আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘সুখের সামান্য নিচে’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৪

কারেন্ট নেই।
বিছনার ওপর পা মুড়ে চুপচাপ বসে আছে শ্রীলা। এই ঘরে একটা মাত্র জানলা। সন্ধের পর পরই বন্ধ করে দেয়া হয়। কারেন্ট চলে যেতে সেটা খুলে দিয়েছে সে। বাইরের হাওয়ায় ঘরের ভেতরকার গুমোট ভাবটা কাটেনি তবুও। খোলা জানলার গায়ে এসে পড়েছে চাঁদের ফিকে আলো। কিছুটা ঘরের ভেতর, মেঝেতে।

ঘুম আসছে না তার। রাত কত হয়েছে কে জানে। বারান্দায় পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। হাতপাখা হাতে অনেকক্ষণ ধরে আমজাদ সাহেব বারান্দায়। গরমে বেচারা ঘুমোতে যেতে পারছেন না। কী যে হয় থেকে থেকে। কারেন্ট একবার গেলে কখন আসে, হিসেব করে বের করা মুশকিল।

শ্রীলা শুনতে পেল, বারান্দা থেকে গুনগুন করে গানের সুর ভেসে আসছে। চাচা গান গাইছেন। নজরুলের একটা গানই তিনি ঘুরেফিরে প্রায়ই গান। তারপরও শুনতে খুব একটা খারাপ শোনায় না। খুব নিচু স্বরে শোনা যাচ্ছে, খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে।

কিছুক্ষণ চুপ করে শুনল শ্রীলা। থেকে থেকে মানুষটার জন্যে ভীষণ মায়া হয়। খুব তাড়াতাড়ি কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছেন। পঞ্চাশের কিছু ওপরে বয়েস। সামান্য একটা চাকরিতে জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছেন।

সামনের রাস্তায় একটা কুকুর ডেকে উঠলো। শ্রীলা এসে দাঁড়াল বারান্দায়। তাকে দেখে আমজাদ সাহেব গান থামিয়ে দিলেন।
কি রে ঘুম আসছে না?
তুমি ঘুমোতে যাবে না? রাত তো মনে হয় অনেক হয়েছে।
আয়, বোস।
বারান্দায় একটা চেয়ার ছিল। আরেকটা আনতে হলো ভেতর থেকে। চেয়ার এনে শ্রীলা বসলো চাচার পাশে।
আসমানি ঘুমিয়েছে?
হুঁ।
তুই?
হাসল শ্রীলা চাচার দিকে চেয়ে। দেখল, চাচাও চেয়ে আছেন তার দিকে। একটু যেন হাসছেন। কী রকম হাসি হাসি মুখ।
চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব।
ইচ্ছে করলে খেতে হবে। ইচ্ছের তো কোনও বিকল্প নেই চাচা।
তা ঠিক। খাওয়াবি এককাপ?

শ্রীলা উঠল। আমজাদ সাহেব বললেন, দু’কাপ করে আনিস। দুজনে মিলে খেতে খেতে গল্প করা যাবে।
হাতড়ে হাতড়ে রান্নাঘরে এলো শ্রীলা।

আজ শ্রীলাকে দেখতে আসবে।
সকাল বেলায় আমজাদ সাহেব ঢুকেছিলেন বাথরুমে। সেখানে এক বিপত্তি বাঁধিয়ে বসলেন তিনি। কাল সারা রাত কারেন্ট ছিল না। এ রকম আজকাল প্রায়ই যাচ্ছে। সারা রাত কারো চোখের পাতা এক হলো না। কী যে অস্বস্তি। বিছনায় শুয়ে খালি এপাশ-ওপাশ করতে হয়েছে। আর সেই সঙ্গে হাঁ-হুতাশ। দীর্ঘশ্বাস পড়েছে ঘন ঘন। থেকে থেকে বিছনা ছেড়ে ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না। বারান্দায় যাওয়ার বুকের পাটা হয় না কারো।

