আবদুর রাজ্জাক

আবদুর রাজ্জাক

আবদুর রাজ্জাকের জবানিতে জাতির বয়ান

নাহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০২১

বিগত শতকে পূর্ববাংলায় সংঘটিত প্রধান ঘটনাসমূহের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ববাংলার মানুষের জন্য একটি আধুনিক এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক জাতিসত্তার বিকাশের বীজ উপ্ত হয়েছিল। এই স্বাতন্ত্র‍্য ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের জীবনধারা-চিন্তাভাবনা-বিশ্বাস ও মূল্যচেতনা থেকেও আলাদা হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। ‘বাঙালি মুসলমান’ সচেতন সত্তাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নির্মাণ।

কিন্তু কি ছিল দেশভাগের পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বা মনোভাব? কারণ দেশভাগের আগে স্বার্থের দ্বন্দ্বটা পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে নয়, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দশ বছর পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্রের অনুপাত ছিল এক তৃতীয়াংশ। দেশভাগের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্র ছিল শতকরা ৫০ জন।

এসব ক্ষেত্রে আবদুর রাজ্জাকের মুখে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর মূল্যায়ন বেশ ভিন্ন হয়ে ধরা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য হয়েও এ কে ফজলুল হক প্রথম তিন বছরের মধ্যে কোনো সভায় উপস্থিত থাকেননি, এই চমকপ্রদ ব্যাপারটা আবদুর রাজ্জাকের জবানিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান প্রভাবকদের নিষ্ক্রিয় অবদানের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে। যুগের সাথে বেতালে চলার এই বিশ্লেষণ— ‘ইউনিভার্সিটিতে প্রথম ১২/১৪ বছরে কোনো মুসলমান কোনো ইস্যু টেকআপ করে নাই।... দ্যাট দি মুসলিমস হ্যাড এ প্রবলেম ইন ম্যাটারস অব এডুকেশন, দ্যাট ঢাকা ইউনিভার্সিটি ওয়াজ ডিজাইনড টু ডু সামথিং এ্যাবাউট ইট, সে ব্যাপারে মুসলমানদের তরফ থেকে কোন কনসার্টেড এ্যাকশন দেখা যায় না—’ আবদুর রাজ্জাকের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিকেই উদ্ভাসিত করে।

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জাকির হোসেনের সাথে একসাক্ষাতে অভিযোগ করে বলেন, দেশভাগের পূর্বে, দেশে যে হিন্দু-মুসলমানের একটা সমস্যা আছে, সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, ফলেই ৪৭ সালের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এই কথা আবদুর রাজ্জাক সেসময়ে তার অনেক সহকর্মীদেরকেও বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একই রকমভাবে দেশভাগের পরে, পাকিস্তানে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান নিয়েও একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে এবং সেই সমস্যা থেকেও, পূর্বের হিন্দু-মুসলমান সমস্যার ন্যায়, মুখ ফিরিয়ে রাখা হয়েছে, যার ফলে ভবিষ্যতে ৪৭ এর মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছে বলেও গভর্নরকে হুঁশিয়ার করেন আবদুর রাজ্জাক। বাঙালি মুসলমান জাতিসত্তার স্বতন্ত্র উন্মেষের এই হচ্ছে গোড়ার কথা।

বোঝা যাচ্ছে, অধ্যাপক রাজ্জাক দেশভাগ সমর্থন করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজও। কিন্তু পাকিস্তান যে টিকবে না, পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানিত্ব দিয়ে যে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের চলবে না, সেটাও তিনি বুঝেছিলেন এবং সেই বোঝাপড়াকে বাংলাদেশের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুসলমানদের অধিকারের সমস্যাটাকে দেশভাগের পূর্বে ‘সমস্যা’ বলে বিবেচনায় নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি শাসকশ্রেণি। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাটাকেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা ‘সমস্যা’ বলে মনে করেনি। সেকারণেই ১৯৭১ এসেছে। আবদুর রাজ্জাকের আশংকা দশ বছরের মধ্যে ফলে গেছে। দেশভাগের অবহেলিত মুসলমান সত্তা আর মুক্তিযুদ্ধের অবহেলিত বাঙালি সত্তার সমন্বয়ে বাঙালি মুসলমান জাতিসত্তার বিকাশ। একজন বুদ্ধিজীবীর দূরদর্শিতা এমনই।

গভর্নরের সাথে রাজ্জাকের আলাপটা খুবই সাহসী, তিনি গভর্নরকে বলছেন, Partition was not inevitable except for the refusal to admit the problem by the Congress or the majority of the Hindus to face facts. এরপরেই তিনি ৪৭ পরবর্তী সময়ের সাথে এই প্রবণতার সাদৃশ্য টেনে বলছেন, 1947 এর পরে আমরা কিছু মানুষ বুঝাবার চেষ্টা করছি যে, there is a problem in the country confronting East Pakistan and West Pakistan. কথাটা উল্লেখ করলেই we are told we are the tools of India or some such third party-almost exact prototype of the argument we used to hear in the older days before `47. And because of this attitude, most probably in the near future, we shall again be confronted with the same situation with which we were confronted in 1947.

