আকরাম খান

আকরাম খান

আকরাম খানের ৬ কবিতা

প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২০

অপচয়

যত দিন যাচ্ছে তত বেশি করে মনে হচ্ছে,
অপচয় একটা অমার্জনীয় অপরাধ!
ছোটকাল থেকেই আমি খাবার নষ্ট করি না
মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে জন্মেছিলাম
টের পাই নাই না খাওয়ার কষ্ট।
একদিন পাশের বস্তিতে শুনি
ঠাস ঠাস মারের শব্দ
শিশুর আর্তকান্না আর মহিলার বাজখাই চিৎকার,
‘হারাদিন মাই চুষবো, হারাদিন মাই চুষবো....
বুকে একটুও দুধ নাই....
হারামজাদার পেটভর্তি খুদা...!’
তারপর কতবার দেখেছি বিয়েবাড়িতে রেস্টুরেন্টে
সাধ্যের অধিক নিয়ে না খেতে পেরে ফেলে দিতে!

মেধার অপচয় প্রত্যক্ষ করেছি কৈশোরে,
পারার রনি ভাই
মেহেদি হাসানের মতো রেশমি গানের গলা
নিপুণ আঙুল হারমোনিয়ামের রীডে
জাদুকরের মতো খেলতো!
জীবনে একটাই লক্ষ্য, বিশ্বভারতীতে ক্লাসিকাল শেখা
প্রায় প্রতিদিন যাওয়া-আসা করতো ভারতীয় দূতাবাসে।
রক্ষণশীল মায়ের কঠোর হুকুম
‘বুয়েট না-হয় মেডিকেল’
এখন রনি ভাই তালতলা মসজিদের
উপরতলার মেসে থাকে,
কঠিন তাবলিগ!

আমাদের ডাকসাইটে সুন্দরী বান্ধবী সোমা
দিনভর চাঁদনি চক, সানরাইজ প্লাজা, আড়ংয়ে চক্কর দিত
পড়ে থাকতো দর্জির দোকানে
দুইটা আলমারি একটা ওয়ারড্রব
থ্রি পিছ, লেহেঙ্গা, শাড়ি, স্কার্ট-টপ্সে ঠাসা
বাইরেও দুই একটা কাপড়ের গাট্টি
পার্টি ওদের লেগেই থাকতো
কখনোই একই ড্রেসের পুনরাবৃত্তি হতো না!
সোমা এখন তিনটা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ের মা
সূর্য যখন ছাদে অস্ত যায় ওর খুব ইচ্ছা করে
আত্মহত্যা করতে,
বেশ কয়েক বছর ধরে সোমা আটপৌরে পোষাকে
স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি।

আমারও আছে একটা অপচয়ের বদ অভ্যাস
কাগজ ছিড়ি, মুড়িয়ে ফেলে দেই
কোনো কোনোটা পায় আরাধ্য পরিণতি
বেশিরভাগই হয় নানা সাইজের ঠোঙা
কিছু নৌকা হয়ে ভাসে জলে
কয়েকটা কাগজের এরোপ্লেন উড়ে যায় আসমানে!

সবচেয়ে গর্হিত অপচয়ের সাক্ষী থাকলাম মহামারিতে
নির্লিপ্ত মুক্তবাজারে অগণিত প্রাণের নিঃশব্দ অপচয়!

জঙ্গলের স্মৃতি

তাঁবুর জীবন কাটিয়েছিলাম কোনো এক শতাব্দীতে,
দিন শেষে ট্রাউজার ভরে উঠতো চোরকাঁটায়।
ছিলাম যে জঙ্গলে সেখানে রাতে কখনো
পৌঁছাতো না কোনো আলো, উদ্ভাসিত হতো শুধু জোছনায়—
অথচ সেই দুর্গমে বৃষ্টির পানি থেকে কখনো
বঞ্চিত হতো না কোনো বন্যপ্রাণী, পোকামাকড়, লতাগুল্ম, বৃক্ষ।
মধাহ্নে সূর্যের ভ্রুকুটি থেকে রেহাই ছিল না কারো;
তার অনুগ্রহও ছিল অবারিত।
পল্লবিত সবুজ এ স্বপ্ন বিস্তৃত ছিল আদিগন্ত।

