অমিতাভ পালের গদ্য ‘কবিতাই বিপ্লব’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১

কবিতাই বিপ্লব, অথবা তার প্রচার সচিব।
চলমানের ওপর খবরদারি কবিতাই করে, করতে পারে। চলমান মোটা দাগে দুইভাগে বিভক্ত: সহনীয় ও অসহ্য। আর এই দুই অবস্থা তৈরি হয় প্রধানত সমকালীন শাসকদের ভূমিকার কারণে। তারাই হয় সামাজিক পৃথিবীর যান্ত্রিক উপাদানগুলিকে অযান্ত্রিক করে তোলে মূলত প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এবং এই প্রভাব বিস্তারের পিছনে ক্রিয়াশীল থাকে স্বার্থান্ধ উদ্যোগ। অথবা তারা ব্যবস্থাপনার এমন কোনো সুষ্ঠু পদ্ধতি সামাজিক পৃথিবীর চলিষ্ণুতাকে ধরে রাখতে ব্যবহার করে, যা সমাজের যান্ত্রিক উপাদানগুলিকে তেল মোবিল যোগান দেয়, ফলে সমাজ হোঁচট খায় না।

কবিতা এই দুই অবস্থার সাথেই যুদ্ধ করে সবসময়, এদের নাড়া দিতে চায়, বদলাতে চায় আরো সুষ্ঠু সমাজযন্ত্রের প্রয়োজনে। এই প্রয়োজনের জন্ম হয় জনতার গর্ভাশয়ে। এবং কবিতা জনতার মিত্র। বিপ্লব একটি ক্রিয়া। এমনিতে পৃথিবীতে সবসময়ই পরিবর্তন হচ্ছে, হবে এই বিরাট গ্রহযন্ত্রের নিজস্ব নিয়মেই। এই নিয়ম প্রকৃতির জন্ম দিয়েছে, প্রাণের জন্ম দিয়েছে, বিবর্তনের সুইচ টিপেছে। আমরা যদি আসন্ন অসীম কাল পর্যন্ত জীবনযাপন করে যাই তাহলে বিভিন্ন সময়ে এই পরিবর্তনের ফলগুলি দেখতে পাব। অতীত ইতিহাস আমাদের অনেক ফল দেখিয়েছেও।

এই ফল মূলত অনেক অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের সমষ্টি। এই সমষ্টি যখন ধারে-ভারে বিপুল হয়ে ওঠে, তখন ঘটে পরিবর্তনের উল্লম্ফন এবং সেটাই ফল। এই ফল পাবার জন্য অনেক সময় ও ধৈর্যের প্রয়োজন। এটা স্বাভাবিক, কারণ বিপুল ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই বিরাট বিশাল এবং তারা তৈরি হয়েছে তুচ্ছতম কণা ও বলসমূহের সাহসে। ফলে এখানে সময় ও ধৈর্যেরও বিপুল হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু মানুষের হাতেতো এত সময় নাই। এমনিতে আয়ুর পরিসীমা নিতান্তই অল্প, তার ওপর প্রয়োজনের চাপ— সবমিলিয়ে নিজের উপযোগী জগৎ তৈরিতে তার ব্রহ্মাণ্ডের কাছে নত হয়ে থাকলে চলবে না।

ফলে পরিবর্তনের গতি বাড়াতে হবে তাকে এবং এরজন্য জানতে হবে পরিবর্তনের নিয়ম। নিয়ম জানা থাকলেই নিয়মকে তাতিয়ে তোলা যায়। বিপ্লব হলো এই নিয়ম জানা ও তাকে তাতিয়ে তোলা। অর্থাৎ যা যেভাবে চলছে তাকে একটু ঠেলে একটা শর্টকাট পথ ধরিয়ে দেয়া যাতে সে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছায়। সমকালীন শাসকরা এটা বোঝে, তাই তারা এই ঠেলে দেয়াটাকে আটকে দিতে চায় বা দেরি করিয়ে দেবার কৌশল করে।

কবিতা সবসময় শাসকদের এই মনোভাবের বিরোধী। সে চায় অসহ্য এবং সহনীয়— দুই অবস্থাকেই প্রগতির পথে গতিশীল করতে। প্রগতি অর্থাৎ আজকের চেয়ে আগামীকাল আরেকটু যথার্থ হওয়া, আরেকটু এগিয়ে যাওয়া সুশৃঙ্খলতার দিকে যেন সৌন্দর্য নির্মাণ করা যায় জীবনে, সমাজে, পার্থিব ব্যবস্থাপনায়। ফলে সে শাসকদের দিকে আঙুল তোলে, তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চায় পথের ওপর পড়ে থাকা অনাবশ্যক পাথরের মতো, জনতাকে জানিয়ে দিতে চায় নিয়মের খুঁটিনাটি, দেখাতে চায় পথ। এবং এই কাজগুলি সে করে সবার আগে শিক্ষকের মতো, দূরদর্শীর মতো, প্রদর্শকের মতো।

দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান— সবাই তার ছাত্র, তার কল্পনার মুরিদ, তার সাহসে সাহসী। কবিতাই মানুষকে নাড়ায়, দেখায়, ভাবায়।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক