‘আপনা’কে খোঁজার আর্তনাদ: স্কুল বলতেই তোমাকেই বুঝি

আঁখি সিদ্দিকা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯

‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ যদি ধরে নেই এটি বইয়ের নাম নয়, আর এই বাক্যটি আমি লিখলাম বা বললাম তখনই প্রশ্নটি মাথায় আসবে, স্কুল বলতে তুমি কাকে বোঝো? প্রশ্ন যখন আছে, উত্তরও তো সবারই জানা! সত্যিই কি জানা? বেশ রহস্যময়তা! কিন্তু! ’স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ অভ্যাসবশত মাথার কাছে উষ্ণতায় ছিল গোটা কয়েকটা দিন। তারপর উঠলো বাই ট্যুরে যাই, যা আমি আর কি! মাথার কাছে উষ্ণতা ছাড়ার সময়ে সে ট্যুর সঙ্গী হয়ে গেল আমার। ট্যুরটা ছিল সম্ভবত ভেসে ভেসে সারাদিন আর রাত লঞ্চে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে আংটিহারা যাওয়া।

কেমন যেন বিষণ্ণ করে দিল এই তোমাকে’ বুঝতে গিয়ে! মানছি আমি একটু কবিতায় থাকি, একটু ভাসি, একটু বিষণ্ণ হই। নিজের হাত ছুঁয়ে নিজেই বসে থাকি। নিজের কফির উষ্ণতা নিজের ঠোঁটে টের পাই! তাই বলে স্কুল এক ঝটকায় আমায় নিজের স্কুলে পাঠাবে? এ বড় অন্যায়! এই অন্যায়টি করেছেন জাহানারা পারভীন। জাহানারা পারভীনকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করেছিল, ‘স্কুল বলতে তিনি কাকে বুঝিয়েছেন আসলে’ কিন্তু বোকা বোকা প্রশ্ন না করে সোজা বইয়ের পাতা খুলে উত্তর পাব ভেবেছিলাম। কিন্তু একি! কবি তার দীর্ঘ কবিতার মধ্য দিয়ে আমাকেই এই প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিলেন।

আমি আমার আমির সামনে আলগোছে বসে রইলাম। আলতো করে আমারই হাত ছুঁয়ে। স্কুল তো তাই বলে দিলো। একটি র্দীঘ কবিতা ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ এই তুমিটার সাথে কবি ছিলেন আপাদমস্তক! এই তুমিটা তো সেই যাকে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন, খুঁজি আমি আপনায়’ লালনের ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর সেথা পড়শী বসত করে’ অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে। আমি চোখ মেললুম আকাশে, জ্বলে উঠল আলো, পূবে-পশ্চিমে। গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর` আর গোলাপও সুন্দর হয়ে গেল।

স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে গেছে ওই সুন্দরের দিকে, আপনার দিকে, নিজেই নিজের পড়শীর কাছে। সমাজ, সময় সমকাল, জীবন, প্রেম, জীবনের এক মহাকাব্যিক উপস্থাপন ঘটেছে এই কাব্যে। কবির অতিবাহিত সময়ের আয়না তার স্কুল হয়ে উঠেছে, স্কুল তার প্রেম, তার সমাজ, তার জীবনের প্রতিটি ধাপ, যা আসলে প্রকান্তরে পাঠকের। আর যে বই বা কাব্য পাঠকের কথা বলে, তার হয়ে ওঠে তা কালোর্ত্তীণ। পাঁচ ফর্মার একটি কবিতা যখন এগুতে থাকে তার সাথে কবির প্রতিটি পথ চলা এগুতে থাকে তার চারপাশে দেখা সব দৃশ্য নিয়ে, তা একটি মহাকাব্যিক দ্যোতনা দেয়। তাই খানিক পড়ে, ভাবতে বসতে হয়, তাকিয়ে থাকতে হয় কেবল আসা শরতের আকাশের দিকে অথবা ফুলতলা নদীর বাঁকে। আনমনা করে দিয়ে চেনা শব্দগুলো আবার কানে ধরিয়ে স্কুলে ঢুকিয়ে দেয়, লঞ্চের এগিয়ে যাওয়া গতিতে তাই স্কুলের পথ চলা চলে আমার মতো পথ ভোলা এক পথিকের পথ দেখায়, হাঁটতে শেখায় আবার কবিতার পথে।