মনে রাখা দরকার, ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল ১৯১২ সালে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে দশ বছর পরে ১৯২১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ অঞ্চলের মুসলমানরা শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে আসার সুযোগ পায়। অন্যান্য কারণের সাথে সাথে পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিপ্লব, ওয়াহাবি আন্দোলন ইত্যাদি ঘটনায় বংলার অগ্রসর ভূমিকার কারণেও এ অঞ্চলের মুসলমানদের সাথে ব্রিটিশদের একটা বিচ্ছেদ ও দূরত্ব গড়ে উঠেছিল। ঘটনাগুলোকে বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, এ অঞ্চলের মুসলমানরা শুরু থেকেই ব্রিটিশদের শাসন-শোষণকে প্রত্যাখ্যান করেছে। একারণেই মুসলমানরা শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাভাবনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে থেকেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সামনে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বিকাশের সুযোগ করে দেয়। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এই বিকাশ ধারার অন্যতম শিক্ষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন ১৯৩১ সালে, শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৩৬ সালে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক হন। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ— সবই দেখেছেন তিনি। সবক্ষেত্রেই রেখেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান।

আবদুর রাজ্জাকের বিশ্লেষণ এবং ক্ষুরধার বাচনভঙ্গি থেকেই তার পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাপ্রবাহের তীক্ষ্ণতা বোঝা যায়। ভার্নাকুলার বা নিজ ভাষায় রচনার বিষয়টিকে তিনি উনিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান মনে করতেন। এইসময়েই এ উপমহাদেশে মাতৃভাষা চর্চার জোয়ার আসে। এমনকি রামমোহন রায়ের প্রকৃত কাজ বলতে তিনি বাংলা ভাষায় তার রচনাসমূহের উল্লেখ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পূর্বাপর মান নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকের শিক্ষকদের জ্ঞানচর্চা ও সেন্স অব রেসপন্সিবিলিটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। অধ্যাপক নগেন ঘোষ, নরেশ সেন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ শিক্ষকদের নির্লোভ ও বৈষয়িক আকাঙ্ক্ষা বিবর্জিত জীবনযাপন শিক্ষার্থীদের মনোজগতে যে ব্যাপক আদর্শিক প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছে, সেকথা স্মরণ করে পরবর্তী যুগে সেই inpact এর অনুপস্থিতিবোধে ব্যথিত হয়েছেন আবদুর রাজ্জাক।

৫২ সালের ফায়ারিংয়ে যখন ছাত্র মারা গেল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি থেকে ছাত্র ‘হত্যা’র প্রতিবাদে নিন্দা প্রস্তাব দেয়ার প্রস্তাব করেন আবদুর রাজ্জাক। সেসময়ে শিক্ষক সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলেন ড. শহীদুল্লাহ। তিনি ‘মার্ডার’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি করে সভায় এলেন না। সভা চলাকালীন সময়ে ড. জুবেরী এসেও একই আপত্তি জানালেন। তার পরিবর্তে প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ডেথ’ শব্দটা প্রয়োগের পরামর্শ দিলেন একজন। ক্ষমতার সামনে এহেন ভীতিপ্রবণতার প্রেক্ষিতে আবদুর রাজ্জাকের ছোট্ট প্রতিউত্তরটি ধারালো ছুরির মতো। তিনি বললেন, ‘সিন্স হোয়েন মার্ডার এ্যান্ড ডেথ হাভ বিকাম সিনোনিমাস?’ এরপরে আর কেউ মার্ডার নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা আজ গর্ব করি। কিন্ত ভেবে দেখুন, এমনই ছিল অথবা থাকে ক্ষমতার সামনে নতজানু বুদ্ধিবৃত্তিক মাথা। শুধু তাই-ই নয়। আবদুর রাজ্জাক দাবি করেছেন, বায়ান্নর ফায়ারিং এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো যদি আগেভাগেই শিক্ষকরা ছাত্রদের কাতারে শামিল হতো।

আবার বায়ান্নর পরে যখন মুনীর চৌধুরী এবং মুজাফফর চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হরলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। আবদুর রাজ্জাক প্রশাসনকে বোঝাতে চাইলেন যে, সরকার যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষকদের গ্রেফতারের ব্যাপারে অফিসিয়ালি কিছু জানায়নি, তাই সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রশাসন অন্তত তাদের মায়নাটা যেন বন্ধ না করে। কিন্ত এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের মিটিংয়ের পরে দেখা গেল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। অধ্যাপক রাজ্জাক বেতনের বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘সেদিন ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে এটা করতে পারলে আমার মনে হয়, একজন শিক্ষকের এধরনের পার্টিসিপেশন ইন পাবলিক লাইফ উড হ্যাভ এ্যাপিয়ার্ড লেস ফিয়ারসাম দ্যান ইট টার্নড আউট টু বি।’ তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় বলতে শুধু শিক্ষক, শিক্ষার্থী বোঝায় না, প্রাতিষ্ঠানিক সত্তাটিরও কিছু রোল প্লে করার থাকে।  