এ বাড়িতে হাতপাখা মোটে দুটো। একটা রেহানা বেগমের আর অন্যটা আমজাদ সাহেব হাতে করে সারা রাত ধরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেছেন। তার ভয়ে বারান্দায় যাওয়ার সাহস হয় না কারো। কেউ গেলে ধমকে উঠেছেন তিনি।

পায়ে পায়ে এক সময় শ্রীলা এসে দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়াতেই চোখে চোখ পড়লো আমজাদ সাহেবের সঙ্গে। গম্ভীর গলায় জিগেশ করলেন, কি চাই?
মিইয়ে গেল শ্রীলা। নিচের দিকে চেয়ে বললো, ঘরের ভেতর প্রচণ্ড গরম। ঘুম আসছে না।
নবাবজাদির কথা শোনো। বিশ্ব সংসারে আর কারো যেন গরম লাগছে না। উনি একাই সিদ্ধ হচ্ছেন। যত্ত সব ফাজলামি। এত রাতে কেউ বারান্দায় আসে। যাও, ঘরে যাও। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। ঘুম অবশ্যই আসবে। ঘুম তো আর দুর্লভ কোনও বস্তু নয়। জোরে জোরে হাতপাখা চালাতে চালাতে পায়চারি করতে আরম্ভ করলেন তিনি।

চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু এই মুহূর্তে কান্নাকাটি করা ঠিক হবে না। এখন কেঁদে ফেলা মানে হচ্ছে আরও বিপদ ডেকে আনা। তিনি হয়তো চিৎকার করে বলবেন, আহ কী যন্ত্রণা। কান্নাকাটি কেন? কাঁদার মতো কিছু বলেছি আমি? শুধু শুধু চোখের পানি ফেলে কী যে আনন্দ এদের!

তো মৃত্যুর আগেই হাবিয়া দোজখ দ্যাখা হয়ে যায় সকলের। এ রকম ভ্যাপসা গরম পর পর দুদিন পড়লেই আর দেখতে হবে না। রোস্ট হয়ে যেতে হবে।

এ বাড়িতে থাকবার ঘর মোটে তিনটে। একটাতে আমজাদ সাহেব আর মনিরা। অন্যটায় শ্রীলা আর আসমানি। আর কোণের দিকটার ঘরটা সংসারের নানা রকমের জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা। ঘরের ভেতর কিছুক্ষণ পায়চারি করে শ্রীলা ফের বিছনায় এসে বসলো। জানলাটা খাটের উলটো দিকে হওয়ায় বিছনায় হাওয়া পাওয়া যাচ্ছে না। খাটের কোণার দিকে দেয়াল ঘেঁষে ঘুমোচ্ছে আসমানি। অদ্ভুত ঘুম ওর। ঘুমোনোর কিছুক্ষণ পর থেকেই ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলে নাক ডাকতে আরম্ভ করে। এখনও ডাকছে। মনে হচ্ছে সাপের মতো গজরাচ্ছে। বিশ্ব সংসার উলটে গেলেও ওর ঘুম এতটুকু চটবে না। মোটা একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঠিকই পড়ে থাকবে গণ্ডারের মতো। এ এক যন্ত্রণা। হাজার গরমেও কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোনো চায় ওর। টেনে ফেলতে গেলেও সাত রাজার ধনের মতো আঁকড়ে পড়ে থাকবে। শরীর ভেসে যায় ঘামে। উৎকট একটা ঘেমো গন্ধ ছাড়ে। এসবে একটুও অসুবিধে হয় না ওর। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে দেখা যায় সে এক দৃশ্য। গায়ের জামা-পাজামা ভিজে জবজবে। কিছু বললে দাঁত বের করে খিক খিক করে হাসে। যেন এ রকম মজার কথা জীবনে শোনেনি।

