আনযীর

উপন্যাস ১

আশাজ যূবায়ের

প্রকাশিত : জুন ২৫, ২০১৮

বাঁশঝাড়ের উঁচু ফাঁক দিয়ে নবচাঁদটা উবু হয়ে উঁকি দিচ্ছে। আজ প্রকৃতি বড় অদ্ভুত লাগছে, ঠিক এ সময়টি নির্দ্বিধায় মহাকালের সাক্ষী হবার যোগ্যতা রাখতে পারবে। খণ্ড-বিখণ্ড হালকা কালো মেঘের থোকাগুলো অপারভাবে চাঁদকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, যাতে একটুও বিরক্ত হচ্ছে না চাঁদ। আচ্ছা, প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারলো কী করে? পৃথিবী গোছানোর ভার যার, নিঃসন্দেহে সে সত্তা রুচিসম্পন্ন এবং প্রশংসনীয়। এমন একটা মুহূর্তে কেবল দুনিয়াতে প্রেমই মানায়, দুঃখ নয়। তবে বিদ্রোহী প্রেমও একটু জায়গা পাওয়ার অধিকার রাখে। প্রেমের ধর্মই তো সুখ, চাই তা যে পক্ষেরই হোক। এই মাহেন্দ্রক্ষণে দূর হতে বিষাদের যুগল আওয়াজ হঠাৎ কানে ভেসে উঠলো। একটি হুক্কা টানার সড়াৎ সড়াৎ আওয়াজ, অপরটি প্রসব যন্ত্রণার।

লম্বা উঠানে খেজুর পাতার পাটি পেতে হুক্কা টানছে ৬০ বছর বয়সী আবেদ মিয়া। বাঁ ঘাড়ে ঝুলানো গামছাটা সামান্য বাদে বাদে নামিয়ে ক্লান্ত ঘাম মুছে নিচ্ছে বেখেয়ালি। ওর ঘন সাদা দাড়ি আর চওড়া কালো মুখখানি হুক্কার ধোঁয়ায় রুপো রঙের লাগছে, আর কপালের মোটা ভাঁজে মনে হচ্ছে, জগতের সব চিন্তা ওই কপালে এসে জড়ো হয়েছে। অবশ্য এ সময়টায় চিন্তা না করলেও যে পৃথিবী ওকে স্বার্থপর তকমা দেবে। প্রসব যন্ত্রণার আওয়াজ করা মেয়েটি যে তারই ঔরষজাত আনযেরা। একঢালা মাটির ঘরের মধ্য থেকে যে আওয়াজ ভেসে আসছে তা শান্ত পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলছে। মেয়ে দেখতে যেতে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি সে কোনোভাবেই পেতে পারে না এখন, দাইমার নিষেধ।

আনযেরা সটান শুয়ে ব্যথার সাথে সমঝোতা করতে চেষ্টা করছে। মাঝেমধ্যে কুঁকড়ে উঠছে `উ মা আর আল্লাগো` বলে। নাক ফেঁপে নিঃশ্বাস নেয়ায় মনে হচ্ছে, চোখদুটো বের হয়ে গেল বুঝি। প্রাণও যায় যায়। দাইমা গুনগুন করে দোয়া পড়ছে সাথে ওর কপালের মোটা ঘামের ফোঁটাগুলো মুছে দিচ্ছে ত্যানা দিয়ে। এদিকে কুপিও ক্রমশ নিঃসপ্রভ হয়ে উঠছে। আনযেরার বাম দিকে রাখা বাটিতে গরম পানিতে নেকড়া ভিজানো, সাথে বাঁশের ধারালো ছিলকা যা দিয়ে নবজাতকের নাড়ি কাটবে।

গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাদের একটা কাহওয়াত আছে, বাচ্চা যেইডা পেডের মইদ্যে কষ্ট বেশি দেয় হেইডা দুনিয়ায় আইলে আগুন লাগাইয়্যা দেয়। দাইমা দৌড়ে ঘরের চৌকাঠে এসে আবেদ মিয়াকে ভীত গলায় ডাকল, ভাইছাব, ও ভাইছাব জলদি আহেন। আবেদ মিয়া বেগতিক দৌড়ে এসে উপচে পড়লো দরজায়, কি-কি হইছে বুজি?
তাড়াতাড়ি মৌলবিছাবরে খবর দেন। খতম পড়ানো লাগবো। অবস্থা বালা লাগতাছে না। পোলাডা মনে হয় উল্ডাইয়্যা গেছে পেডের ভিতরে।
কী কন বুজি। ঘাড়ের গামছায় মুখ মুছেই দৌড়াতে আরম্ভ করলো আবেদ মিয়া মসজিদ পানে। ঘুমন্ত পৃথিবীর পাজরে ওর দীর্ঘ পায়ের ধপাস ধপাস আওয়াজ খুব মাতাল করে তুলছে রাস্তার ধুলো। কিছুক্ষণ পর পর দূর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ ভেসে আসছে পালটা জবাবে। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি বাঁকানো গাছের লম্বা লাইনে যে কেউই ভুল বুঝবে কোনো টানেলের ভিতর দেশ অথবা ভূতেদের রাস্তাঘাট ভেবে। ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো মনে হচ্ছে অন্ধকারের ছেঁড়ায় আলোর তালি লাগানো।

