আবু তাহের সরফরাজের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০২৫

রক্তস্নাত জুলাই

বৃষ্টিস্নাত জুলাই মাসে খুনরাঙা রাজপথ
পুলিশ-সেনার সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক বাজাচ্ছে নহবত।
বৃষ্টিধারার মতোই বুলেট ছুটছে দিগ্বিদিক
মরছে যত বাড়ছে তত জনস্রোতের দিক।

মাগো তোমার কোলের খোকা দুধমাখা ভাত ফেলে
সেই যে গেল ফিরল না আর... ভাবছো, বোকা ছেলে
খিদে পেলে ফিরবে ঠিকই, তাই তো বসে ঘরে
জানলা দিয়ে চেয়ে আছো তিন রাস্তার মোড়ে।

ওই পাড়াতে জ্বলছে আগুন সেই পাড়াতে কার্ফু
পাশের বাড়ির হামিদ মিয়া ছুটে আসেন, শোন বু—
খোকা যে তোর আর বেঁচে নেই বুলেটে বুক ঝাঁঝরা
লুটিয়ে পড়েন স্নেহময়ী মা আমাদের হাজরা।

ঝর ঝর ঝর বৃষ্টি ঝরে নাকি রক্তবন্যা?
রক্তজবার টকটকে লাল বাংলা মায়ের কন্যা।
মাগো তোমার সন্তানেরা এবার ক্ষেপেছে
মানুষখেকো ডাইনিটা তাই পালিয়ে বেঁচেছে।

জুলাই এপিটাফ

লাল জুলাইয়ে জনস্রোতে ভাঙলো কারাদূর্গ
মুক্ত হলো মানবতা স্বাধীনতার সূর্য।
নতুন দিনের রক্তরাঙা পূব-আকাশের গায়
নবীন প্রাণের সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়।

অন্ধকারের ভাঁজ খুলে যে আনলো রাঙা ভোর
সেই কিশোরের রক্তে ভেজা বাংলা মায়ের ক্রোড়।
ঘরে-ঘরে মাতম করেন স্নেহময়ী মা
হামার বেটাক মারলু কেনে? জবাব দিয়ে যা।

বাংলা মায়ের সবুজ আঁচল বাঙালির মানচিত্র
শহিদ ছেলের রক্তে লেখা বৃষ্টি ভেজা পত্র।
কী লিখেছে আবু সাঈদ? কী লিখেছে মুগ্ধ?
জুলাই কেন লাল হয়ে যায়, লাল কেন হয় যুদ্ধ!

শহিদ ভাইয়ের রক্তে লেখা জুলাই এপিটাফ
যুগান্তরের সন্ধিক্ষণে স্মারক ফটোগ্রাফ।
এই ছবিটা সব বাঙালির বুকের ফ্রেমে থাক
বাংলা মায়ের সন্তানেরা আবার দেবে ডাক।

বাংলা মায়ের দামাল ছেলে

বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ লক্ষ-কোটি জনতা
প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে কাড়তে খুনির ক্ষমতা।
স্বৈরশাসক বাংলাদেশের রক্তচোষা রানি
শাসন-ত্রাসে জনগণের রুদ্ধ মুখের বাণী।

কণ্ঠ ছেড়ে দেশের মানুষ গর্জে ওঠে আজ
স্বাধীনতার নতুন বিজয় রক্ত কারুকাজ।
পুলিশ-সেনার তপ্ত বুলেট ভেদ করে যায় বুক
মৃত্যু হবে জেনেও মানুষ রাজপথে উন্মুখ।

অন্ধকারের কার্ফু ভেঙে নামলো জনঢল
খুনি রানির মসনদে ঝড় উঠলো যে টলমল।
বাংলা মায়ের সবুজ জমিন বারুদ দিয়ে জ্বালিয়ে
আগস্ট মাসের ৫ তারিখে রানি গেলেন পালিয়ে।

স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে নতুন দিনের ভোর
রক্তজবার রঙে সূর্য রাঙায় মাতৃক্রোড়।
বাংলাদেশের ফুল-ফসলে সম্ভাবনার হাসি
বাংলা মায়ের দামাল ছেলে ছাত্র শ্রমিক চাষি।

প্রতিবাদী ছেলে

আগুন নাকি ঝলসে ওঠে আরও আগুন পেলে?
প্রতিবাদের মিছিলে তাই প্রতিবাদী ছেলে।
দুই দিকে দুই হাত ছড়িয়ে বুক দিলো সে পেতে
স্বৈরাচারীর ঘাতক বুলেট বক্ষে এসে বেঁধে।

বুলেটে বুক ঝাঁঝরা তবু সাহস কী অদম্য
মরণজয়ী এই কাফেলা আনলো দেশে সাম্য।
আবু সাঈদ পথ দেখালো মৃত্যু যে খুব তুচ্ছ
তাই তো রাঙা পলাশ ফুলে ফিঙে নাচায় পুচ্ছ।

গুচ্ছফুলের পাপড়িরাঙা শহিদের ওই দরজা
প্রাণ-পাখিটা উড়ে গিয়ে নির্ভরতায় ধর যা।
পিদিম হাতে সন্ধেবেলা বসে আছেন মা
কবর জিয়ারতে বাবা অশ্রু মোছেন না।

পুঁইলতাটি মাচার ওপর করছে কাকে খোঁজ?
শহিদ ছেলের রক্তে রাঙা সূর্য ওঠে রোজ।
রোদ ঝলমল নতুন দিনের সূর্য সে তো নয়
বাহাত্তুরের সংবিধানেই শাসন আজও হয়।

মুক্তির প্রত্যয়

শহিদ মিনারে জন-সমাবেশে মুক্তির প্রত্যয়
ষোলোটি বছর দাস হয়ে আছি আর দাসত্ব নয়।
এবার নিজের দেশের মাটিতে নিজেদের অধিকার
কেড়ে নিতে ভাঙো স্বৈরাচারীর লৌহ-কঠিন দ্বার।

দিকে-দিকে ক্রুর হায়েনারা তাক করে আছে বন্দুক
তপ্ত বুলেট ভেদ করে যায় আবু সাঈদের বুক।
মুহূর্তে গণ-জোয়ারের ঢল চারদিকে স্ফিত
মৃত্যুর ভয়ে হয় না তো আর কেউ এতটুকু ভীত।

পথে-পথে আজ রোদের ঝিলিক মিছিলের পুরোভাগে
জনতার স্রোত স্লোগানে মুখর তীব্র ঘৃণার রাগে।
স্বৈর-শাসনে ভীত-বিহ্বল বুকে আজ নেই শঙ্কা
শৃঙ্খল বেড়ি ভেঙেচুড়ে ওই বেজে ওঠে রণ-ডঙ্কা।

বাঙালির বুকে দ্রোহী চেতনার দরজা রয়েছে খোলা
টোকা দিয়ে দ্যাখো ছুটবে আগুন যেন কামানের গোলা।