কাঁথাটা সরাতে গিয়েও পারল না শ্রীলা। দু’একবার গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলে কাঁথা আঁকড়ে ধরে পড়ে রইলো ঠিকই। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পড়লো শ্রীলা। কিন্তু ঘুম এলো না। জামার নিচে সারা শরীর ভেসে যাচ্ছে ঘামে। স্রোত বয়ে যাচ্ছে পিঠের নিচ দিয়ে। ব্রার ভেতর কামড়াচ্ছে কুটকুট করে। অসহ্য! পাশ ফিরে দেখে নিল, ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলে মরার মতো ঘুমোচ্ছে আসমানি। উঠে গিয়ে একবার দেখে এলো ছিটকিনি লাগানো হয়েছে কী না ঠিক মতো। তারপর এক গেলাশ পানি খেয়ে খাটে উঠে বসলো। এক ঝটকায় খুলে ফেলল গায়ের জামা। ব্রাও রাখল না শরীরে। জামার নিচে ব্রাটা লুকিয়ে মাথার কাছে শিথানে রেখে শুয়ে পড়ল। একটু কেমন যেন লাগতে লাগল। আসানি হঠাৎ যদি ঘুম থেকে জেগে ওঠে। সে সম্ভাবনা অবশ্যি খুবই ক্ষীণ। সকাল ছাড়া ওর ঘুম কোনও দিন ভাঙে না।

কাল রাতের গরমে সকাল বেলাতেই তিক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছেন আমজাদ সাহেব। সকাল সাতটার দিকে কারেন্ট এলে ফ্যান ছেড়ে খালি গায়ে বসে রইলেন বিছনায়। এই ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর হইচই বাঁধিয়ে দিলেন। এই শ্রীলা, তোর চাচিকে বল, বাথরুমে পানি তুলে দিতে। গোছল করবো। কী অবস্থা দেশের। এইভাবে চলতে থাকলে তো গোটা দেশটাই একদিন কাবাব হয়ে যাবে।

শ্রীলা খুব ইচ্ছে হয় জিগেশ করে, কিসের কাবাব চাচা, ছাগলের না গরুর। কিন্তু জিগেশ করতে সাহস হয় না।
বারান্দায় খোলা বাতাসে সারা রাত ধরে হাতপাখা চালিয়েও সকালে উঠে যদি তিনি কাবাব হওয়া নিয়ে হইচই করেন তাহলে তাদের কি নিয়ে হইচই করা উচিৎ ঠিক বুঝতে পারল না শ্রীলা। ভাবতে ভাবতে নিজেই পানি তুলে দিল বাথরুমে।

বাথরুমে ঢুকে তিনমগ পানি গায়ে ঢালার পর পরই মেজাজ খিঁচিয়ে উঠলো আমজাদ সাহেবের। বাথরুমে সাবান নেই। এখন এই ভেজা শরীরে বেরনো কী যে অস্বস্তিকর ব্যাপার। আবার সাবান না হলেও স্বস্তি নেই। সারা শরীর দিয়ে বিশ্রি একটা ঘেমো গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালি পানিতে যাবে না। বরং আরও চিটচিটে হবে। সাবান ঘঁষে হেভি একটা গোছল দিলেই ফ্রেশ। দরজা খুলে মাথা বের করে ডাকলেন তিনি, শ্রীলা, এই শ্রীলা?
মনিরা বেগম এসে বললেন, কি হলো, চ্যাচাচ্ছ কেন?
সাবান দিয়ে যাও একটা।
বাথরুমে সাবান নেই?
বাথরুমে সাবান থাকলে এই ভেজা শরীরে বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কোন গাধা?
ঠিকাছে, এনে দিচ্ছি। ঘরে একটা থাকতে পারে।
রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে তিনি ডাক দিলেন, শ্রীলা, এই শ্রীলা।
নিজের ঘর থেকে উত্তর নিল শ্রীলা, বলো।
মিটসেফের নিচের তাকে দ্যাখ একটা সাবান আছে, তোর চাচাকে এনে দে।