নগরে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রাণান্তকর প্রতিযোগিতায়
ম্লান হতে হতে জঙ্গলের সেই স্মৃতি কবে যেন
লুপ্ত হয়ে গেছে।

অনেক অনেক দিন পর পথ ভুলে অরণ্যে এসে
চকমকি পাথরের ঘষায় জ্বলে ওঠা স্ফুলিঙ্গের মতো
চকিতে ঝলসে ওঠে আদি জন্ম আমার।

অংক

অংকে আমি বরাবরই কাঁচা।
কৈশোরে বণিক স্যার বলতেন,
`ভালো করে গণিত শেখো—
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর বড্ড প্রয়োজন।’
সৌভাগ্যক্রমে অনেকদিন অংক কষার
আর প্রয়োজনই হয় নাই,
কিন্তু আজকাল বাড়ি ফেরার পথে
প্রায়ই হিসাব করতে হচ্ছে
আমার অনিশ্চিত জীবিকার সীমিত আয় থেকে
ঠিক কত টাকা আজ খসে পড়ল।

তেলাপোকা

তেলাপোকা দেখলে খুব মায়া হয়
কেউ যদি তাকে উল্টায় দেয়
প্রচণ্ড আক্রোশে হাত পা ছুড়তে থাকে বাতাসে
কিছুতেই বুঝতে পারে না কীভাবে উল্টায় গেল
কীভাবেই বা সে সোজা হবে
যদি কেউ দয়া করে আবার সোজা করে দেয়
দ্রুত পালায় যায় বিপদসীমা ছেড়ে,
উল্টায় যাওয়ার আর সোজা হওয়ার
মাঝখানের সময়ের মাজেজা
কোনোদিন পারে না বুঝতে।
আমাদের উপরঅলাও মাঝে মাঝে আমাদের
উল্টায় দেন!

বাড়ি বদল

শুনেছি এ গলিতেই নাকি থাকো
যদিও জানি না কোন বাড়ির ফলকে
খোদাই করা তোমার ঠিকানা,
চাতক চোখ বারান্দায় বারান্দায় খোঁজে পরিচিত অবয়ব!
প্রতিটি বাড়ির ফটক পার হবার সময় রোমাঞ্চ হয়
এই বুঝি হন্তদন্ত বেরিয়ে আসলে আটপৌরে পোশাকে
প্রয়োজনীয় তৈজস কেনার জন্য
অথবা ধীর পায়ে সেজেগুজে আগ্রহের কোনো জায়গায়
যাবার উদ্দেশ্যে।
লুকিয়ে বাড়ি বদলে পার পেয়ে গেছ ভেবে
হাসছো মিটিমিটি
দেখো একদিন ঠিক সামনে পড়ে যাবে হতচকিয়ে!

কবিতার ধ্বংসাবশেষ

তোমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি
বিস্মৃত কোনো হ্রদের সাক্ষ্য বহন করে,
শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ মরা নদীর।
দীর্ঘশ্বাসে উড়ে আসা তপ্ত বালু কেঁদে বলে,
`একদা এই ভূখণ্ড ছিল সবুজাভ।’
চাল ধোয়া হাত, খইরঙা হাঁস আর মধুকুপী ঘাস
খুঁজে পেতে ঘাটতে পারো রূপসী বাংলার হলদে পাতা।

বিকল কম্পাস হাতে দিকভ্রান্ত যোদ্ধার কবিতায়
এখন লেগে থাকে রক্তের দাগ আর বারুদের গন্ধ।
কিছু পোড়া শব্দ অনুমান করে নিতে পারো,
মার্জনা করো একাধিক দগ্ধ ছিদ্র।