আজ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বাণী

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০২৫

গণ-অভ্যুত্থান দিবস আজ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের এই দিনে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষমতায় চেপে বসা ১৬ বছরের স্বৈরাচারের অবসান হয়।

পরবর্তীতে ৫ আগস্টকে গণ-অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এরই মধ্যে দিবসটি পালনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা আজ মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। রাজনৈতিক দলগুলোও এ দিবসে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

কোটা সংস্কার দাবিতে গত বছর ১ জুলাই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া গুলি, গণগ্রেফতার ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলা ও সংঘর্ষ একপর্যায়ে সরকার পতনের একদফা দাবিতে রূপ নেয়। আন্দোলনটা কোটা দিয়ে শুরু হলেও তা শেষ হয় হাসিনার পতনে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট কারফিউ ভেঙে গণভবন অভিমুখে লাখো মানুষের ঢল নামলে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।

সারাবিশ্বে এই আন্দোলন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নামে পরিচিতি পায়। এরপর ৬ আগস্ট দুপুরে বঙ্গভবন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। এতে উল্লেখ করা হয়, তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

এক তরফাভাবে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন শেখ হাসিনা। অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ মাত্র ছয় মাসের মাথায় ভেঙে দেওয়া হয়। ভারতের সমর্থনে টানা ১৬ বছর দেশের ওপর চেপে বসেছিল ভয়ংকর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। তার ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এর বিরুদ্ধে জেগে ওঠে ছাত্র-জনতা।

আন্দোলন দমাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালান হাসিনা। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় দেশের মানুষকে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনায় ১১৮ শিশুসহ ১ হাজার ৪০০ জনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। শিশু হত্যার হার ১২-১৩ শতাংশ। আহত হয়েছে প্রায় ১২ হাজার।

রাষ্ট্রপতির বাণী
দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, “আজ ঐতিহাসিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলে ২০২৪ সালের আজকের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। ঐতিহাসিক এই অর্জনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমি দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।”

তিনি আরও বলেন, “আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সব শহিদকে, যারা দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে গিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। এই গণ-অভ্যুত্থানে আহত, পঙ্গুত্ব বরণ করা ও দৃষ্টিশক্তি হারানো সব বীর জুলাই যোদ্ধার ত্যাগ ও অবদানকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবার ও আহতদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ।”

রাষ্ট্রপতি বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, অপহরণ ও ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ। এই বৈষম্যমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করাই ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করে জুলাই-এর চেতনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র একটি ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে, প্রকৃত গণতান্ত্রিক উত্তরণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে একটি ন্যায় ও সমতাভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ। আজকের এই দিনে এ আমার একান্ত প্রত্যাশা। আমি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে গৃহীত সব কর্মসূচির সাফল্য কামনা করি।”

প্রধান উপদেষ্টার বাণী
পৃথক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন আজ। এক বছর আগে এই দিনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পূর্ণতা পায়, দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, যাদের যূথবদ্ধ আন্দোলনের ফসল আমাদের এই ঐতিহাসিক অর্জন, তাদের সবাইকে আমি এই দিনে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আজ আমি স্মরণ করছি সেই সব সাহসী তরুণ, শ্রমিক, দিনমজুর, পেশাজীবীদের, যারা ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে শাহাদতবরণ করেছেন।”

তিনি আরও বলেন, “আমি গণ-অভ্যুত্থানে শাহাদতবরণকারী সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি সব জুলাই যোদ্ধাকে যারা আহত হয়েছেন, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। জাতি তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। টানা ১৬ বছরের স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিস্ফোরণ ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে এ সব লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব খাতে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। জুলাই গণহত্যার বিচার কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। জুলাই শহিদদের স্মৃতি রক্ষা ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে রাজনৈতিক ও নির্বাচনব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় সব সংস্কারে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সাথে আলোচনা চলমান আছে।”

তিনি আরও বলেন, “একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধানের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। জুলাই আমাদের নতুন করে আশার আলো-একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। হাজারও শহিদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।”

ড. ইউনূস বলেন, “পতিত স্বৈরাচার ও তার স্বার্থলোভি গোষ্ঠী এখনও দেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। আসুন সবাই মিলে আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না।”

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি
আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পতনের স্মারক হিসেবে আজ মঙ্গলবার ও আগামীকাল বুধবার দেশজুড়ে বিজয় র্যালি করবে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আজ দেশের সব থানা ও উপজেলায় এবং আগামীকাল সব জেলা ও মহানগরে র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামীকাল বেলা ২টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বিজয় র্যালি বের হবে।

আজ গণমিছিল করবে জামায়াতে ইসলামী। রাজধানীর মহাখালী কলেরা হাসপাতালের সামনে থেকে সকাল ১০টায় মিছিলপূর্ব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। স্বৈরাচার পতন দিবস পালন করবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে দিনব্যাপী নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করবে দলটি।

এতে রয়েছে সকাল ১০টায় গণসমাবেশ, দুপুর ১২টায় গণমিছিল ও আড়াইটায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান দিবসে বিকেল সাড়ে ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাম গণতান্ত্রিক জোট সমাবেশ করবে।