সাবান দিয়ে এসে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে খাটের ওপর বসে রইলো শ্রীলা। চাচা বের হলে সে ঢুকবে। চাচার মেজাজ-মর্জির অবস্থা আজকে ঠিক বুঝতে পারছে না সে। কিছুক্ষণ পর পরই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে হই চই বাঁধিয়ে দিচ্ছেন। ছুটি নিয়েছেন আজ। ছুটির দিনগুলোয় সারাক্ষণ বাড়িতেই বসে কাটিয়ে দেন চুপচাপ। সকাল দশটার দিকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বের হন। ফেরার পথে একটা খবরের কাগজ কিনে আনেন। সেটায় মুখ গুঁজে কাটিয়ে দেন সারাটা দিন। গোবেচারা টাইপের একজন মানুষ। একটা ব্যাপার ভাবতেই হাসি পেল শ্রীলার। কার কাছ থেকে যেন শুনেছিল, কেরানি গোছের মানুষগুলো অফিসে বড় সাহেবদের কাছে প্রায়ই সময় নাকাল হয়। অফিসের সেই জ্বালা মেটাতে তারা বাড়ির মানুষদের ওপর চোটপাট করেন। কেননা বাড়ির মানুষগুলো তার ওপর দিয়ে কথা বলার অধিকার রাখে না। বেশ একটা নিয়মতান্ত্রিক ব্যাপার।

শ্রীলার মনে হলো, তার চাচা আমজাদ হোসেনও এ দলের একজন। আসলে এ মানুষটার ক্ষমতা খুবই সামান্য। পরিচিত ছকের বাইরে বের হওয়া তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অন্তত মাসের শেষ দিনটিতে অফিস তাকে যা দেয় তার নিরিখে। শ্রীলার ধারণা এইসব অক্ষমতা ঢাকতেই চাচা তার রাগি রাগি স্বভাবের সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখেন। বাইরে একজন মানুষ যাই হোক না কেন, হোক সে রিকশাঅলা, ঘরে ফিরে এলেই সেই মানুষটার অবস্থান বদলে যায়। একাধারে সে যেমন স্বামী, পিতা তেমনই একটি পরিবারের প্রধান। বাড়ির ভেতর তারই অধিকার সব জায়গায়। পরিবারের সবার ওপর খবরদারি করতে একজন প্রধানমন্ত্রীর চাইতে তার ভূমিকা কম যায় না। এ সব কথা চাচাকে বললে তার মুখের অবস্থা কি রকম হবে এই মুহূর্তে সেটা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শ্রীলা। ভীষণ চটে যাবেন, সন্দেহ নেই। সিংহ গর্জন করে উঠবেন, মেয়ে বুদ্ধিজীবী হচ্ছে। তা লিখে ফ্যালো না গোটা খানেক বই। লোকে দেখবে আমরা কৃতি পরিবার।

হেসে ফেলল শ্রীলা। তবে আর যাই হোক, চাচার কাছে সে কৃতঙ্গ। আজীবন  ঋণী থাকবে সে এই সুন্দর মনের মানুষটার কাছে। এই মানুষটায় তার জীবনটাকে ঘিরে রেখেছেন পিতৃস্নেহ দিয়ে।

খেতে বসে স্ত্রীকে বললেন, কি কি আনবো লিস্ট করে ফ্যালো। বারোটার আগেই চলে আসবে ওরা।
এর আগেও তো দেখে গেছে কতজন। লাভ কি বলো ?
লাভ অলাভের কথা না মনিরা। বড় ভাই নাই, দায়িত্ব তো এখন আমার, তাই না?
আমি সে কথা বলছি না।
বুঝেছি আমি। দ্যাখা যাক। আমার কিন্তু ছেলেটাকে দেখে খুবই পছন্দ হয়ে গেছে। বিয়েটা হলে সুখী হবে আমাদের শ্রীলা।
খেয়ে নাও, বাজারে যেতে হবে তাড়াতাড়ি।

খেতে খেতে ভাবতে লাগলেন তিনি। মেয়েটাকে আজ দেখতে আসবে। এখন কথা হচ্ছে মেয়ে ওদের পছন্দ হবে কী না। এর আগেও সম্বন্ধ এসেছিল। সব কিছুই তাদের মোটামুটি পছন্দ হয় কিন্তু বাগড়া সাধে মেয়ের রং নিয়ে। কালো মেয়ে তারা বিয়ে করতে নারাজ। শেষ যে সম্বন্ধটা এসেছিল, তখন তো তার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল প্রায়। ব্যাটারা যেন খোলা বাজারে আলু-পটলের দর করতে এসেছে। কেমন ত্যাড়াব্যাঁকা সব কথা ঝাড়তে লাগল।