তিনি যখন বলে ওঠেন, ‘যদিও নদী, তবুও দাঁড়িয়েছি জলের বিপক্ষে…’নদী আমাকে অন্য নদী দেখিয়ে দেয়। আমি আরও অতলে তল খুঁজি। পেয়েও যাই–

আমিও পাথর কুড়াতে গিয়ে
অজস্র পাথরের মাঝে পড়ে আছি;
নদীপাড়ের নুড়িরা—পাহাড় থেকে
নেমে আসতে দেখেছে মা-পাথরের ক্রোধ’
পাথর প্রসব করা নদী
বুক থেকে শিকারিরা তুলে নেয় সন্তান,
প্রতিনিয়ত গর্ভে নেয় পাথরের ভ্রূণ…

পরিচিত দুঃখরা হাত ধরাধরি করে পিঁপড়ার সারির মতো লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে যায় বুকের গভীরে। হড্ডা, ফুলতলা, শিবসা নদী এক হয়ে হাঁটতে থাকে বুকের ভেতর। কবি যেন পরিকল্পনা করেই ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’কে মা-পাথরের ক্রোধে ছড়িয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর সকল নদীর মা হয়ে। এখানেই কবি সার্থক হয়েছেন।

‘তবু চিটেধানের ভেতর হারিয়ে গেল আদিগন্ত ফসলের জেদ।’ এই ঘোরলাগা চিত্রকল্পের ভেতর উপস্থিত হয়ে যায় আরও ঘোর। যেন ভোর নামতে অনেক দেরি আছে.. এমন সময় রাতকে অনায়াসে জানিয়ে দেন তার অভিমানের কথা– ‘খুব কি বেশি ছিল চাওয়া? জলপাই পাতার সমান ঘুম’। জলপাই পাতার সমান ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই- ‘প্রতিমার খড় দেখে ফেলেছি বলে জানালায় বসতে চায় না কোনো চড়ুই।’

আমি যে আজও মেলাতে পারিনি
মাঝরাতে সবার অগোচরে
ট্যাপকল থেকে পড়ে যাওয়া জলের হিসেব।

‘সেই বাঁশিটিকে ডেকে পাঠাব, ঠাণ্ডা ভাতের থালায় ডুবে যাওয়া চাঁদকে যে দেখিয়েছে ফুটো হয়ে যাওয়া বুকের ক্ষতচিহ্ন।’ বুকের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে দেয়, হিসাব মেলে না। আবার শুরু হয় যাত্রা। এই যাত্রায় দেখা হয় এক বনসাই জীবনের সাথে- ‘হাটের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো অশথ সাক্ষী, চোখের জলে কেনা সেসব মুহূর্ত এখনো আছে বেঁচে, হাঁড়িতে থাকা জিয়ল মাছের সাথে—ঘোলা জলের অপমানে।’

‘অশথের গ্রামে স্বীকার করে নেয়া বনসাই জীবন!’ অশথ, জল, বুড়ো, খড়, চড়ুই, অগোচর, প্রসব, নুড়ি এমন সব চেনা শব্দের ব্যঞ্জনা মনে করিয়ে দেয় আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশকে। পড়তে পড়তে ভাবি কবিতা তবে কি! চেনা শব্দ, আবেগ আর একটি ছবি মানে চিত্র। এই তিন মিলে একটি গল্প যখন বলি বা বলা হয় তবে কি কবিতা হয়! তাহলে তো হলোই! একটি দীর্ঘ কবিতা পড়া হলো, যা নিয়ে গেল চেনা শব্দ দিয়ে তৈরি করা ঘরে, যেখানে আবেগ আর চিত্রকল্পে ভরে উঠলো হৃদয়ের পরত! স্কুল বারবার মনে করিয়ে দিলো, ‘দেয়াল তুললে ঘর, ভেঙে ফেললেই পৃথিবী’। যেন নিজেকে টেনে হিঁচড়ে, খামচে, ঘামিয়ে, অস্থির করে স্থির দাঁড় করিয়ে দিলো সেই পৃথিবীর সামনে যা কেবল নিজের, একান্ত নিজের-

শঙ্খের সমান বয়সী এক শীতকালে
কিছু গ্রন্থের পোড়া পৃষ্ঠা হাতে
সেই যে দাঁড়িয়ে ছিলাম একা!

