প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

আবু সায়েম আকন্দের গদ্য ‘ফেরা’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০১৯

আমাদের সকল প্রকারের ফেরা ক্রমাগত আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার প্রতীক— অবিরাম ইশারা, অলঙ্ঘ্য আয়াত। এই প্রতীকের পরিধি এতটাই ব্যাপক ও সুবিস্তৃত যে, জীবনের সব রকমের বিকাশ ও প্রকাশ এই প্রতীকে প্রতিফলিত। রক্তের প্রবাহে, নিঃশ্বাসের ওঠা-নামায় ক্ষয়িষ্ণু আয়ুর যতটুকুই আমরা যাপন করি না কেন, প্রতিনিয়ত আমরা এ সাক্ষ্যই দিচ্ছি— আমরা ফিরছি, প্রতি মুহূর্তে, অনুক্ষণ।

সবাই ফেরে, সব কিছুই ফেরে, ফিরে যায় উৎস। প্রতিটি অগ্রযাত্রায় ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, প্রতিটি উন্মোচনে অবগুণ্ঠিত হওয়ার নিশানা রয়েছে, প্রতিটি প্রকাশে লুপ্ত হওয়ার ঘোষণা রয়েছে। ক্ষণিক বিস্তারের পর আসে সংকোচন, গতির পর স্থিতি। অসীম বিস্তার বলে কিছু নেই। অনন্ত গতি বলে কিছু নেই। আর এখন তো সবাই জানে, সশব্দে ফেটে পড়ার (বিগ ব্যাং) পর মহাসংকোচন (বিগ ক্রন্চ)। মানে, ফেরা, শ্রান্ত হয়ে, অবসিত হয়ে, নিঃশেষ হয়ে, শিথিল হয়ে, নত হয়ে ফেরা— এ এক অনিবার্যতা, তকদির। (সূরা ইয়াসিন, আয়াত: ৩৮)

এই যে দুরন্ত শিশু, স্থানের নতুন অধিকারে মত্ত, দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ায় বিস্ময়ের সীমানা পরিমাপের নেশায়, সেও ফিরে আসে মায়ের কোলে, শ্রান্ত হয়ে। নিমিষেই টুটে যায় স্থানের নেশা। দুনিয়ায় উৎসের যত প্রতীক রয়েছে, মা তার অন্যতম। শিশু তার উৎসেই ফেরে। কিন্তু এই প্রতীকের রয়েছে বিবর্তন, রয়েছে নানামুখী সম্প্রসারণ ও রূপান্তর। কিন্তু এই মেটামরফাসিসের ভেতরেও অটুট থাকে একটি সূত্র। আর তা হচ্ছে, ফেরা। ক্রমাগত সরে যাওয়া কেন্দ্রেরে আকর্ষণ আমরা কখনোই হারাই না।

শিশু তার মায়ের আশ্রয় টপকে বের হয়ে আসে বৃহত্তর ময়দানে— কৈশোরের, যৌবনের। এখন স্থানের নেশা শুধু নয়, আরও অনেক কিছুর অধিকারবোধ তা মনে জাগে। উপরন্তু বাতাস এখন অনেক বেশি তেজস্ক্রিয়, যা তার রক্তে ধরায় কামানের আগুন। প্রেমের প্রচ্ছায় সে আগুন আরও অনেক বেশি মায়াবী, যেন জাদু। এ বাতাসে তার চুল, সাথে ওঠে তার মন। নানা বর্ণ, নানা গন্ধ তার মনকে আকর্ষণ করে তীব্রভাবে। সে আকর্ষণ দুর্নিবার। তার মায়াডোরে কিছুক্ষণ থাকার বাসনা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নতুন ফুলের গন্ধে সে বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু নানামুখী এ বাতাসে মন তার উৎকেন্দ্রিক, তাকে এক স্থানে অনড় রাখা সুকঠিন।

নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরোপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদিপশু এবং খেতখামারের প্রতি আসক্তি মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে। (সূরা আল ইমরান, আয়াত: ১৪)। ফলে মন তার বিচিত্রগামী-নানা ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা, নানা বর্ণে দিশেহারা। চারদিক ঘিরে এত আয়োজন, এত শোভা, এত রস! এসবই তার জন্য? সে ভাবে। দশদিক ঘিরে এত বিচিত্র বর্ণের লীলা তারই মন রাঙানোর আয়োজন।

সুগভীর বাসনার এক্ষেত্র জুড়ে এরই মধ্যে জেগে ওঠে নারী— অনিন্দ্য সুন্দর, মনোহর, উপরন্তু ফলবতী। সকল বহির্মুখী গতি রূপ ধরে ফিরে আসে কামনার এই কেন্দ্রে। আজ নারী তার ধ্যান, জ্ঞান, আরাধনার বস্তু, তার প্রেম। তার কাছে গেলে সকল স্বপ্ন মুঞ্জুরিত হয়ে ওঠে, সকল আকাঙ্ক্ষা গান হয়ে উঠে আসে কণ্ঠে। কাঙ্ক্ষিত সেই কেন্দ্রে যেন ফিরল সে।
 
কিন্তু তবু এখানে, কামনার এই কেন্দ্রে, শরীর ভেঙে নেমে আসে ক্লান্তি, মন জড়িয়ে যায় জটাজালে:

পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা
হয়ে যায় ক্ষয়, প্রেম ধীরে মুছে যায়
নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়
হয় না কি?
                            জীবনানন্দ দাশ

এখন সে ভাবে, কোথায় সে দূর থেকে দেখা আলোর মিনার, উজ্জ্বল বন্দর, নোঙর ফেলার আশ্রয়। এত শুধু ইশারা, আভাস। হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায় দূরে। এভাবেই বারে বারে সরে যেতে থাকে কেন্দ্র। কিন্তু ফেরার এই বাসনা মর্মমূলে বিদ্ধ হয়ে থাকে। আমরা যতই কেন্দ্রাতিগ গতিতে ছুটে চলি, যতই বিদেশ-বিভূঁই মাড়াই, দিগ্বিদিক মন্থন করি না কেন, ফেরার এই টান আমরা অগ্রাহ্য করতে অক্ষম।

আমরা ফিরতে চাই— এই মৃদু গুঞ্জন অন্তরাত্মায় বেঁধে নিয়ে আমরা গুটিয়ে যাই, ভাঁজ হয়ে বসি, কাত হয়ে শুই— আমাদের চোখ বুজে আসে। এক অনির্দেশ্য বিবশতায় আমরা অন্তরমুখী হই। রাতকে গিলাফ বানিয়ে জড়িয়ে নেই সমগ্র সত্তায়। সঁপে দেই নিজেদের— সংকোচহীন, দ্বিধাহীন, প্রতিবাদহীন।

হে প্রশান্ত চিত্ত, তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে আসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে, আমার বান্দাদের মধ্যে শামিল হও আর আমার জান্নাতে দাখিল হও। (সূরা আল ফজর, আয়াত: ২৭-৩০)

লেখক: প্রবন্ধকার ও গণমাধ্যমকর্মী