ছেলে আর ছেলের এক দুলাভাই এসেছিলেন মেয়ে দেখতে। সাধ্যমতো আয়োজন করলেন তিনি। খাওয়া পর্ব শেষ করে মেয়ে দেখেটেখে কোনও রকমের ভনিতা ছাড়াই চাঁড়ালের দুলাভাই বললেন, পাঁচ লাখ টাকা নগতের ওপর দিবেন। আর একটা মোটর সাইকেল। দিনক্ষণ ঠিক করেন। মেয়ে আমরা নিব।

রাগে সারা শরীর জ্বলে গেল আমজাদ সাহেবের। গাধাটা কি বলছে এসব? গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, মেয়ে আমি বিয়ে দেব না।
বিয়ে দেবেন না?
না। দেব না।
তাহলে আমাদের আসতে বললেন কেন ? এটা কিন্তু আমাদের অপমান করা হলো।
হলো না কী!
হয়নি?
জ্বী না। হয়নি। কারণ আপনাদের মানসিকতা এর আগে আমি জানতে পারিনি। এইমাত্র জানলাম।

উঠলেন ছেলে আর ছেলের দ্লুাভাই। যাবার আগে দুলাভাই বললেন, এর কমে মেয়ে কিন্তু গছাতে পারবেন। গছাতে যদি চান এক কাজ করেন, বাংলাদেশে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার ছেলে ঘুরে বেরাচ্ছে। বেশি ঝামেলায় না গিয়ে ওদের কাউকে ধরে এনে বিয়ে পড়িয়ে দেন। কোনও টাকা-পয়সা লাগবে না। মেয়ে পেলেই ওরা খুশি। স্বানন্দে রাজি হয়ে যাবে।

আমজাদ সাহেবের ইচ্ছে হচ্ছিল, হারামজাদাটাকে জুতো পেটা করে রাস্তায় নামিয়ে দেন। কিন্তু এতটা অভদ্র তিনি হলেন না। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, আপনার উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ। সে রকম কাউকে পেলে অবশ্যই চেষ্টা করবো। কিন্তু আপনাদের কাছে মেয়ে দেব না।

সেই দিনের পর থেকে জেদের বশেই হোক আর অন্য কারণে হোক তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শ্রীলাকে বিয়ে দেবেন না। আবার কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবেন। পড়াশুনা করাবেন। নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে শিখুক সে। যে টাকা তিনি যৌতুক দিতেন সেই টাকা দিয়েই না হয় পড়ালেন মেয়েটাকে। যৌতুক দিতে গেলে টাকাগুলো এককালীন লাগত, আর এখন আস্তে ধীরে লাগবে। এতে তেমন গায়েও লাগবে না। মেয়েটাও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা সুযোগ পাবে।

এরপর থেকে বলতে গেলে পাত্র খোঁজ-খবর করা বন্ধই করে দিলেন তিনি। কিন্তু গত সপ্তাহে সিদ্ধান্তটা বদলাতে হলো। ভাবাবেগ দিয়ে তো আর জীবন চলতে পারে না। শত হলেও একজন নিম্ন-মধ্যবিত্তের পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু চিন্তা করা সাজে না। আইবুড়ো মেয়ে ঘরে রাখলেও হাঙ্গামা। বড় ভাইয়ের কাছে জবাব দেবারও কোনও যুক্তি তিনি পাবেন না।

অফিসে নিজের টেবিলে বসে লাঞ্চ করছিলেন তিনি। এমন সময় টাইপিস্ট শামসুল হুদা সাহেব এগিয়ে এলেন হাসি হাসি মুখে। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, কি ভাই, কি লাঞ্চ আজ?