বেতন বৈষম্যের ব্যাপারটাও আবদুর রাজ্জাকের আলাপে উঠে এসেছে। ১৯২০-২১ সালে একজন অধ্যাপকের বেতন ছিল এক হাজার টাকা, সেখানে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বেতন ছিল ৮ টাকা। এই বেতন ২০/২৫ বছরে অপরিবর্তিত ছিল। আবদুর রাজ্জাক বলছেন, ২০/২৫ বছর ধরে চোখে না পড়েই একটা শ্রেণির অবহেলিত রয়ে যাওয়াটা বিস্ময়কর ব্যাপার।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের তরফ থেকে উপদেষ্টাদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক ছিলেন। ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক পার্টির প্রভাবশালী নেতা মোহন মিয়া তাকে এই কমিটিতে এনেছিলেন। এই কমিটিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তিনি, তার কথা থেকে পূর্ব বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসিয়ালদের মানসিক হীনমন্যতার সত্যটি প্রকটিত হয়। ঘরোয়া আলাপে আবদুর রাজ্জাক মোহন মিয়াকে পাকিস্তানের সামনে একটা কথা বলার পরামর্শ দিলেন, প্রাদেশিক সরকারের কাছে প্রদেশ অনুযায়ী আর্মি রিক্র‍্যুট করার ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানাতে হবে। কিন্ত পরিষদের মিটিঙের শেষে আবদুর রাজ্জাক দেখলেন, পরিষদের সামনে এই প্রস্তাব দেয়নি তারা। এরকমভাবে কয়েক দফা মিটিং শেষে অধ্যাপক রাজ্জাক দেখলেন, পরামর্শকের পরামর্শ অনুযায়ী কেউ কথা বলেনি। এরপর একদিন দেখলেন, পূর্ব বাংলার তরফের একজন এসেম্বলি মেম্বার পশ্চিম পাকিস্তানের এক এসেম্বলি মেম্বারকে রীতিমত স্যার সম্বোধন করে তোষামদ করছে। এই ঘটনায় আবদুর রাজ্জাক তাকে ডেকে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এভাবে, সেও এসেম্বলি মেম্বার, আপনিও এসেম্বলি মেম্বার। আর আপনি তার লগে এইভাবে কথা কইবার লাগছেন। আপনাদের Advise দিতে আসে কোন পাগল!

১৯৭৬ সালে সরদার ফজলুল করিমের সাথে এইসকল আলাপ আলোচনা করেছেন অধ্যাপক রাজ্জাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, এ অঞ্চলে এই প্রতিষ্ঠার প্রভাব, মুসলমান সমাজের শিক্ষার সাংস্কৃতিক নির্মাণ, দেশভাগ, ভাষাভিত্তিক সত্তার উন্মেষ, আন্দোলন সংগ্রাম ও তার ধরন, ক্ষমতা, স্বাধিকার, বৈষম্য ইত্যাকার নানা দিক নানা মাত্রায় এই আলাপচারিতায় উঠে এসেছে। এই আলাপচারিতার প্রকৃতি তত্ত্বীয় নয়, বরং যেকোনো বিষয় নিয়ে কথাবার্তা নানা মাত্রায় ও ভঙ্গিমায়, নানা ঘটনায়, নানা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের উদাহরণ অবলম্বন করে এগিয়ে গিয়েছে। একারণে আবদুর রাজ্জাকের মুখনিঃসৃত কথা জ্ঞানী লোকের গুরুগম্ভীর বাক্যস্রোতের মতো নয়, তা চূড়ান্ত তীক্ষ্ণতাসহকারে সাধারণ মনের সাথে যোগাযোগমূলক ও হৃদয়গ্রাহী। অকপটে যে কোনো ঘটনা বা ব্যক্তি বা ধারাকে ক্ষুরধার যুক্তির মাধ্যমে বিচার করার অতুলনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার পদের একজন শিক্ষক। তিনি পদোন্নতির জন্য আবেদন করেননি। আক্ষরিক অর্থেই রিডার হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন। বিপুল বইয়ের সংগ্রহ, বিপুল পড়াশুনার বিস্তার। সারাজীবনে বলতে গেলে লেখেননি কিছুই, ক্লাসে বক্তৃতায় ছিলেন খুবই অপটু। তবু তার সংস্পর্শে যে-ই এসেছেন, স্বীকার করেছেন, সে-ই আলোকিত হয়েছেন।

জীবনব্যাপী কিছুই না লিখে, আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা না করে, শুধু কথোপকথনের মাধ্যমে পুরো একটা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে এমন দীর্ঘ ছায়া বিস্তার করা বিস্ময়কর। সরদার ফজলুল করিমের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ; অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’ বইটি এই মহান শিক্ষকের জবানিতে আমাদের জাতির কাহিনি বয়ান করে গিয়েছে। এই বিস্ময়কর পুরুষ সম্পর্কে আমরা ভালোভাবে ওয়াকিবহাল নই। হলে বিশ্বাস করা যায়, আমাদের পথচলা শ্রেয়তর হয়ে উঠবে।

 

লেখক: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

একুশে বইমেলা ২০১৮