অথবা,

এই তবে তুমি?
সামান্য দেখায়, অদেখার সংকোচ!
ঠাণ্ডা ভাত তোলে কাঁচা মরিচের দাবি
আরও চাই এক চিমটি নুন
অসামান্য অসুখের মা, সামান্য মন
আমি, চন্দ্রাবতীর বোন!
এই তবে ধর্ম কৃষকের?
শস্যের চারা তুলে আগাছার পরিচর্যা!

অদেখার সংকোচ কাটতে না কাটতেই,

বহুযুগ আগে সূর্যমুখীর হলুদ সকালে সে নিচতে পারেনি শব্দের সংকেত।
তার পূর্বপুরুষেরা আলতামিরার গুহা থেকে নির্বাসনে এসেছে এশিয়ার
গ্রামে। গুহাচিত্রের ভাঁজে ভাঁজে রেখে আসা বেদুঈন নারীর পায়ের ছাপ
তারা বিক্রি করেছে উঠতি শহরে। জলপ্রপাতের জলের শক্তিকে বশ করা
মানুষ ঠেকাতে পারেনি ফলের পতন। পতন না বিচ্ছেদ বলি একে?

‘এসব গল্প ডানায় নিয়ে রানওয়ে থেকে উড়ে গেছে ব্যক্তিগত পানকৌড়ি’। ব্যক্তিগত পানকৌড়ি থেকে জলপ্রপাতের যে শব্দ চুঁইয়ে পড়ে আমাদের ইতিহাসের কুন্ডুলী পাকানো গুহায় তা কেবল ব্যক্তি নয় নিয়ে যায় সসীম থেকে এক অসীমলোকে। শব্দের সাথে কল্পনার বিবাহ পড়িয়ে পাঠককে নিয়ে যেতে চেয়েছেন লোক থেকে অন্যলোকে। তাইতো কখনও কখনও পাঠকের মধ্যমায় লেগে থাকে করুণার তিল, আবেশে জাহানারা বলে ওঠেন,

বুঝতে পারিনি ডাবের নরম শাঁসের মন। বাদামি পালের বাতাসে কতদূর
ভেসে যাবে কসম-কাটা নাও? সেই শালিকের বোন যে নামতা পড়তে
গিয়ে ভুলে যায় সংখ্যার হিসেব। তাকে বলো, জীবনের লসাগু না মেলা
মানুষেরা ইউরেনাসের ভাই। নেপচুনের বোন। বৃহষ্পতি কেউ হয় না
তাদের। খাতা থেকে কেটে দিও নাম যেন আমি কেউ নই, ছিলাম না
কোনোদিন। নিয়ে যেও মধ্যমায় লেগে থাকা করুণার তিল।

করুণার তিল মেখে এগিয়ে যাওয়া শিবসার কোল ঘেঁষে আমি তাই খুঁজি কথার পলি, খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই,

‘কথার পলিতে গুঁজে দিয়েছ বীজধান
আমি সেই ধান থেকে জন্ম নেয়া প্রথম চারা
চোখ খুলে দেখি বিরান কাৎলাহার বিল
পূর্বপুরুষের মুখ পড়ে মনে।

বীজধান মুখে করে ফিরে আসি ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’। এক অন্য আমি হয়ে। যে আমি তার স্কুল জানে, জানে কোন সমাজে, কোন সময়ে, কোন মহাকালে অবর্তীণ সে অথবা অন্য আমি। কবি জাহানারা পারভীন এই দীর্ঘ কবিতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছেন তার সময়কে, তার প্রবন্ধের আরও বই আছে তা গুরুত্বপূর্ণও বটে তবে ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ স্বয়ং জাহানারা পারভীনকে বুঝতে চেষ্টা করেছি যেমন আমি ‘আপনার’ চেয়ে ‘আপনা’কে বুঝতে চেষ্টা করেছি। তাই জীবন মধুরতম চিতার জল পান করে জাহানারা পারভীনের মতো বলতে থাকি:

জানি তুমি অন্তর্মুখী
হাসিমুখে পান করো চিতার জল

বই পরিচিতি
স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি
জাহানারা পারভীন
মূল্য: ২৫০ টাকা
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশ: নালন্দা, বইমেলা-২০১৫।

একুশে বইমেলা ২০১৮