একটু লজ্জা পেয়ে যান তিনি। এভাবে কেউ বাগড়া দেয় খাবার সময়? ব্যাটা রামছাগল। খিঁচুরি খাচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে কালোজিরে বাটা। সকাল বেলা আজ বাড়িতে রান্না করা হয়েছিল। অন্যদিন রুটি আর সবজি থাকে। গতকালই আটা ফুরিয়ে গেছে। বাজারে এখন চালের চেয়ে আটার দাম বেশি। সকার বেলায় রুটি খাওয়া এখন বিলাসিতা। যে কারণে আজ শুকনো খিঁচুরি। এই শুকনো খিঁচুরি তো আর ভদ্রলোককে খেতে বলা যায় না। দেখেশুনে মনে হচ্ছে উনি লাঞ্চ করেই চলে এসেছেন ভ্যাদরা প্যাঁচাল পারতে। বেশ কায়দা করে পান চিবোচ্ছেন।

একটু হাসলেন আমজাদ সাহেব। বললেন, এই আর কি। গরিবের আর খাওয়া।
মাথা ঝাঁকালেন তিনিও। যা বলেছেন, আমাদের আবার খাওয়া। যে হারে চাল-ডালের দাম বাড়ছে তাতে করে তো বেঁচে থাকায় মুশকিল হয়ে পড়েছে দিন দিন। যাই বলুন, আমাদের ব্যবসায়ী ভায়েরা কিন্তু আছে মোচেই। ওদের তো আমাদের মতো আর ধরাবাঁধা মাইনে না। সুযোগ বুঝে জিনিসপাতির দাম বাড়িয়ে দিলেই হলো। যত ঠ্যালা চাকুরেঅলারা সামলাক।

কিছুক্ষণের ভেতর খাওয়া শেষ করলেন আমজাদ সাহেব। বাটি ধুয়েমুছে ভরে রাখলেন টিফিন ক্যারিয়ারে। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন আয়েশ করে। শামসুল সাহেবকেও দিলেন একটা। সিগারেটের পেছনে প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিনের একটা অভ্যেস। ছাড়তেও পারছেন না।

একগাল ধোঁয়া উড়িয়ে জিগেশ করলেন শামসুল সাহেব, তা ভাই আপনার সেই ভাতিজির খবর কি? বিয়েশাদির কোনও ব্যবস্থা হলো?
হলো আর কোথায় বলুন। চেষ্টা তদবির তো করছি।
আমার হাতে একটা ছেলে আছে, দেখবেন না কি?
ও আচ্ছা, এতক্ষণে বোঝা গেল আসল ব্যাপারটা। এই লাঞ্চ আওয়ারে উনি এসেছেন ঘটকালি করতে। ঘটকালির মজা বুঝতে শুরু করেছেন নাকি ভদ্রলোক? কথা বললেন না আমজাদ সাহেব। চুপচাপ বসে রইলেন কিছুক্ষণ।

কি ভাই, দেখবেন নাকি?
দেখতে তো আর বাধা নাই। কিন্তু আপনি তো ভাই জানেন আমার অবস্থা। সামান্য চাকরি করি। দাবি-দাওয়ার বিষয়টা আমার পক্ষে তো...
আরে না না, এসব ব্যাপারে আপনি ভাববেন না। ওদের কোনও দাবি-দাওয়া নেই। মেয়ে পছন্দ হলেই ওরা এগোবে।
ছেলেটা কে? আপনার কিছু হয়?
ছেলেটা হচ্ছে আমার ছোট ভাইরা ভাইয়ের ভাগ্নে। মা-বাপ নাই। ছেলেবেলা কেটেছে এতিমখানায়। সেখান থেকে এনে আমার ভাইরা ভাই লেখাপড়া শিখিয়েছে। এম,এ পাশ করে কিছুদিন হলো একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি জুটিয়েছে। মাইনে আপাতত চলার মতো পাচ্ছে, সামনে বাড়বে। বড় কথা হচ্ছে ঝাড়া হাতপা। বিয়ের পর আলাদা সংসার পাতবে। খুবই ভালো ছেলে ভাই। গোবেচারা টাইপের। দেখবেন?
গম্ভীর মুখে আমজাদ সাহেব বললেন, চলুন তাহলে একদিন। কথাবার্তা বলা যাক।

