেউ ওভাবে বকলে কী করতেন শুনি?
অদৃশ্য নিশব্দে হেসে জবাব দেয়, বুড়িকে তেঁতুল গাছের মাথায় রেখেছিলে?

লম্বা শ্বাস ফেলে সে বলেন, নাহ। দাদি মারা যাবার পর আমিই সবচে কেঁদেছিলাম। ওনার বকুনিগুলো প্রচণ্ড অভাববোধ করতাম। পরে মনে হয়েছে, জীবনে বিরোধিতা না থাকলে জীবন বড্ড একঘেয়ে আর পানসে লাগে। সত্যি বলতে কী, মানুষের রাগ, অভিমান বয়সের সাথে সাথে বৃদ্ধ হয়ে যায়। ভাবনা বদলে কখন যেন উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষোভের পেট চিরে বেরিয়ে আসে সহমর্মিতার বিনম্র স্রোত। কখনও কখনও অপরকে একটু ভালো রাখবার জন্য বাঁচতে শিখতে হয়। সম্ভবত তখনই আমরা কিছুটা মানুষ হয়ে উঠি। জগতের নিয়ম এমনি-পুষেরাখা বিরক্তিগুলো ভালবাসায় বদলে অজান্তেই হৃদয়ের গভীরে মোটা জায়গা দখল করে থাকে। মনের তারতম্য খুবই আজব।

কথাগুলো শেষ করতেই অবরোহীর চোখে কিছুটা জল গড়িয়ে পড়ল এবং অবস-আবেগে তাকিয়ে রইল উদ্দেশ্যহীন ভাবে। অদৃশ্যও কিছুটা চুপ রইল পরবর্তীতে এগিয়ে যেতে। আমরা এখন এখান থেকে পিছে ফিরে যাব ঠিক ৬৭ বছর পিছনে,অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে।

চলবে