চাঁদটা একদম মসজিদের মিনারের চূড়ায় প্রচণ্ড বাতাসসহ খেলা করছে। দ্রুত চলছে সাদামেঘগুলো। মেঘের সাথে তাল মিলিয়ে মিনারটিও প্রদক্ষিণ করছে আকাশকে। বাতাসের তেজে মনে ধরছে মহপ্রলয়ের পূর্বপ্রস্তুতি চলছে। গ্রামের মানুষ ভাবে পরিবেশ আর পূর্ণিমা তিথিতে নাকি জ্বিনেদের বিয়ের মোক্ষম সময়। বোরাকে চড়ে জমিদারি কায়দায় পাইক-পেয়াদা নিয়ে সারবেঁধে আসমানে ওড়ে। শ্লোক গাইতে গাইতে বিয়ে করতে যায় ওরা। অবশ্য কোনো মানুষ যদি দেখে ফেলে তাকেও নাকি অন্তত দশ দিনের জন্য বরযাত্রী বানায় এবং নিমন্ত্রণ করে ওরা। অবশ্য দশ দিনেরও নাকি একটা বিশেষ অর্থ আছে ওদের কাছে।

মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে একেবারে বিশাল নদীর কোলে আশ্রয় নিয়ে বহুকালের স্মৃতি হয়ে। রাতের নদী গর্জনের সাথে মসজিদের বন্ধুত্বও বেশ প্রাচীন। যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী মৌলভী সাহেব নিজেও। মসজিদের গা ঘেঁষে লাগানো ছোটটো একটি ঘরে উনি থাকেন। বেশ আমলি ও আল্লাহঅলা মানুষ। মৌলভি সাহেব ঘটাস করে দরজা খুলে লাঠিতে ভর দিয়ে এগুচ্ছেন নদীর ঘাটে। ওজু করে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে কালিমা শাহাদাত পড়লেন আসমানের দিকে তাকিয়ে। মসজিদে ঢুকলেন। মসজিদটি অত রাতে ভীষণ অচেনা দেখাচ্ছে। মিম্বার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন উনি। মিম্বার বরাবর জ্বিনেরা নামাজ আদায় করে। অবশ্য ওদের থেকে মুত্তাকি বেশি হলে তাকেই ইমাম হিসেবে ওরা অনুসরণ করে গভীর রাতের তাহাজ্জুদ নামাজে। মৌলভি সাহেব মনোনিবেশ করলেন নামাজে। সূরা আলিফ লাম মিম সেজদা পড়ছেন মধুর সুরে। এমন সময় আবেদ মিয়ার কণ্ঠ কানে উঠলো তার।

মৌলভিছাব, মৌলভিছা গো...
নামাজ খাটো করে মৌলভি সাহেব বাইরে এসে দেখলেন, বিধ্বস্ত আবেদ মিয়া। তার আকুল আকুতি, তার সঙ্গে যেতে হবে। বে-জবান আবেদ মিয়া বলে উঠতে পারলো না কিছু, ইশারায় বোঝালো সব। মৌলভি সাহেব তড়িৎ ঘরে গিয়ে শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে চরালেন, সাথে জিন্না টুপি মাথায়। হ্যান্ডব্যাগটা হাতে লটকে অন্যহাতে তাজবিহ আর লাঠি নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন তার সাথে। আবেদ মৃদু গতিতে দৌড়াচ্ছে। মৌলভি সাহেব সামর্থ অনুযায়ী হাঁটছেন। উভয়ের পায়ের ভারি আওয়াজ ঝিঁঝি পোকার আওয়াজকে হার মানিয়ে দিতে পেরেছে আজ।

উঠানের আঙিনায় পা রাখতেই নবজাতক শিশুর মায়াবি কান্নার আওয়াজ কানে বিঁধল তাদের। আবেদ খুশিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মৌলভি সাহেব ওর ঘাড়ে হাত রেখে শান্ত হবার সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বললেন, যে যত বেশি কষ্ট দেয়, সে তত বেশি ভালোবাসা আদায় করে নেয়।

সেই খুশিতেই হিচকিয়ে কাঁদতে পারলো ও। দাইমা নবজাতকে একটি পুরানো চেক লুঙির ত্যানায় জড়িয়ে ধরল আবেদের সামনে। ওর আনন্দের অশ্রুঝরে পড়ছে পিচ্চির কপালে। মৌলভি সাহেবের হাতে দিয়ে বলল, হুজুর দোয়া কইরা দেন। লগে একটা নাম দিয়া দেন সুন্দর চাইয়্যা। মৌলভি সাহেব দুহাতে উঁচিয়ে দোয়া করে একটা কবিতা পড়লেন,
বহত তালেব খোদা মিলতা শেখাস্তা
দিল নাহি মিলতা শেখাস্তা
দিল জিছে হাসিল হাকিকাতে ওয়োহে কামিল।

এরপর বললেন, ওর নাম দিলাম, আনযীর।

চলবে