মাঝখানে একদিন অফিসের পর গিয়েছিলেন ছেলেকে দেখতে। দেখে এসেছেন। তার পছন্দ হয়েছে। এখন আর যারা আছে তাদের পছন্দের ব্যাপার। আজ আসবে ছেলে, ছেলের মামা মানে শামসুল সাহেবের ভাইরা ভাই আর শামসুল সাহেব। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায়।

চা নিয়ে এলো শ্রীলা।
চায়ে চুমুক দিয়ে আমজাদ সাহেব বললে, বোস। ওই মোড়াটা টেনে এনে বোস আমার সামনে।
শ্রীলা বসলো।
ছেলেটা ভালো বুঝলি। আমি নিজে দেখেশুনে বলছি সদরুল অন্য অনেকের মতো না। ছেলের নাম হচ্ছে সদরুল। একটু সেকেলে নাম অবশ্য। ছেলেটাও ওর নামের মতোই সেকেলে। শান্ত শিষ্ঠ লেজবিশিষ্ট বলতে যা বোঝায়। এমন ছেলে এ সময়ে দেখাই যায় না। একটু ভ্যাবলা টাইপের আছে। এতে তেমন অসুবিধে দেখি না। বরং বেশি চালাক হলেই অসুবিধে ছিল। পাখা গজাতো। একটা পাবলিক কোম্পানিতে আছে। মাইনে সামান্য পাচ্ছে এখন, পরে বাড়বে।
কথা থামিয়ে তাকালেন ভাতিজির মুখের দিকে, কিরে, কি বলছি শুনছিস তো?
ঘাড় নাড়ে শ্রীলা। সে শুনছে।
এতিম ছেলে। মামার কাছে মানুষ। সব দেখেশুনেই সদরুলকে পছন্দ করেছি আমি। এখন তোর মতামত বল।
মাথা নিচু করে শ্রীলা বললো, আমার কিছু বলার নেই। আপনি দেখেছেন যখন...
গাধার মতো কথা বলিস না। তোর বলার কিছু নেই মানে কি ? বিয়ে তো করছিস তুই, আমি না।

ফিক করে হেসে ফেলল শ্রীলা। আমজাদ সাহেবও। চা শেষ করে কাপ ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিকাছে, যা। আর তোর চাচিকে বল ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে দিয়ে। বাজারে বেরবো এখুনি। ওরা এসে পড়বে।

চাচিকে খবরটা বলে শ্রীলা চলে এলো নিজের ঘরে। আসমানিকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই ছাদে গেছে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিরতির করে পা ফেলে ছাদে গিয়ে বসে থাকে সে। ছাদে কি করে কে জানে। হুটহাট ছাদে যাওয়া শ্রীলার তেমন পছন্দ নয়। অন্য বাড়ির ছাদগুলো থেকে ছেলেগুলো কী রকম ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে থাকে। কী যে চটচটে সে চেয়ে থাকার ভঙ্গি, গিলে খেতে চায় যেন।
নীতু বলছিল সেদিন, গোখরা সাপের বিষ আছে ছেলেদের চোখে।
সরল ভাবেই কথা বিশ্বাস করেছিল শ্রীলা। আর তারপরই নীতু বলেছিল, মেয়েদের চোখেও আছে। আমরা অস্বীকার করি।

নীতুর অদ্ভুত একটা খেয়াল আছে। একই মার্কেটে কখনো দুবার ঢুকবে না সে। কোথাও একবারের বেশি দুবার কিছু কিনতে যাওয়া না কী ভালো লাগে না ওর। আর কেনাকাটা করতে গেলে প্রতিবারই শ্রীলাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়।

কিছু কিছু ব্যাপারে খেয়ালি হলেও, দেখেছে শ্রীলা, নীতুর ভেতরটা খোলামেলা। চারপাশটাকে নিজের মতো করে করে নিয়ে ভালো থাকার একটা দারুণ গুণ আছে ওর। ব্যাপারটা শ্রীলাকে টানে। প্রত্যেকটি জটিল ব্যাপারকে সহজ শাদামাটা ভাবে দেখতে পারে মেয়েটা। মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েনকে ও বলে জীবনের শেকড়। পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্যে মানুষের স্বভাব সেটায় মানুষকে সহনশীল করেছে। মাঝে মাঝে এ ধরনের দার্শনিক মার্কা কথা বলে আর চোরাঠোঁটে হাসতে থাকে নীতু। ভালো লাগে শ্রীলার। মেয়েটার ভেতর আলাদা কিছু আছে। তার ভেতর নেই।

মার্কেট থেকে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়ল নীতু, উফ্ যা গরম পড়েছে বাপ! পার্স থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল।
সত্যিই চড়া রোদ উঠেছে আজ। বয়লারের মতো গনগনে তাপ ছড়াচ্ছে চারদিক থেকে। কাঠ ফাঁটা রোদ মাথার ওপর। চারপাশে মানুষজনের গাদাগাদি ভিড়। মানুষের গায়ে গায়ে লেগে তাপ আরও বাড়ছে।
শ্রীলার দিকে চেয়ে নীতু বললো, চল, একটু হাঁটি।
এই রোদ মাথায় ! বিরক্ত হলো শ্রীলা।
চেয়ে দ্যাখ, জ্যাম লেগে গেছে।

শ্রীলা দেখল সত্যিই জ্যামে আটকা পড়ে গেছে রাস্তা। থই থই করছে বাস, স্কুটার, রিকশা। ভেতরের মানুষগুলো মানুষগুলো নিরীহ মুখ করে বাইরের দিকে চেয়ে আছে।
ধ্যাৎ।
হাসে নীতু। চল, জ্যামটা পেরিয়ে গিয়ে সামনের রাস্তা থেকে রিকশা নেব। আয়।
চল।
ভিড় বাঁচিয়ে হাঁটতে লাগল ওরা। শ্রীলা সঙ্গে রুমাল আনতে ভুলে গেছে। এ ভুলটা সে কখনও করে না। আজ করেছে। ঘামে আঠা আঠা হয়ে গেছে সারা মুখ। বিচ্ছিরি একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কিছু কিছু ভুল আছে খুবই তুচ্ছ ভুল কিন্তু অনেক সময় এগুলোই আবার অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এখন মনে হলো তার, মার্কেট থেকে কেনা যেত একটা রুমাল। কিন্তু তখন কে জানত রুমাল নেই তার পার্সে!

এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল শ্রীলা। এমন সময় চোখ পড়ল ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা চায়ের সামনে। ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থেকে তিনটে রুস্তম মার্কা ছেলে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। কী তেলতেলে সেই তাকিয়ে থাকা। শরীর গুলিয়ে ওঠে। রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্টগুলোতে কাচ দিয়ে ঘেরাও করা আলমারির ভেতর রাখা রসগোল্লার দিকে টোকাই শ্রেণির বাচ্চাগুলো যেভাবে চেয়ে থাকে সেই চোখেই ছেলেগুলো এখন দেখছে তাদের। মানুষের চোখে কি বিষ থাকে? তা না হলে এ রকম শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে কেন শরীরের ভেতর?

ওড়নার কোণ দিয়ে মুখের ঘাম মুছল শ্রীলা। সে একা থাকলে এই চাউয়া চাউয়ির ব্যাপার ঘটতো না, বেশ প্রাঞ্জল ভাবে এটা জানে সে। রাস্তাঘাটে সচরাচর কেউ তার দিকে চায়টায় না। কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে যাচ্ছে আসছে চারপাশ দিয়ে, সে সব ফেলে তার মতো পেতিœ মেয়েটাকে কে চেয়ে দেখবে! নীতু দেখতে ভালো। টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট। ফিগারটাও দুর্দান্ত। কেবলমাত্র চোখে ন্যাবা না হলে এ মেয়ের দিকে না তাকিয়ে পারা যায় না।